বর্তমানে বাংলাদেশে গ্যাস সঙ্কট নামক বিভীষিকা থেকে বাঁচার জন্যে গৃহকর্ত্রীদের কাছে খুব পরিচিত একটি নাম ‘রাইস কুকার’। নামটির সাথে ভাতের সম্পর্ক থাকলেও এর ব্যবহার কিন্তু শুধুমাত্র একটি রান্নাতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ইলেকট্রনিক পণ্যটির সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের রান্না করে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব।
ঘরের চুলাটি গ্যাস স্বল্পতার কারণে জ্বলছে না বলে দুশ্চিন্তা না করে ঘরে পড়ে থাকা রাইস কুকার দিয়েই ঝটপট শেষ করে ফেলতে পারেন সহজ কিছু রান্না। আর যদি ঘরে রাইস কুকার না থাকে, ১২০০ টাকা থেকে শুরু করে অনেক দামের রাইস কুকার খুব কাছের ইলেকট্রনিক্সের দোকান থেকেই সংগ্রহ করতে পারেন। যে রান্নাগুলো খুব সহজেই রাইস কুকারে রান্না করা যায়, সেদিকে আলোকপাত করা যাক।
ঝরঝরে পোলাও
সাদা ভাতের পাশাপাশি রাইস কুকারে খুব সুন্দর ঝরঝরে পোলাও রান্না করা যায়। তবে রাইস কুকারে রান্না করার জন্য ভালো পোলাওয়ের চাল হওয়া বাঞ্ছনীয়। চাল ভালো করে ধুয়ে কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এরপর রাইস কুকার ঢাকনা খোলা অবস্থায় ভেতরের প্যানে তেল বা ঘি ঢেলে কুকারটি চালু করে দিতে হবে।
তেল কিছুটা গরম হয়ে এলে প্যানে পেঁয়াজ কুচি, গরম মশলা ও পোলাওর চাল দিয়ে কাঠের চামচ অথবা রাইস কুকারের চামচ দিয়ে নাড়তে হবে। চাল হালকা ভেজে আসলে পরিমাণ মতো পানি দিতে হবে। সাধারণত চালের পরিমাণের দ্বিগুণ গরম পানি দিতে হয়। এরপর রাইস কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে দিলেই আপনার কাজ শেষ। নির্দিষ্ট সময় শেষে আপনা-আপনি রাইস কুকার ‘ওয়ার্ম’ এ চলে আসবে। চাইলে রান্নার মাঝে ঢাকনা উল্টিয়েও দেখে নিতে পারেন। পোলাও হয়ে এলে দু’চামচ ঘি দিয়ে পরিবেশন করুন মজাদার পোলাও।
রাইস কুকারে কেক
রাইস কুকারে কেক তৈরির কথা শুনে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন। তবে এটি পুরোপুরি অসম্ভব নয়। কিন্তু এটি দেখতে ঠিক ওভেনে বেক করা কেকের মতো না হলেও স্বাদের দিক থেকে কোনো অংশে কম নয়। মজার ব্যাপার হলো, রাইস কুকারে সাধারণ ভ্যানিলা বা চকোলেট কেকও তৈরি করা সম্ভব।
প্রথমে কেকের আকার অনুযায়ী ময়দা, মাখন, ডিম, লবণ, চিনি, দুধ, ভ্যানিলা বা চকোলেট মিশিয়ে রাইস কুকারের প্যানে হালকা তেল মাখিয়ে মিশ্রণটি ঢেলে দিতে হবে। এবার ঢাকনা লাগিয়ে দিয়ে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর কাঁটা চামচ, ছুরি বা একটি টুথপিক দিয়ে কেক হয়েছে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যদি ছুরির গায়ে কেকের কিছু অংশ লেগে থাকে, তাহলে আরো কিছুক্ষণ রাইস কুকার চালু করে রাখতে হবে।
খিচুড়ি
যারা শহরে একা একা থাকেন, তাদের কাছে রাইস কুকারে খিচুড়ি রান্না খুব পরিচিত একটি বিষয়। খুব অল্প সময়ে, অল্প উপকরণে এবং ঝঞ্ঝাটবিহীন রান্না এই খিচুড়ি। প্রথমে পরিমাণমতো বাসমতি বা পোলাও চাল এবং পছন্দমতো মসুর বা মুগের ডাল ভালো করে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। সাধারণত চাল ও ডালের পরিমাণ সমান হলেই ভালো।
আধঘণ্টার মতো ভিজিয়ে রাখার পর চাল ও ডালের সাথে একে একে আদা, পেঁয়াজ ও রসুন বাটা, পরিমাণমতো হলুদ, মরিচ, ধনিয়া ও জিরা গুঁড়ো, লবণ, তেজপাতা ও জয়ত্রী একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর তেল বা ঘি দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে নিয়ে চাল ও ডালের পরিমাণের দ্বিগুণ পানি দিয়ে কুকারে বসিয়ে দিতে হবে। এবার রাইস কুকার চালু করে দিলেই নির্দিষ্ট সময় পর তৈরি হয়ে যাবে ঝটপট খিচুড়ি। ইচ্ছে করলে স্বাদ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি দিয়েও সবজি খিচুড়ি তৈরি করা যায়।
মুরগির রোস্ট
মুরগি পছন্দমতো টুকরো করে লবণ, তেল, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা বাটা, টক দই, মরিচ, হলুদ, জিরা ও গরম মশলার গুঁড়ো, তেজপাতা দিয়ে মাংস ভালোভাবে মাখিয়ে নিয়ে কিছু সময়ের জন্যে রেখে দিতে হবে। এবার রাইস কুকারের প্যানে হালকা তেল দিয়ে শুধু মুরগির টুকরোগুলো হালকা ভেজে নিতে হবে। এরপর বাকি মিশ্রণটি প্যানে ঢেলে দিয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে দিতে হবে।
রান্না হয়ে যাওয়ার পর ওয়ার্ম সুইচে আসলে ঢাকনা উল্টে দেখতে হবে। যদি ঝোলের পরিমাণ কমিয়ে আনতে চান, তাহলে ওয়ার্ম অবস্থায় আরো কিছু সময় রেখে দিতে হবে। একই পদ্ধতিতে গরু বা খাসির মাংসও রান্না করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে মশলা মাখানো গরু বা খাসির মাংস দীর্ঘ সময় রেখে দিতে হবে।
বিভিন্ন ধরনের সবজি সেদ্ধ করা
রাইস কুকারের সাথে ঝাঁকার মতো একটি স্টিমার সাথে দেয়া থাকে। এই উপকরণটির সাহায্যে খুব সহজেই যেকোনো সবজি সিদ্ধ করে ফেলা যায়। নিজের ইচ্ছানুযায়ী সবজি ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিতে হবে।
কুকারে ভাত রান্না করার সময় অথবা প্যানে কিছু পানি দিয়ে স্টিমারে সবজিগুলো রেখে ঢাকনা বন্ধ করে দিলেই হলো। ভাতের সাথে সাথেই সবজি সেদ্ধ হয়ে রান্না হয়ে যাবে।
ভাজা খাবার
সাধারণ রাইস কুকারে এই রান্নাটি করা সম্ভব নয়। তবে বর্তমানে এমন একধরনের রাইস কুকার বা মাল্টি কুকার পাওয়া যায় যাতে ডুবন্ত তেলে ভাজা বা ফ্রাই করার সুবিধা থাকে। এই ধরনের রাইস কুকারের মূল্য সাধারণ কুকারের চাইতে কিছুটা বেশি হয়। কারো তেলে ভাজা খাবার খুব পছন্দ হলে এই কুকারটি সংগ্রহে রাখতে পারেন।
এতে প্যানের সাথে একটি ঝাঁকার মতো থাকে, যার সাহায্যে ডুবো তেল হতে যেকোনো ভাজা করা খাবার খুব সহজে তুলে নেয়া যায়। তবে এতে সাধারণ রাইস কুকারের চাইতে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়।
বিভিন্ন ধরনের মাছ রান্না
রাইস কুকারে মাছ রান্না করার জন্য প্রথমে কয়েক টুকরো মাছ ধুয়ে এর সাথে হলুদ ও মরিচের গুঁড়ো মাখিয়ে কিছু সময় রেখে দিতে হবে। এর সাথে পেঁয়াজ ও রসুন বাটা, লবণ ও কয়েক চামচ তেল দিয়ে মিশিয়ে রাইস কুকারে বসিয়ে দিতে হবে।
নির্দিষ্ট সময় শেষে মাছ রান্না হয়ে আসলে ঢাকনা খুলে কয়েকটি কাঁচা মরিচ ও ধনেপাতা দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে।
ডিমের নানা তরকারি
রাইস কুকারে খুব সহজে সকালের খাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ডিমের তরকারি রান্না করা সম্ভব। সকালের নাস্তায় ডিমের অমলেট বানানোর জন্যে প্রথমে একটি বাটিতে ডিম, পেঁয়াজ কুচি, কাঁচা মরিচ ও লবণ দিয়ে ফেটে নিতে হবে। এরপর প্যানে কিছুটা তেল দিতে হবে। তেল গরম হয়ে আসলে মিশ্রণটি ঢেলে দিয়ে কুকারের ঢাকনা বন্ধ করে দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর ঢাকনা উল্টে ডিম দেখে নিতে হবে। ডিম হয়ে আসলে রাইস কুকার বন্ধ করে দিতে হবে। এছাড়াও রাইস কুকারে খুব সহজে ডিম সেদ্ধ করে নেয়া সম্ভব।
বর্তমানে বাসা-বাড়িতে গ্যাসের অসম্ভব সংকটের কারণে গৃহিণীদের অনেক সময় রান্নার দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়। অনেককে ঘরের বাইরের খাবারের উপরও নির্ভর করতে হয়। কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম তেল ও মশলায় রান্না করা যায় বলে রাইস কুকারের রান্না বেশ স্বাস্থ্যসম্মত। তবে রাইস কুকারে রান্না করার জন্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন। রান্না সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, সেক্ষেত্রে রাইস কুকারের ঢাকনা না খুলে রেখে দিতে হবে। পুনরায় বিদ্যুৎ এলে আবার রাইস কুকার চালু করে দিতে হবে। এভাবেই খুব সহজে রাইস কুকারের উপযুক্ত ব্যবহারে অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে আপনার দৈনন্দিন জীবনের পথচলা।
ফিচার ইমেজ- youtube.com