শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যটির নাম দুধ। জন্মের পরপরই শিশুর জন্য মায়ের বুকের দুধের বিকল্প নেই। প্রায় দুই থেকে আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য বাধ্যতামূলক। শৈশবের শুরু থেকে এরপর সারাজীবনই মানুষের শরীরের বৃদ্ধি, উন্নতি ও সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হিসেবে সমাদৃত দুধ। তরল কিংবা গুঁড়ো দুধ, প্রয়োজনের ভিন্নতা অনুসারে দুই ধরনের দুধই প্রচলিত সারাবিশ্বে।
বিশ্বের আবহাওয়া পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কখনো কখনো তা তৈরি করছে মানুষের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ। সুস্থ সবল মানুষেরা সেই প্রতিকূল পরিবেশের ধকল সামলাতে পারছে সহজেই। করোনাভাইরাসের মহামারির কালেও যারা শারীরিকভাবে সুস্থ, তারাই পারছে সবচেয়ে সফলভাবে একে মোকাবেলা করতে। তাই আমরা প্রতিনিয়ত যেসব খাবার গ্রহণ করছি, তার খাদ্য উপাদান এবং উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞান থাকা জরুরি। জানা থাকা দরকার, কীভাবে তারা তাদের খাদ্যপণ্যটি উৎপাদন করছে। সেইসাথে জানা দরকার, কেবল মুনাফাই কি তাদের লক্ষ্য, নাকি মানবসেবা তাদের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।
দুধ উৎপাদনকারী ব্র্যান্ড হিসেবে যাদের নাম এদেশে সবার প্রথমে আসে, তাদের মধ্যে সবার আগে থাকে ডানো। ডানো দুধ বাংলাদেশে প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করলেও, এর প্রস্তুতকারী কোম্পানি সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? কারা জড়িত ডানোর উৎপাদনের সাথে? প্রায় ছয় দশক ধরে কীভাবে তারা করে চলেছে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ? কীভাবেই বা চলছে গোটা প্রতিষ্ঠানটি? চলুন আজ জানা যাক জনমানুষের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই ব্র্যান্ডের পেছনের মানুষগুলো সম্পর্কে।
উনিশ শতকের শেষদিকে ডেনমার্ক ও সুইডেনে অনেকগুলো ডেইরি ফার্ম তাদের ব্যবসা পরিচালনা করত। খামারিরা নিজেরাই সরাসরি দেখভাল করতেন সেসব ফার্ম। ছিল প্রতিযোগিতাও। প্রতিযোগিতা বাড়লে গুণগত মান অনেক সময় কমে যায় ব্যবসায়িক মুনাফার লোভে। তাই প্রতিযোগিতা কমিয়ে গুণগত মান ঠিক রাখতে এই ব্যবসায়ীরা মিলে এসব ডেইরি ফার্মকে একত্রিত করে ১৮৮০ সালের দিকে বড় একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেওয়া হয় ‘আরলা’। এটিই বর্তমানে দুগ্ধশিল্পের জগতে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। আর তাদেরই প্রায় ৩০টি পণ্যের মধ্যে ‘ডানো’ আজ অন্যতম জনপ্রিয় পণ্য সারা দুনিয়া জুড়ে।
পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, খামারিদের হাত থেকে মালিকানা নিয়ে কি তার মানে আরলা নিজেই দুধ উৎপাদন করতে শুরু করেছিল তখন? ঠিক এই জায়গাতেই আরলা অন্যান্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন এবং অনন্য। কৃষক যেমন মুনাফার চাইতেও ফসলের গুণগত মানের প্রতি সর্বদা যত্নশীল থাকেন, তেমনি খামারিও তার গবাদি পশুর স্বাস্থ্য এবং এদের দুধের গুণগত মানের বিষয়েই সর্বোচ্চ মনোযোগ দেন। আর এমন একটি বিশাল কোম্পানির মালিকানাই যদি থাকে খামারিদের হাতে, তখন?
হ্যাঁ, সেই ১৮৮০ সাল থেকে আরলার মালিকানা রয়েছে খামারিদের হাতেই। কোম্পানি একত্রিত হলেও লাভের অংশ লিটারে ভাগ হয়ে চলে যায় দুধের যোগানদাতা খামারিদের হাতে। এতে করে খামারিরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি দুধও ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
প্রায় ৯,৯০০ খামারির যৌথ মালিকানাধীন দুগ্ধ সমবায় আরলা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ছয়টি দেশজুড়ে বাস করেন এসব খামারিরা এবং মুনাফার সবটুকু অংশ ভাগ হয়ে চলে যায় তাদের কাছে। খামারিরাও একদম খাঁটি তরল দুধের যোগান দিয়ে থাকেন। এতে করে দুধের গুণগত মানও নিশ্চিত থাকে শতভাগ। আরলার পণ্য কেনা মানে তাই এক অর্থে প্রকৃত খামারিদেরই পাশে থাকা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, এতজন মিলে প্রতিষ্ঠানটি চালান কী করে কিংবা বাজারে দুধের মূল্যই বা নির্ধারণ করেন কীভাবে?
বিশ্ববাজারে প্রায়ই বিভিন্ন পণ্যের মূল্য ওঠা-নামা করে। বাজার পরিস্থিতি, খামারিদের অবস্থা এবং বিশ্ববাজারের কথা মাথায় রেখে আরলার পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করেন এই খামারিরাই। পরিচালনা পর্ষদ এবং প্রতিনিধি পর্ষদের মাধ্যমে আরলার যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রতি দুই বছর পর পর ছ’টি দেশের খামারিরা গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে থাকেন, যাদের প্রত্যেকের একটি করে ভোট থাকে। এই প্রতিনিধি পর্ষদের সদস্য সংখ্যা ১৭৯ জন। এই ১৭৯ জনের প্রতিনিধি পর্ষদ নিযুক্ত করেন পরিচালনা পর্ষদের ১৫ জন সদস্যকে। পরিচালনা পর্ষদ মূলত দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে দেখাশোনা করে আর প্রতিনিধি পর্ষদ প্রতি বছরের মুনাফার বরাদ্দ নিশ্চিতকরণে কাজ করে থাকে। বছরে অন্তত দুইবার প্রতিনিধি পর্ষদের সদস্যদের সম্মিলিত হতে হয়। যেহেতু এটি একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান, তাই প্রত্যেক খামারির রয়েছে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে মত প্রকাশের ক্ষমতা।
এ তো গেল মালিকানার বিষয়াদি। যারা বিভিন্ন দেশের এই দুধের প্রস্তুতকরণ ও বাজারজাতকরণে নিয়োজিত রয়েছে, নীতি-নির্ধারণী জায়গায় তাদের অংশগ্রহণ কীভাবে হয়? সারা বিশ্বে আরলার প্রায় ১৯ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এদের মধ্যে তিন জন সদস্য কাজ করেন পরিচালনা পর্ষদে এবং ১২ জন প্রতিনিধি কাজ করেন প্রতিনিধি পর্ষদে। এই কোম্পানির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ সকল কর্মকর্তাই এসেছেন তৃণমূলের খামারি পরিবার থেকে।
এভাবেই একটি স্বতস্ফুর্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আরলা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম উন্নতমানের খাদ্যগুণ সম্পন্ন দুগ্ধজাত পণ্য বাজারে সরবরাহ করে আসছে। একজন প্রকৃত খামারিই জানেন কীভাবে তার দুগ্ধদানকারী পশুর যত্ন নিয়ে সর্বোৎকৃষ্ট মানের দুধ বের করে আনতে হয়। শতবর্ষের হাজারো খামারিদের শ্রম আর মেধার ফসল আজকের এই আরলা ফুডস। আরলা মনে করে, ভোক্তার খাদ্যটি কোথা থেকে আসে এবং কাঁচামাল থেকে কীভাবে খাবারযোগ্য দ্রব্যে রুপান্তরিত হয়- তা জানা প্রতিটি ভোক্তার অধিকার এবং একইসাথে এসব তথ্য তাকে সুস্বাস্থ্যময় জীবন পেতে সহায়তা করে। প্রত্যেকে যাতে তার নিজের খাবারের খাদ্যমান নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত থাকতে পারেন, এটাই তাদের প্রধানতম লক্ষ্য।