মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সময়ে আমাদের বসবাস। যেখানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের জেগে থাকার পুরো সময়টাই কাটাতো খাদ্যের সন্ধানে, সেখানে খাবার আমাদের সামনে এখন চলে আসছে প্যাকেটজাত হয়ে- ফোনকলে বা অনলাইন অর্ডারে। হ্যাঁ, অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছি আমরা, খাদ্য শিল্প এগিয়ে গেছে অনেক। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই এত বড় খাদ্যের বাজার আন্তর্জাতিকভাবে আছে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির হাতে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কোম্পানি নেসলে। ম্যাগি, নিডো, নেসক্যাফে, সেরেলাক, ল্যাক্টোজেন- ইত্যাদি প্রয়োজনীয় খাদ্য-ব্র্যান্ড ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের দেশেও নেসলে স্থাপন করেছে প্যাকেটজাত খাদ্যের সাম্রাজ্যে সমীহ জাগানো আধিপত্য। আজ আমরা এই নেসলে কোম্পানির গল্পই শুনব।
তখন ১৮৬৬ সাল। সুইজারল্যান্ডের সম্পূর্ণ দুই প্রান্তে দু’জন উদ্যোক্তার উত্থান চলছে সমসাময়িকভাবেই, দু’জনই স্বপ্ন দেখছেন নিজের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার। পূর্ব প্রান্তের মানুষটির নাম ছিল চার্লস পেইজ, সুইজারল্যান্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত যিনি কীনা সুইজারল্যান্ডের সবুজ মাঠ আর গৃহপালিত পশুর অবাধ বিচরণের প্রেমে পড়ে সুইজারল্যান্ডেই থেকে গিয়েছেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল সুইজারল্যান্ডে একটি কন্ডেন্সড মিল্কের কারখানা তৈরি করা, যার অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন দশ বছর আগেই নিজের দেশ ইউএসএতে গেইল বোর্ডেন নামক এক ব্যক্তির করা কারখানা থেকে। চার্লস তাঁর ভাই জর্জকে তাই বোর্ডেনের কাছে পাঠিয়েছিলেন তাঁর কন্ডেন্সড মিল্ক বানানোর প্রক্রিয়াটি ভালোমত শিখে আসার জন্য। খুব জটিল প্রক্রিয়া ছিল না সেটা, দুধের জলীয় অংশটাকে বাষ্পীভবন করে তার সাথে চিনি মিশিয়ে দিলেই হয়ে যেত কন্ডেন্সড মিল্ক। তাই দুই ভাই মিলে প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন “অ্যাংলো সুইস কন্ডেন্সড মিল্ক কোম্পানি”, তাদের স্বপ্ন ছিল তাদের এই প্রতিষ্ঠান সমগ্র সুইজারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মূল দুধের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হবে। কিন্তু তাঁরা জানতেন না যে তাঁরা তাদের এই স্বপ্নের থেকেও অনেক বড় কিছু অর্জন করতে যাচ্ছেন।
একই সময়ে, সুইজারল্যান্ডের আরেক প্রান্তে থাকতেন আরেকজন জার্মান অভিবাসী, নাম তাঁর হেনরি নেসলে। তারও ছিল দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য নিয়ে কাজ করার প্রবল ইচ্ছা। তাঁর গল্পটা আরো সুন্দর। তাঁরা ছিলেন ১৪ ভাইবোন, তাই বড় হতে হয়েছিল বেশ সংগ্রামে। সারা ইউরোপ জুড়ে তখনকার উচ্চ শিশুমৃত্যুর হার তাই তাঁকে প্রচন্ড নাড়া দিত, মনে করিয়ে দিত শৈশবের সংগ্রামের কথা। তাই এই সমস্যার সমাধানে তিনি চেষ্টা করলেন গরুর দুধ, চিনি আর গম ব্যবহার করে অল্প দামের মধ্যে মায়ের দুধের বিকল্প তৈরি করার। ১৮৬৭ সাল থেকে তিনি শুরু করলেন তাঁর সেই পণ্য বাজারজাত করার, নাম ছিল “ফারিন ল্যাক্টি।” দ্রুত খ্যাতি পেয়ে গেলেন তিনি, ১৮৭১ সালের মধ্যে তাঁর এই পণ্যের চাহিদা ছড়িয়ে যেতে লাগলো পুরো পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে, প্রতিদিন এক হাজার কৌটা দুধ প্রক্রিয়াজাত করতে হচ্ছিলো তাঁর কোম্পানিকে। তার দু’বছরের মধ্যে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ালো দু’হাজারে।
কিন্তু ১৮৭৭ সালে গিয়ে হেনরি নেসলে টের পেলেন, বাজারে তাঁর একজন বড়সড় প্রতিযোগী এসে গেছে। হেনরি যখন পশ্চিম ইউরোপে শিশুদের জন্য দুধ বিক্রি করে বেশ ভালোই উপার্জন করছেন, তখন পেইজ ভাতৃদ্বয় গড়ে তুলেছে কন্ডেন্সড মিল্ক ব্যবসার এক বিশাল সাম্রাজ্য, যা কিনা তার ব্যবসার থেকেও এখন অনেক বড়। পেইজ ভ্রাতৃদ্বয় এখন তাদের প্রাথমিক ভিশনকে ছাড়িয়ে সারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দুগ্ধ জুগিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সম্পূর্ণ ইউরোপ, এমনকি আমেরিকাতেও। তারপর দেখা গেল, পেইজ ভ্রাতৃদ্বয়ও শুরু করলেন শিশুদের জন্য দুধ বিক্রি করা, যেটি ছিল হেনরির ব্যবসার জন্য স্পষ্ট হুমকি। হেনরি তখন বাজারে ছাড়লেন নিজের ব্র্যান্ডের কনডেন্সড মিল্ক। তখন দু কোম্পানির মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। জেতার জন্য দু কোম্পানি-ই নিজেদের পণ্যের দাম কমাতে শুরু করলো, আর এই যুদ্ধ চললো পরবর্তী ৩০ বছর।
যদিও দু’টি কোম্পানিই এই ৩০ বছরে উৎপাদন এবং বিক্রি বেশ ভালোভাবে চালিয়ে গিয়েছিল, অর্থনৈতিকভাবে দু’টো কোম্পানিই হয়ে পড়লো দুর্বল। কিন্তু হেনরি বা পেইজ দু’ পক্ষই ছিলেন দাম্ভিক, কেউই হার মানলেন না। ১৯০৫ সালে দেখা গেল, হেনরি আর পেইজ ভ্রাতৃদ্বয়ের কেউই বেঁচে নেই, আর তাদের কোম্পানি দু’টিরই বেহাল দশা। তাদের প্রচুর শ্রমিক আছে, ফ্যাক্টরি আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই সে বছর দুটি কোম্পানি মিলে এক হয়ে ইউরোপের একমাত্র দুগ্ধজাত পণ্যের সরবরাহকারী কোম্পানিতে রূপ নিল। এই নতুন কোম্পানির এখন ২০টি কারখানা এবং কোনো প্রতিযোগীও নেই, তাই পরবর্তী দশকের মধ্যেই নেসলে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে ফেললো তাদের ব্যবসা।
তারপর আসলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে নেসলে ব্যবসার জন্য আশীর্বাদই ভাবছিল, কারণ যুদ্ধের সময় প্যাকেটজাত দুগ্ধের চাহিদা অনেক অনেক গুণ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে দেখা গেল, উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল পাওয়া যাচ্ছে না এবং বিভিন্ন দেশের মাঝে অবরোধ থাকার কারণে সরবরাহ করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নেসলেই ২০টি কারখানাই তখন খালি পড়ে রইলো।
কিন্তু নেসলে তো এত সহজে হাল ছাড়ার কোম্পানি নয়, যেহেতু সুইজারল্যান্ডের কারখানাগুলোতে কাজ করা যাচ্ছে না, তাই তারা যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা কিনতে শুরু করলো এবং ব্যবসা পুনরারম্ভ করলো। ১৯১৭ সালের মধ্যে নেসলের হয়ে গেল ৪০টি কারখানা, ১৯২১ এর মধ্যে ৮০টি।
এভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নেসলে খুব বড়সড় একটা শিক্ষা পেয়ে গেল, যে কারখানা এভাবে কেন্দ্রীভূত করা যাবে না, ছড়িয়ে দিতে হবে। সে শিক্ষা থেকেই ত্রিশের দশকে নেসলে এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকাতেও কারখানা খুলতে লাগল, যেন পরবর্তী যেকোনো যুদ্ধ তাদেরকে ফাঁদে ফেলতে না পারে।
কাকতালীয়ভাবে, যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে নেসলে যে কাজটি করছিল, ত্রিশের দশকে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর সময়েও তাদের এই কাজটিই সাহায্য করলো। গ্রেট ডিপ্রেশনের জন্য যখন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা চালানো অসম্ভব হয়ে গিয়েছে, তখন তারা তাকালো ল্যাটিন আমেরিকার দিকে, মূলত ব্রাজিল। ব্রাজিল সরকার নেসলেকে দেখিয়ে দিল, তাদের দেশে জাতীয় চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি কফি উৎপাদিত হচ্ছে, একে ব্যবহার করার কোনো ব্যবস্থা করতে। তখনই মূলত শুরু হলো নেসলে অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ড- ‘নেসক্যাফে’-এর। ‘নেসক্যাফে’ যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে ১৯৩৮ সালে, খুবই অল্প পরিসরে; অথচ এক বছরের মধ্যেই এটি সেদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি ব্র্যান্ডে রূপ নেয়।
এরপর এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এর জন্য কিন্তু এবার নেসলে প্রস্তুত, এবং সে কারণে তারা ফলাফলটাও সেরকম পেলো। ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করার পর নেসক্যাফের কফি রীতিমতো সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান পানীয়তে রূপ নিল। সরকারের সাথে চুক্তি হয়ে গেল নেসলের, লাভ করতে লাগলো প্রচুর। এই যুদ্ধে নেসলের এতটাই অর্থনৈতিক লাভ হলো যে যুদ্ধের পর ছোটখাটো অনেকগুলো ধ্বংসের মুখে থাকা ইউরোপিয়ান কোম্পানিকে কিনে নিলো নেসলে। আর এর মধ্যেই একটি ছিল হচ্ছে-‘ম্যাগি’, যা পরবর্তীতে নেসলের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ডে রূপ নেয়।
এরপর আস্তে আস্তে নেসলের জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে, ফ্রোজেন ফুড থেকে ফার্মাসিউটিক্যাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা ছড়িয়ে দিতে থাকে তাদের ব্যবসা। ১৯৭৪ সালে তারা ফ্রেন্স প্রসাধনী কোম্পানি ‘ল’রিয়েল’ এর ৩০ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। তারপর আশির দশকে তারা কিনে নেয় কিটক্যাট, আফটার এইটের মতো বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্র্যান্ড। ১৯৯২ সালে মিনারেল ওয়াটারের ব্যবসাও শুরু করে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বোতলজাত খাবার পানির কোম্পানিও নেসলেই। দশকে দশকে এভাবেই খাবারের জগতে নেসলে স্থাপন করতে থাকে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য।
তবে এই সাফল্যমণ্ডিত পথে থাকা সত্ত্বেও নেসলে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কের শিকারও কম হয়নি। আশির দশকে তাদের মার্কেটিং কৌশলের জন্য তারা প্রচুর বিতর্কের মুখোমুখি হয়। ২০০২ সালে দুর্ভিক্ষে থাকা ইথিওপিয়াকে ঋণখেলাপী বলে তাদের কাছে ঋণের পরিশোধ দাবি করার জন্য তারা বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়। এছাড়াও নেসলে কোকোয়া পণ্যের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী, আর এই ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িয়ে আছে শিশুশ্রম এবং মানব পাচার, এগুলোর প্রতিও নেসলে নীরব। এসব কারণে অনেকবার নেসলেকে বিশ্বব্যাপী বয়কট করার দাবি উঠেছে। কিন্তু এর মাঝেও নেসলে সম্ভ্রম নিয়েই টিকে আছে, সারা বিশ্বব্যাপী এখন তাদের ২০০০ এরও বেশি ব্র্যান্ড। আর যেহেতু মানুষের খাদ্য চাহিদা ভবিষ্যতে বেড়েই চলবে, কখনো কমবে না, তাই নেসলের এই সাম্রাজ্যও কখনো ধসে পড়বে বলে মনে হয় না।
ফিচার ইমেজ- wallpapersdsc.net