“আইসক্রিম” শব্দটি শুনলেই কার না জিভে জল আসে? সে গ্রীষ্ম, শীত বা বর্ষা যায় হোক না কেন! আইসক্রিম এর আবেদন কখনো কমবার নয়। ছেলে থেকে বুড়ো, সকলের এক বাক্যেই পছন্দ এই একটি নাম। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিভিন্ন স্বাদ, গন্ধ ও ফ্লেভারের আইসক্রিম বাজারে পাওয়া যায়। গরমের দিনে আইসক্রিম মুখে পুড়ে দিলেই যেন রাজ্যের শ্রান্তি মনের মধ্যে ধরা দেয়। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে, কী করে এলো এই আইসক্রিম? কার মাথা থেকে এলো এমন চমকপ্রদ এক আইডিয়া? তাকে কাছে পেলে একটা ধন্যবাদ দিতে কার না ইচ্ছে হয়! তাহলে চলুন আজ জানা যাক কী করে শুরু হলো এই মন মাতানো খাবারের জন্ম পরিক্রমা।
আইসক্রিম আবিষ্কারের ইতিহাস খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে। আইসক্রিম আবিষ্কারের কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বা আবিষ্কারকের নাম নেই। আইসক্রিম কোথা থেকে এলো তার একটি প্রচলিত গল্প পাওয়া যায়। আর এই গল্পের সূচনা ধরা হয় ৬২ খ্রিস্টাব্দে। রোমের রাজা নিরো রাজ্যের বাবুর্চির কাছে নতুন মুখরোচক কিছু খেতে চাইলেন। বাবুর্চি তখন রাজার এক কর্মচারীকে পাঠালেন অ্যাপেনাইন পাহাড় থেকে কিছু বরফ নিয়ে আসতে। বাবুর্চি তখন বরফের সাথে বাদাম আর মধু মিশিয়ে রাজাকে পরিবেশন করলেন। রাজা কিছুটা ভয়ে ভয়ে মুখে দিলেন এক চামচ। মুখে দিতেই কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলেন। সাথীরা সকলেই ভয়ে ভয়ে রাজার পানে চেয়ে রইলেন। রাজা চোখ খুলেই এক পরম তৃপ্তির মুখ করে বললেন, ‘ওহে, কোথা পেলে এমন মজাদার জিনিষ?” আর বাবুর্চির ভাগ্য যে কেল্লাফতে তা তো বলাই বাহুল্য।
আইসক্রিমের ধারণা কিন্তু আরও প্রাচীন। খিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতাব্দীতে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের বাজারে বরফ কুচির সাথে মধু আর ফল মিশ্রিত এক ধরনের খাওয়ার পাওয়া যেত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিস আইসক্রিম খাওয়াকে বেশ উৎসাহিত করেছিলেন আর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন “আইসক্রিম জীবনে প্রাণের সঞ্চার করে আর বেঁচে থাকার উদ্যমতা জোগায়।” আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ফুলের মধুতে বরফ দিয়ে খেতে ভালোবাসতেন। এদিকে বাইবেলের রেফারেন্সে রয়েছে, রাজা সোলায়মান ফসল কাটার মৌসুমে বরফ পানীয় খেতে ভালোবাসতেন। ধারণা করা হয় আইসক্রিম রেসিপির সূত্র এগুলোই।
রোম থেকে এই ঠান্ডা রঙিন মিষ্টি বরফের জাদু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বরফ কুচির সাথে ফলের রস, মধু বা সিরাপ দিয়ে তৈরি হতে লাগল ভিন্ন স্বাদের ‘অমৃত’। যখন এই এলাহি জিনিস বাগদাদের খলিফাদের কাছে এসে পৌছল তখন এই জাদুর রঙ বেড়ে গেল আরও কয়েকগুণ। বরফের সাথে তারা বাদাম কুচি, পেস্তা, বিভিন্ন ধরনের ফলের ব্যবহার শুরু করল। খলিফরাই প্রথম আইসক্রিমে চিনি মেশানো শুরু করে। এখানকার আরব বণিকদের মাধ্যমেই আইসক্রিমের বাণিজ্যিকরণ শুরু হয়। চীনেও ব্যাপক প্রসার পায় এই আইসক্রিম। তারা এর মধ্যে ব্যাপকভাবে ফলের রস ব্যবহার শুরু করল। চীনের তাং শাসনামলে (খ্রিস্টাব্দ ৬১৮-৯০৭) বরফের একরকম ডিশ রাজকন্যারা মজা করে খেতেন। তাং রাজার নাকি ৯৪ জন বরফ-বাহক কাজ করতেন। সেই ডিশ গরম দুধ, ময়দা এবং কর্পুর দিয়ে তৈরি হত। এরপর ঐ মিক্সচার একটা ধাতব টিউবে ভরে মাটির নিচে রেখে দেয়া হত। অনেক পরে ভারতে কুলফি এভাবে তৈরি হতো।
সুপরিচিত পর্যটক ও বণিক মার্কো পোলোর নাম কে না শুনেছে? বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করতে করতে তিনি এসে পৌঁছলেন চীন দেশে। সেখানে মনভোলানো এই অমৃত খেয়ে মার্কো পোলোর চোখ ছানাবড়া। শিখে নিলেন রেসিপি। এরপর যখন আবার ইতালিতে ফিরে আসেন সাথে নিয়ে আসেন দিগ্বিজয়ী এই রেসিপি। নেপলসের স্পেনিয় ভাইসরয় আন্তোনিও লাতিনি (১৬৪২-১৬৯২) সর্বেত্তোর একটি রেসিপি লিখে রেখেছিলেন। তিনি দুধ দিয়ে যে শরবত বানিয়েছিলেন ইতিহাসে একেই প্রথম অফিশিয়াল আইসক্রিম বলে ধরে নেয়া যায়। দুধের সাথে আইসক্রিমের মিলন হয় অনেক পরে। ইতালিয়ানরাই প্রথম আইসক্রিম তৈরিতে দুধের ব্যবহার করার কথা ভাবেন।
ইতালির হাত ধরে আইসক্রিম ঢুকে ফ্রান্সে, সেও এক মজার ইতিহাস। ১৫৩৩ সালে ইতালির রাজকন্যা ক্যাথরিন ফ্রান্সের রাজা অরিকে বিয়ে করে যাচ্ছিলেন শ্বশুরবাড়ি। বায়না ধরলেন সাথে নিতে হবে তার প্রিয় রাঁধুনি রগেরিকে যার আয়ত্তে ছিল হরেক রকম আইসক্রিমের সিক্রেট রেসিপি। অবস্থা বেগতিক দেখে রাজা সম্মতি দিলেন রাঁধুনিকে সাথে করে নিয়ে যেতে। আর সেই থেকেই ফ্রান্সে আইসক্রিমের অনুপ্রবেশ।
ইংল্যান্ডও আইসক্রিম নিয়ে মাতামাতি কম নয়। ১৭ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসের টেবিলে রোজই দেখা যেতো ক্রিম আইস নামক একটি খাবার। এই খাবার খেয়ে রাজা এতটাই আত্মহারা হয়েছিলেন যে তার প্রস্তুতকারক ডি মার্কোকে সারাজীবন হেসে খেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, বিনিময়ে রেসিপির ব্যাপারে কাউকে জানাতে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মার্কো সেই কথা রাখেনি। পরবর্তিতে তার এই রেসিপি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভিক্টোরিয়ান যুগে আমেরিকা এবং নরওয়ে থেকে ইংল্যান্ডে আইসক্রিম আমদানি করা হতো। আমদানির ফলে এর দাম ছিল অনেক চড়া।
তবে ১৬৬০ সালের আগে আইসক্রিম সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য ছিলো না। এরপর প্যারিসের প্রথম ক্যাফে ‘ক্যাফে প্রকোপ’ দুধ, ক্রিম, মাখন ও ডিমের সংমিশ্রণে একটি রেসিপি উপস্থাপন করে। ১৮ শতকে এসে আমেরিকার হাত ধরে আইসক্রিমের ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। দুধ, ক্রিম, ভ্যানিলা, স্ট্রবেরি, রেসপবেরি, চকোলেট, ম্যাংগো, এমন নতুন নতুন ফ্লেভার মিশিয়ে আধুনিক আইসক্রিম তৈরি করা শুরু হয়। আমেরিকায় আইসক্রিমের প্রথম সংস্করণ আসে ১৭৪৪ সালে। নিউইয়র্কে আইসক্রিমের প্রথম বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় ১৭৭৭ সালের ১২ মে। তখন কনফেকশনার ফিলিপ লানজি ঘোষণা দেন, এটি প্রায় সবদিন শহরে পাওয়া যাবে। নিউইয়র্কের চ্যাথাম স্ট্রিটের এক ব্যবসায়ী হিসাব করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন ১৭৯০ সালের গ্রীষ্মে আইসক্রিমের পেছনে প্রায় দুইশো ডলার খরচ করেছেন। আঠারোশো শতক পর্যন্ত আইসক্রিম ছিলো অভিজাত শ্রেণীর প্রিয় ডেজার্ট। ওই শতকের আশেপাশে উৎপাদিত আইসক্রিম শিগগির একটি শিল্প হয়ে ওঠে। প্রযুক্তির উন্নয়নের পর অন্যান্য আমেরিকান ইন্ডাস্ট্রির মতো আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রিতেও উৎপাদন উর্ধ্বগতিতে চলতে থাকে।
সম্ভবত এটিই পৃথিবীর প্রথম আইসক্রিমের বিজ্ঞাপন। আইসক্রিমের রেসিপি বই আকারে প্রথম বের হয় ১৭৬৮/৬৯ যা ছিল কোন এক এম.এমি-র The Art of Making Frozen Desserts. ২৪০ পৃষ্ঠার বইটিতে শুধু আইসক্রিমের রেসিপিই ছিল না, এর ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যাও ছিল। ১৭৭৪ সালে নিউইয়র্কের সংবাদপত্রে জনাব ফিলিপো লেঞ্জি জানাচ্ছেন যে তিনি সবে মাত্র লন্ডন থেকে পৌঁছেছেন এবং বিক্রি করবেন জ্যাম, জেলি, পেস্ট্রি আর আইসক্রিম। এটাই সম্ভবত ইতিহাসের প্রথম আইসক্রিমের বিজ্ঞাপন।
১৮৪৩ সালে ন্যান্সি এম. জনসন (১৭৯৫-১৮৯০) আবিষ্কার করেন হ্যান্ড-আইসক্রিম তৈরির যন্ত্র। এই যন্ত্রের মূল নকশাটি এখনও ব্যবহৃত হয়। ঐ যন্ত্রের সাহায্যে ঘরে বসে সহজেই আইসক্রিম তৈরি করা যেত। ন্যান্সি ১৮৪৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর যন্ত্রটি পেটেন্ট করেন। ১৮৫০ সালে কার্লো গাতি (১৮১৭-১৮৭৮) পেনি আইস বিক্রি শুরু করেন। গাতি আইসক্রিমের গাড়িকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায় আইসক্রিম। প্রথম বিপুল পরিমাণে আইসক্রিম তৈরি করেন ১৮৫১ সালে মেরিল্যান্ডের জ্যাকব ফুসেল নিজের কারখানায়।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষে আইসক্রিমের সহজলভ্যতা তুঙ্গে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের কাছে আইসক্রিম একটি ভোজ্য মনোবলের প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৪৫ সালে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের নাবিকদের জন্য প্রথম ভাসমান আইসক্রিম পার্লার তৈরি হয়। যুদ্ধ শেষে দুগ্ধজাত পণ্যের রেশন প্রত্যাহার করা হয় ও আমেরিকানরা আইসক্রিম দিয়ে বিজয় উদযাপন করে।
১৯৪০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে আইসক্রিম উৎপাদন প্রায় একই হারে অব্যাহত ছিলো। বিভিন্ন সুপার মার্কেট ও আইসক্রিম পার্লারে আইসক্রিম বিক্রি হতে শুরু হলো। আস্তে আস্তে মিষ্টি ডেজার্টের চাহিদা বাড়তে থাকে। যুক্ত হয় বিভিন্ন ফ্লেভার ও লুক। আইসক্রিম এতো জনপ্রিয় হয়ে পড়ল যে ১৯৮৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোলান্ড রেগন পুরো জুলাই মাসকেই ‘ন্যাশনাল আইসক্রিম মান্থ’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
বর্তমানে আইসক্রিম অত্যন্ত সহজলভ্য একটি খাবার। বিভিন্ন স্বাদের বিভিন্ন ধরনের আইসক্রিম রাজত্ব করছে বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আছে নিজস্ব নামিদামি ব্র্যান্ড। পাশ্চাত্যের আইসক্রিম কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় মূলত ফ্লেভারের সংখ্যা নিয়ে। হাওয়ার্ড জন্সন যদি তৈরি করে ২৮ রকম, তা হলে বাসকিন রবিন্স তৈরি করবে ৩১ রকম। মধ্য-পশ্চিম আমেরিকায় ‘ব্লু-মুন’ নামে নীল রঙের এক রকম আইসক্রিম আছে যা সেখানে বেশ জনপ্রিয়।
১৯১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ আইসক্রিম দেখিয়েছিল সারা বিশ্বে ৪০০ রকমের আইসক্রিম আছে। সেই সমীক্ষার পর প্রায় ১০০ বছর কেটে গেছে। এখন ৫০০০ হাজারেরও বেশি রকমের আইসক্রিম পাওয়া গেলেও মনে হয় অবাক হওয়ার মতো কিছু আছে।
আইসক্রিমের নাম আসলে সাথে যে নামটি মনের অজান্তেই চলে আসে সেটি হল ‘কোণ’। কোণের আবিষ্কারের পেছনেও আছে মজার ইতিহাস। ১৯০৪ সালে সেন্ট লুই-এর ওয়ার্ল্ড ফেয়ারে এক আইসক্রিমওয়ালা প্লেটে আইসক্রিম সার্ভ করে পেরে উঠছিলেন না। তখন সে ওয়াফল (এখন যাকে আমরা ওয়েফার বলি) বিক্রেতার কাছ থেকে ওয়াফলের কোণে আইসক্রিম ভর্তি করে আইসক্রিম বিলি করতে লাগলেন। আর এই যুগলবন্দী ক্রেতাদের মুখে এক অনবদ্য মুখরোচক খাওয়ারের জন্ম দিল। আর সেই থেকেই রমরমিয়ে চলছে এই ‘কোণ আইসক্রিম’।
আইসক্রিমের সাথে একটা ফিল গুড ব্যাপার আছে। ভাল বা মন্দ সময়, পার্টি বা অনুষ্ঠানে, পরীক্ষায় পাশ বা ফেল যায় হোক না কেন সুস্বাদু আইসক্রিমে একটি কামড় যেন সব ভুলিয়ে দেই নিমিষেই। পুরো বাংলাদেশে হয়তো এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যার আইসক্রিমের নাম শুনলে মুখ ভার হয়ে যায়। চকোলেটের মতই আইসক্রিমের মধ্যেও যেন জাদু আছে মন ভাল করার।পৃথিবীর অনেক ঠাণ্ডা প্রধান দেশেও আইসক্রিমের জয় জয়কারের কমতি নেই।
কিন্তু মাঝে মাঝে বড়রা ছোটদের ঠাণ্ডা লাগার ভয় দেখিয়ে আবার দাঁত নষ্ট হওয়ার অজুহাতে আইসক্রিম খেতে নিষেধ করেন। কিন্তু ব্যাপার যখন আইসক্রিম নিয়ে তখন সে নিষেধ আমরা কখনো মান্য করেছি কিনা তা আমাদের কাছে আজও ধুসর।