চা-প্রেমীদের কাছে চায়ের কাপে চামচ নাড়ার শব্দের মতো মধুর কিছু আর হয় না। এই চায়ের প্রতি প্রেম অনেক পুরনো ইতিহাস। চায়ের ঐতিহ্যের প্রমাণ মেলে ২৭৩৭ খ্রিস্টপূর্বের চীনে। কিংবদন্তি বলে, সম্রাট শেনং এর গরম পানিতে ভুল করে শুকনো পাতা পড়েছিল। সেই পানি সম্রাট পান করে দেখেন গরম পানির স্বাদ অভূতপূর্ব হয়েছে। তারপর চায়ের চল ছড়িয়েছে পুরো চীন, তারও পরে সারা বিশ্বে। তবে যেখানেই সে গেছে, সেদেশের নিজস্ব রীতিনীতির সাথে খাপ খাইয়ে গেছে। কখনো চায়ের কাপে, কখনো চা তৈরি করার প্রক্রিয়ায়, কখনো চায়ের সাথে যোগ করা উপাদানে প্রতি দেশে চা স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। তাহলে জেনে নেওয়া যাক বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত চায়ের ঐতিহ্যের কথা।
মরক্কোর তিন বারে পুদিনা চা
লম্বা, সরু গ্লাসে মরক্কোর এই চা পরিবেশিত হয়। দেওয়া থাকে পুদিনা, সবুজ চা পাতা আর বেশ খানিকটা চিনি। মাগরেবি পুদিনা চা বা তুয়ারেগ চা নামে ডাকা হয় একে। প্রত্যেক অতিথিকে তিনবার চা পরিবেশন করেন মরক্কোবাসীরা। প্রতিবারে লিকার একটু করে গাঢ় করা হয়। প্রথম চায়ের অর্থ ‘জীবনের মতো কোমল’, দ্বিতীয় চা ‘ভালোবাসার মতো শক্তিশালী’, আর তৃতীয় চা ‘মৃত্যুর মতো তিক্ত!’ ভুলেও যদি অতিথি এর এককাপ পান করতে অস্বীকার করেন, তবে এটাকে তার চরিত্রের রুক্ষতা বলে ধরে নেওয়া হয়।
তিব্বতের চমরী গাইয়ের মাখন চা
চায়ের কাপে দুধ ভালো লাগে, নাকি লেবু- এ বিতর্ক তো বহু পুরোনো। কেমন হয়, যদি জানতে পারেন তিব্বতীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী চায়ে মেশায় চমরী গাইয়ের দুধ থেকে পাওয়া নোনতা স্বাদের মাখন? একে বলা হয় ‘পো চা’। পেমাগুল চায়ের একটা দলাকে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্বাল দিয়ে সেখানে যোগ করা হয় দুধ, লবণ আর মাখন। তিব্বতের উচ্চতায় আর আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে চলতে স্যুপের মতো ঘন এই চা বেশ কাজে দেয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে চা
ভারত-বাংলাদেশ থেকে প্রচুর চা উৎপাদনের সাথে সাথে চায়ের একটা বড় ভোক্তা সমাজ এখানকার। রাস্তার পাশে টঙ দোকানে এক কাপ চা পান করতে করতে সবাই এখানে হয়ে ওঠে তুখোড় বিতার্কিক। খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির সংকট সবই তখন তাদের দখলে। কেউ নেয় মসলা চা। কেউ আবার চিনির সাগরে অনেকখানি দুধ মিশিয়ে পায়েসের মতো চা পান করে। এখানে মাটির কাপের প্রচলন আছে। চা পান করে কাপ ভেঙে ফেলতে হয়। এদিকে বাংলাদেশের সিলেটে পাওয়া যায় সাত রঙের চা।
আর্জেন্টিনার ইয়ারবা মা-তায়
আর্জেন্টিনার মানুষদের জীবন ইয়ারবা মা-তায় চা ছাড়া চলে না। এই চা তৈরি হয় ইয়ারবা মা-তায় নামের ভেষজ উদ্ভিদ থেকে। বমবিলা নামের নল দিয়ে পান করা হয় ছোট পাত্রে পরিবেশিত এই চা। আড্ডার সময় এক পাত্র চা সবার মাঝে ঘুরতে থাকে। এভাবে তারা নিজেদের বন্ধন প্রকাশ করে। যদি কেউ ‘ধন্যবাদ’ বলে চা পান না করতে চায়, তবে এর থেকে বড় অপমান আর হয় না। তাছাড়া বমবিলা দিয়ে পাত্রে থাকা চা নাড়া যাবে না। এতে প্রমাণিত হয় চা প্রস্তুতকারকের অদক্ষতা। আগেকার দিনে আর্জেন্টিনার অধিবাসীরা এই চা চিনি ছাড়াই পান করত। আজকাল এতে চিনি বা মধু মেশানো হয়।
রাশিয়ার জাভারকা
রাশিয়ায় মন্দার সময়ে খাবার আর পানীয় যত কম পরিমাণে যত বেশি মানুষকে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টা করা হয়েছে। এই তীব্র অভাবের সময়েই এসেছিল জাভারকা চা। সামোভার নামের ধাতব পাত্রে একে ফুটিয়ে লম্বা বড় গ্লাসে পরিবেশন করা হয় এই পানীয়। কখনোই পুরো গ্লাস ভর্তি করা হয় না। রাশিয়ার মানুষেরা এই চা কোনোকিছু ছাড়াই পানে অভ্যস্ত। অবশ্য গৃহকর্তা দুধ-চিনি লাগবে কি না জিজ্ঞাসা করে থাকেন। এটা সাধারণ ভদ্রতার মাঝে পড়ে। কখনোই কোনো গৃহকর্তা মুচমুচে কুকি বিস্কুট বা অন্য নাস্তা ছাড়া শুধু চা পরিবেশন করলে এটাকে অসভ্যতা বলে ধরে নেওয়া হয়।
চীনের গোংফু চা
‘গোংফু চা’ চীনের ঐতিহ্যবাহী চায়ের অনুষ্ঠান। অনেকগুলো ধাপে এখানে চা পরিবেশন করা হয়। ঢাকনাওয়ালা থালা থেকে শুরু করে সাঁড়াশি পর্যন্ত থাকে এই উৎসবের হাঁড়ি-পাতিলের তালিকায়। চা পানের আগে তার ঘ্রাণ শোঁকা হয়। তারপর চা জ্বাল দিয়ে প্রথমে সূক্ষ্ম কারুকাজ করা পাত্রগুলোকে ধোয়া হয়। তারপর সব পাত্র একজায়গায় গোল করে রেখে চা ঢালা হয়। চা শেষ হয়ে গেলেও চায়ের ঘ্রাণে মেতে থাকেন অংশগ্রহণকারীরা।
থাইল্যান্ডের বরফ চা
চীনে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই অনেক মানুষ থাইল্যান্ডে পাড়ি জমায়। তারা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল তাদের চায়ের অভ্যাস। কিন্তু থাইল্যান্ডে এসে চা একদম অন্যরকম রূপ নিল। থাইল্যান্ডের পীত বর্ণের ইয়েন চা বানানো হয় সেইলন চা বা আসাম চায়ের সাথে চিনি, ঘন দুধ আর কিছু মশলা মিশিয়ে। তারপর লম্বা গ্লাসে বরফ দিয়ে পরিবেশন করা হয়।
তাইওয়ানের বাবল চা
১৯৮৮ সালে কথা। তাইওয়ানের এক চায়ের রেস্তোরার কর্মচারী পরীক্ষা করে দেখার জন্য ডেজার্ট থেকে ট্যাপিওকার ছোট ছোট বল তুলে চায়ে দিলেন। তারপর সেদিনের কর্মচারীদের মিটিঙে আসা সবাইকে এই চা পরিবেশন করলেন। সবার ভীষণ পছন্দ হলো এই চা। রেস্তোরাটি তাদের বাবল চায়ের বিক্রি শুরু করলো। তাদের জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে আন্তর্জাতিকভাবে বাবল চায়ের ব্যবস্থা শুরু করে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার অনেক রেস্তোরা।
জাপানের চা উৎসব
চীনের মতো জাপানেরও চায়ের অনুষ্ঠান হয়। আর এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণকারীরা তাদের অতিথিদের পছন্দের বিষয়ে সংবেদনশীলতা দেখান। সেটা হতে পারে, যেভাবে অতিথিকে দাওয়াত দেওয়া হবে, যেভাবে ঘর সাজানো হবে, কোন পাত্রে চা তৈরি হবে, কেমন চা তৈরি হবে, এমনকি চায়ের পাত্রটি যেভাবে ধোয়া হবে। ঋতু অনুযায়ী রীতিনীতি বদলালেও সাধারণত সবুজ রঙের গুড়ো ‘মাচা চা’ পরিবেশন করা হয় মিষ্টি নাস্তার সাথে।
পাকিস্তানের নুন চা
এটা সাধারণত কাশ্মীরের চা, আর বিশেষ উপলক্ষেই পরিবেশন করা হয়। পেস্তা, কাজু, লবণ, দুশ আর মশলার সংমিশ্রণের এই গোলাপি রঙের চায়ে অনেকে অল্প একটু বেকিং সোডাও মেশায়। একে বলে নুন চা। অন্যদিকে সবসময় পান করা হয় দুধ পাতি। এটা পানি ছাড়া তৈরি দুধ চা।
যুক্তরাজ্যে বিকেলের চা
সপ্তদশ শতক থেকে ব্রিটেনে চায়ের চল শুরু হলেও বিকেলে চায়ের পাট বসতে দেরি হয়েছিল আরো দু’শ বছর। নিয়মতান্ত্রিক ইংরেজরা তাদের দুপুরের খাওয়া একেবারে দুপুরেই সারতেন, রাতের খাওয়ার জন্য ৮টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। বেডফোর্ডের সপ্তম ডাচেস আনা তার গৃহকর্মীদের বলেন, দুপুর আর রাতের খাওয়ার মধ্যে বিকেল ৪টার দিকে তার চা আর নাস্তা লাগবে। তাকে তার মনমতো নাস্তা পরিবেশন করা হত। তার এই অভ্যাস উঁচুশ্রেণীর ইংরেজদের প্রভাবিত করে, যা ধীরে ধীরে পুরো যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডকে উনবিংশ শতাব্দীতে চায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ মিশনারীরা। এক শতক না পেরোতেই চা দখল করে নিল সকালের খাবারে যেকোনো পানীয়ের জায়গা। শুধু সকাল নয়, ব্রিটেনের মতো বিকালের পানীয়তে চা দিনে দিনে প্রধান হয়ে উঠলো।
রূপার পাত্রে ইরানি চা
যে ইরানে আজ চায়ের কেটলী সারাদিন চুলায় জ্বলে, সেখানে চা জনপ্রিয় হতে অনেকটা সময় নিয়েছে। বিংশ শতকে এসে ইরানিরা নিজেদের কালো চা তৈরি শুরু করে। রূপার পাত্রে করে পরিবেশিত এই চায়ের সাথে দেওয়া হয় ‘নাবাত’ নামের হলদে মিষ্টি। ইরানের মানুষজন কোনোরকম চিনি ছাড়া কড়া চা পানই বেশি পছন্দ করে।
মালয়েশিয়ার তেহ তারিক
চায়ের উপাদান শুনলে মনে হবে, এ আর বিশেষ কি? সেই তো চা, চিনি আর ঘন দুধ। কিন্তু এই চায়ের বিশেষত্ব অন্য জায়গায়। তেহ তারিক চা বানানোর সময় একে ফোমের মতো বানাতে প্রস্তুতকারক হাতের মগটাকে এমনভাবে আগপিছু করেন, কিন্তু মগ থেকে এক ফোঁটা চা-ও পড়ে না। সে এক দেখবার মতো বিষয়। চায়ের চল শুরু হওয়ার সাথেই মালয়েশিয়াতে বেড়েছে চা প্রস্তুতকারকের এই অসম্ভব দক্ষতা দেখার লোকের ভীড়।
পার্থক্যটা যেমন উপাদানে, তেমনই পার্থক্য চায়ের পাত্রে কিংবা পরিবেশনে। তাছাড়া দেশে দেশে চায়ের সাথে যে সহবতটা গড়ে উঠেছে, তা-ও বড় আকর্ষণীয় সংস্কৃতি।
ফিচার ইমেজ: Lifehacker Australia