নবম শতকের ঘটনা। ইথিওপিয়া মালভূমিতে ছাগল চড়াতো খালদি নামের এক রাখাল। একদিন সে বিস্ময় সহকারে লক্ষ্য করে তার পালের ছাগলগুলো এক গাছের লাল রঙের ফল খেয়ে আগের চেয়ে বেশি প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে। সারাদিন বেশ জোশের সাথে ঘুরে বেড়ায়, লাফালাফি করে, রাতেও না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। কৌতূহলী খালদি লাল রঙের সেই ফল মুখে দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে এবং মোহাবিষ্ট হয়ে ঘোষণা দেয়, “এই ফলগুলো স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছে।” পরবর্তী সময়ে সে কিছু ফল কাছে অবস্থিত এক আশ্রমে নিয়ে যায়।
আশ্রমের প্রধানকে এই ফলের মুগ্ধকর কীর্তির কথা বলতেই তিনি এগুলোকে শয়তানের কারসাজি বলে বেশ বিরক্তির সাথে আগুনে নিক্ষেপ করেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই রোস্ট হওয়া তাজা কফি দানার গন্ধে পুরো আশ্রম ভরে যায়। বয়সে তরুণ এক অবাধ্য ভিক্ষু আশ্রম প্রধানের কথা অমান্য করে কিছু দানা ঠাণ্ডা করে গরম পানিতে ছেড়ে দেয় এবং প্রথমবারের মতো কফি খাওয়ার আদর্শ উপায় উদঘাটন করে। সে বেশ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে এই দানা দ্বারা তৈরি পানীয় তাদের পুরো রাত জেগে প্রার্থনা করার শক্তি প্রদান করে।
এই ছিল কফি আবিষ্কারকে ঘিরে সবচাইতে বেশি প্রচলিত কিংবদন্তী। যদিও লোকমুখে অন্য গল্পও শোনা যায়। তবে নবম শতকের পরে আস্তে আস্তে পুরো পৃথিবীতে কফির জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সে সময় ‘কফিয়া অ্যারাবিকা’ নামেই একে ডাকা হতো। দশম শতকের প্রথম দিকে পদার্থবিদ এবং দার্শনিক ইবনে সিনা বুখারি কফির ঔষধি বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রথম নথিপত্র রচনা করেন। এগারোশ’ সালের দিকে আরব ব্যবসায়ীরা ইয়েমেনে এনে কফির বীজ বপন করে। সে সময় আরবে কফি পরিচিত ছিল ‘কাহওয়া’ বা ঘুমে বাধাদানকারী হিসেবে।
কোরআনে নিষিদ্ধ মদ বা অন্যান্য নেশাজাতীয় পানীয়র বদলে অধিকাংশ মানুষই কফিকে বেছে নিলো। ১৪৫৪ সাল থেকে পুরো পনেরো শতক পর্যন্ত আরবের মুসলিমদের মাঝে কফির জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। সেসময়ই ইয়েমেনের বন্দর নগরী এডেনের (Aden) এক মুফতির কল্যাণে প্রথম কফিশপ তৈরি হয়, যার নাম ছিল ‘কাভেহ কানেস (Kaveh Kanes)’। এরপর পাড়া, মহল্লায়, রাস্তার ধারে তৈরি হতে থাকে বিভিন্ন কফিশপ। মুসাফির, মেহমান, বৃদ্ধ, জোয়ানদের অবসর কাটানো, গল্প, রাজনৈতিক আলাপ করা, গানে মশগুল হওয়ার জায়গায় স্থান পায় এই কফিশপগুলো। যদিও ১৫১১ সালের দিকে প্রথমবারের মতো সেখানকার গভর্নর খালেদ বে-এর মাধ্যমে প্রথম কফির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এরপরের ইতিহাস শুধু কফির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে যাওয়ার। ইয়েমেন থেকে মক্কা-মদিনা, পারস্য, মিশর, আফ্রিকা, রোম, ইউরোপ, আমেরিকা হয়ে পুরো পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি পান করা পানীয়তে রূপান্তরিত হয় এই কফি। প্রতি বছর পুরো পৃথিবীতে চারশত বিলিয়ন কাপের উপর কফি পান করা হয়ে থাকে। দৈনিক যার পরিমাণ চারশত মিলিয়ন কাপ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন কফি আসক্ত ব্যক্তি বছরে প্রায় ষোল হাজার কাপ কফি গ্রহণ করে। একমাত্র আমেরিকা পুরো পৃথিবীতে উৎপন্ন সাতাশ শতাংশ কফি আমদানি করে থাকে।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে গেছে কফি বানানোর পদ্ধতিও। মানুষজন নিজেদের চাহিদা মতো কফিকে করে নিচ্ছে আরও মজাদার। কফিশপগুলোতে সাধারণ তেতো স্বাদের এসপ্রেসোতে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন স্বাদ। যেখানে কফি ছিল শুধুমাত্র সতেজকরণ ক্যাফেইনের উৎস, সেখানে বর্তমানে কফি তৈরি পরিপূর্ণ একটি শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে এমন হয়েছে যে, কফিশপগুলোর মেন্যু দেখলেই বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতে হয়। এসপ্রেসো নাকি লাত্তে, ম্যাক্কিয়াতো নাকি আফগানো, মোকা নাকি কাপুচিনো, অনেকের আবার মোকার বিভিন্ন প্রকার দেখে খাবি খাই অবস্থা। এই বিভ্রান্তি দূর করার জন্যই আজ আপনাদের কফির বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কে বলবো।
১) এসপ্রেসো (Espresso)
প্রায় সব ধরণের কফিই এসপ্রেসোর উপর নির্ভর করে বানানো হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন স্বাদের কফির মূল কাঁচামাল এই এসপ্রেসো। এসপ্রেসো সাধারণত খুব কড়া এবং তেতো হয়ে থাকে। প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন অ্যাডিক্টেডদের জন্য এসপ্রেসো অতুলনীয়। কফিশপগুলোতে দুই ধরণের এসপ্রেসো তৈরি করা হয়। শর্ট ব্ল্যাক এবং ডোপিও বা ডাবল এসপ্রেসো। যাদের ক্যাফেইনের পরিমাণ একটু বেশিই প্রয়োজন তাদের জন্য ডোপিও যথার্থ। আবার বিশ্বব্যাপী দুই ধরনের এসপ্রেসো প্রচলিত। ইতালিয়ান এবং কিউবান। ইতালিয়ান এসপ্রেসো খুব কড়া হয়ে থাকে। কাপে কফির পরিমাণও থাকে কম। যা এক বা দুই চুমুকেই শেষ করে ফেলা যায়। সম্পূর্ণ চিনি ছাড়া এই এসপ্রেসো টার্কি ও গ্রিসেও বেশ প্রচলিত। অন্যদিকে পুরো পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত এসপ্রেসোই হচ্ছে কিউবান এসপ্রেসো, যা ছোট কাপে ৩০মি.লি.-এর মতো কফি, চিনিসহ পরিবেশন করা হয়ে থাকে।
২) কাপুচিনো (Cappuccino)
কাপুচিনো মূলত তিন ভাগের একভাগ কফি, একভাগ ফুটন্ত গরম দুধ (Steamed milk) এবং এক ভাগ ফোম (Foamed milk) দিয়ে তৈরি করা হয়। অনেক সময় ধরে কফিকে গরম রাখার জন্য উপরের ফোম সহায়ক হিসেবে কাজ করে। এ সকল উপকরণ ছাড়াও অনেকে স্বাদের ভিন্নতার জন্য বিভিন্ন ধরণের ক্রিম, হট চকলেট পাউডার ব্যবহার করে থাকে। এটি ইতালিয়ান ট্র্যাডিশনাল কফি হলেও বাংলাদেশ সহ প্রায় সারা বিশ্বে এর জনপ্রিয়তা অনেক।
৩) কফি লাত্তে (Coffee Latte)
কাপুচিনো আর কফি লাত্তে তৈরির প্রক্রিয়াটা প্রায় একই। কিন্তু কফি লাত্তেতে দুধের পরিমাণটা বেশি থাকে। প্রায় ছয় ভাগের চার ভাগ। এটিও ট্র্যাডিশনাল ইতালিয়ান কফি। এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ এর সাথে বিভিন্ন প্রকার স্বাদ, উপকরণ দিয়ে বেশ ভালো ডেজার্ট হিসেবে পরিবেশন করা যায় মূল বৈশিষ্ট্য নষ্ট না করেই। আর আঁকাআঁকির অভ্যাস থাকলে অসাধারণভাবে বিভিন্ন ধরনের জিনিস আঁকা যায় দুধ ব্যবহার করে।
৪) মোকা (Mocha)
মোকা হচ্ছে এসপ্রেসো আর হট চকলেটের বেশ গাঢ় মিশ্রণ। যেখানে সাধারণত পাঁচভাগের একভাগ দুধ, দু’ভাগ এসপ্রেসো এবং দু’ভাগ হট চকলেটের মিশ্রণ থাকে। এতে সাধারণভাবে চকলেট হিসেবে মিষ্টি কোকা পাউডার, চকলেট সিরাপ, ডার্ক কিংবা মিল্ক চকলেট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
৫) ম্যাক্কিয়াতো (Macchiato)
ম্যাক্কিয়াতো মূলত এসপ্রেসোর কড়া স্বাদটাকে কোমলকরণের জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে। সাধারণত এক শট এসপ্রেসোর উপরে হালকা ফেনা সমৃদ্ধ চিকন লেয়ারের অল্প পরিমাণ দুধ ব্যবহার করে এটি তৈরি করা হয়। তবে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বারিস্তারা (Barista) এটিকে বিভিন্ন ভাবে পরিবেশন করে থাকে। পর্তুগালে ম্যাক্কিয়াতো ক্যাফে পিনগাডু (café pingado ) নামে পরিচিত।
৬) ফ্লাট হোয়াইট (Flat White)
এটি মূলত অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের কফিশপগুলোতেই দেখা যায়। এটি প্রায় কাপুচিনোর মতোই। কিন্তু এতে ফোম এবং চকলেট ব্যবহার করা হয় না।
৭) অ্যাফোগাতো (Affogato)
অ্যাফোগাতো শব্দটি ইতালিয়ান, যার অর্থ হচ্ছে নিমজ্জিত। এটি মূলত এক প্রকার ডেজার্ট কফি। গ্রীষ্মকালে এবং রাতে খাবারের পরে এটি পরিবেশন করা হয়। সামান্য দুধের সাথে ভ্যানিলা আইসক্রিম এবং সিঙ্গেল অথবা ডাবল শট এসপ্রেসোর মিশ্রণে এটি তৈরি করা হয়ে থাকে। অনেকে চাহিদা মতো চকলেট সিরাপও ব্যবহার করে থাকে।
৮) আইরিশ কফি (Irish Coffee)
এটি মূলত এসপ্রেসো, আইরিশ হুইস্কি এবং চিনি দ্বারা তৈরি করা হয়। পরিবেশনের সময় উপরের দিকটায় গাঢ় ক্রিমে ভর্তি থাকে। ইউরোপ, আমেরিকায় এর অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে।