পবিত্র রামাদানের মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা শেষে ঈদুল ফিতর প্রায় চলেই এলো। এই উপলক্ষে পুরো সপ্তাহজুড়ে চলে আনন্দ উদযাপন। স্বজনদের সঙ্গে কখনো ঘরে, কখনো বাইরে, কখনো বা কোনো দাওয়াতে সাক্ষাৎ, আড্ডা আর বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন তো থাকবেই।
কিন্তু রামাদানের রুটিন থেকে আবার প্রতিদিনের স্বাভাবিক রুটিনে শরীরকে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে একটু ধৈর্য ধরতে হবে, সময় দিতে হবে। নইলে পুরো এক মাস নিয়ন্ত্রিত একটি খাদ্যাভ্যাসে থাকার পর হঠাৎ অনেক বেশি তেল, চর্বি, চিনিযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়তে হয়। পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন- বুক জ্বলা, পেটে গ্যাস হওয়া, বদহজমের প্রবণতা বেড়ে যায় এই সময়টায়। আবার যারা নিয়মিত ডায়েট কন্ট্রোল করেন, তাদের রুটিনেও ঘটে ছন্দপতন।
তাই আসুন জেনে নিই সুস্থভাবে নির্বিঘ্নে ঈদ উদযাপন করার জন্য আপনার রসনাবিলাস কেমন হতে পারে সেই সংক্রান্ত কিছু দরকারি কথাবার্তা।
১) উপকরণ বাছাইয়ে সচেতন হোন
ঈদের মেন্যুটি যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয়, সেজন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে নজর দিন-
- বিরিয়ানি রাঁধতে হলে খাসির মাংসের চেয়ে মুরগির মাংসকে প্রাধান্য দিন।
- পরোটার বদলে নান বা তান্দুরি রুটি বেছে নিন।
- কাজুবাদাম, নারিকেল বা ক্রিম ভিত্তিক গ্রেইভির চেয়ে দই বা টমেটো ভিত্তিক গ্রেইভি বেশি ভালো।
- রায়তা বা সালাদের ব্যবস্থা রাখুন।
- কার্বোনেটেড পানীয়ের চেয়ে ঘরে বানানো শরবত নিঃসন্দেহে শরীরের জন্যে ভালো।
স্বাস্থ্যের জন্যে যেসব তেল উপকারী, সেগুলোই ব্যবহার করুন। যেমন-
- কারি জাতীয় ডিস রান্নার জন্যে সূর্যমুখীর তেল উপযোগী।
- জলপাইয়ের তেল ব্যবহার করতে পারেন সালাদ ড্রেসিংয়ে এবং বেইক করার সময়।
- ক্যানোলা তেল উচ্চ তাপে রান্নার জন্যে উপযুক্ত, সালাদ ড্রেসিংয়ে এটি একেবারেই বেমানান।
- হালকা ধরণের ভাজাভাজির জন্যে রয়েছে লাইট ধরনের তিলের তেল, ডার্ক ধরনের তিলের তেল ব্যবহার করতে পারেন সালাদ আর সসে।
- গ্রেইপসিড তেল মোটামুটি সব ধরণের রান্নাতেই চলে, এটিকে কাজে লাগাতে পারেন গ্রিলিং আর ড্রেসিংয়ের সময়েও।
- ঘি, বনস্পতি, সয়াবিন তেল, পাম তেল, নারিকেল তেল কম ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।
উৎসবের আনন্দে মাংসের কয়েক পদ রান্না না হলে তো চলবেই না। তবে খেয়াল রাখুন, যথাসম্ভব চর্বি ছাড়িয়ে নিয়ে, ছোট ছোট পাতলা টুকরো করে যেন মাংস রান্না করা হয়।
মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরিতে কনডেন্সড মিল্ক এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে চিনির পরিবর্তে মিষ্টি ফল বা মধু ব্যবহার করে খাবারে মিষ্টতা নিয়ে আসুন।
২) রান্নার পদ্ধতি যেন হয় স্বাস্থ্যকর
ডুবো তেলে মচমচে ভাজা খাবারের চেয়ে ভাপে রান্না করা, সেদ্ধ, বেইক করা ও গ্রিল করা খাবার তুলনামূলক স্বাস্থ্যবান্ধব। মাছ ও সবজি বেশি তাপে দীর্ঘ সময় রান্না করবেন না। এতে প্রয়োজনীয় অনেক ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়।
৩) লবণের ব্যবহার সীমিত রাখুন
বেশি লবণ স্বাস্থ্যের জন্যে ভাল নয়। তাই খাবারে এটি বুঝে-শুনে ব্যবহার করুন। স্বাদ-লবণ (টেস্টিং সল্ট) একেবারেই ব্যবহার করা যাবে না।
খাবারকে সুস্বাদু ও মুখরোচক করার জন্য ধনে, মরিচ, পার্সলে, লেবুর রস ব্যবহার করতে পারেন। এগুলো খাবারের স্বাদ বাড়াতে যেমন অনন্য, তেমনি এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেল, যা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।
৪) খাওয়া শুরু হোক ফল ও সবজি দিয়ে
অতিরিক্ত খেয়ে ফেলা রোধ করতে এবং সব ধরনের খাদ্য উপাদানের মধ্যে ভারসাম্য রাখার জন্যে ঈদের মেন্যুতে ফল ও সবজির আইটেম থাকাটাও জরুরি।
লেটুস, টমেটো, মরিচ, শসা, গাজর, বেবি কর্ন দিয়ে তৈরি করে ফেলুন সবজির সালাদ। কিংবা ফলের সালাদে থাকুক আপেল, নাশপাতি, কমলা, পেঁপে, বেদানা। এর সঙ্গে একটু চাট মসলা মিশিয়ে নিলে সালাদের স্বাদ বেড়ে যাবে বহুগুণ।
ভারি কিছু খাওয়ার আগে এরকম বৈচিত্র্যে ভরপুর এক প্লেট সালাদ খেয়ে নিলে ক্ষুধা অনেকটাই মিটে যাবে। ফলে তেল-চর্বিবহুল মেইন ডিসগুলো খাওয়া হবে কম। উদরপূর্তি হবে, তবে স্বাস্থ্যকর খাবারে।
৫) মেইন ডিস
আমাদের দেশে সাধারণত ঈদে মেইন ডিস হিসেবে বিরিয়ানি, খিচুড়ি, বা রুটি জাতীয় কোনো ডিসের আয়োজন করা হয়। এর সাথে হয়তো থাকে টিকিয়া, কোরমা, কারি এসব। তবে আয়োজন যতই হোক, একটি পদ একবার খেয়েই শেষ করুন। ঐ একই খাবার দ্বিতীয়বার আর প্লেটে নেবেন না।
মেইন ডিস খাওয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন প্লেট ভর্তি করে অনেক খাবার না নেয়া হয়। একবারে অনেক বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেললে পাকস্থলীর ওপর চাপ পড়ে, অস্বস্তি বোধ হয়, হজমে সমস্যা হয়। তাই পরিমাণে কম করে ৪-৬ ঘণ্টা পর পর খান।
৬) কার্বোনেটেড ড্রিংকস বর্জন করুন
ভারি ভোজনের পর অনেকেই খাবার হজমের সুবিধার্থে কার্বোনেটেড ড্রিংকস পান করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এগুলোতে থাকা অতিরিক্ত চিনির কুপ্রভাবের কথা তো ভুলে গেলে চলবে না! তাই খাবার খাওয়ার পর এ ধরনের পানীয়ের পরিবর্তে এমন কিছু পান করা উচিত যেটি স্বাস্থ্যসম্মত হবে, আবার হজমেও সহায়তা করবে। যেমন: দই-পুদিনার শরবত, জিরা পানি, ঘোল, লেবুর সরবত, কমলার রস, কফি, আদা-লেবু-পুদিনা মিশ্রিত চা, হারবাল চা (গ্রিন টি, ক্যামোমাইল টি) ইত্যাদি। এগুলো ভারি খাবার খাওয়ার পর খাবার হজম হতে সাহায্য করে। সুস্বাদু সব খাবারের ভিড়ে পানি যেন কম পান করা না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
৭) ডেজার্টস
যেকোনো স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিই চিনিযুক্ত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বছরের বিশেষ উৎসবের দিনটিতে মন সেই নিয়ম ভাঙতে চাইতেই পারে। কী করবেন তখন?
এক্ষেত্রে কৌশল হচ্ছে ডেজার্ট হিসেবে যে আইটেমই থাকুক না কেন, সেটি খাওয়ার আগে যেকোনো একটি মিষ্টি ফলের কয়েকটি টুকরো খেয়ে নিন। ফলের প্রাকৃতিক চিনির প্রভাবে আপনার মিষ্টি খাওয়ার তীব্র ইচ্ছে তখন খানিকটা কমে আসবে। এবার আপনি সেই চিনিযুক্ত ডেজার্ট চাইলেও খুব বেশি খেতে পারবেন না। এতে আপনার মিষ্টি খাওয়াও হলো, আবার শরীরের খুব বেশি ক্ষতিও হবে না।
এছাড়া প্রচলিত ডেজার্ট আইটেমগুলোতে ঘি ও চিনির পরিমাণ সীমিত রেখে, হরেক রকম ফল যোগ করেও এর পুষ্টিমান বাড়ানো যায়। যেমন পুডিং বা ফিরনি তৈরি করলে তাতে যোগ করে দিতে পারেন কিছু ফল।
৮) খাবারকে উপভোগ করুন
তাড়াহুড়ো নয়, সময় নিয়ে খাবার ভালভাবে চিবিয়ে খান। এতে খাবার আস্বাদনে তৃপ্তি পাবেন। আপনার মস্তিষ্ক আপনার শরীরকে খাবার হজম প্রক্রিয়া শুরু করতে নির্দেশনা দেবে। ভালভাবে খাবার চিবোনোর ফলে মুখের লালা নিঃসৃত হবে এবং লালার মধ্যে থাকা এনজাইম খাবার মুখে থাকা অবস্থাতেই হজম প্রক্রিয়া শুরু করে দেবে। ক্ষুধাও দ্রুত নিবারণ হবে।
এতক্ষণ তো স্বাস্থ্যবান্ধব খাওয়া নিয়ে জানলাম, এবার আসুন জেনে নিই ভারি ভোজনের পর কী কী করা উচিত নয়।
১) খাওয়ার পরপরই ব্যায়াম করবেন না। কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম করুন।
২) খেয়েই শুয়ে পড়বেন না বা ঘুমাবেন না।
৩) খাওয়া শেষ করেই গোসল করবেন না। অন্তত আধঘণ্টা বিরতি দিয়ে এরপর গোসল করতে পারেন।
৪) ভারি খাবার খাওয়ার পর চা পান না করাই ভালো।
৫) ধূমপান করা কোনো অবস্থাতেই সমর্থনযোগ্য নয়। আর খাবার খাওয়ার পর ধূমপানে ক্ষতির আশংকা ১০ গুণ বৃদ্ধি পায়।
ঈদে স্বাস্থ্যের ক্ষতি না করেও ভরপুর রসনাবিলাস করার কৌশল তো জানা হয়ে গেল। এবার তাহলে কৌশলগুলো ঠিকভাবে প্রয়োগ করে ঈদটাকে পুরোপুরিভাবে উপভোগ করুন। রোর বাংলা পরিবারের পক্ষ থেকে সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের অগ্রিম শুভেচ্ছা।