ঘরে যতই মায়ের হাতের অমৃত সব খাবার থাকুক, টেবিলে থাকুক নতুন নতুন জিভে জল আনা পদ; বাইরের খাবারের যে আলাদা একখানা আবেদন আছে, সেটা কি আর কোনো কিছুতে ম্লান হয়! খালার হাতে বানানো পিঠা, কিংবা চাচীর হাতের ভাজাপোড়া খাবার একদিকে তো রইলোই, ভোজনরসিকতার অন্যদিকে রাখা চাই বাইরের এই খাবারগুলোকেও। বাইরের খাবার, বিশেষ করে রাস্তার পাশের খাবারের স্বাদ ভুলিয়ে দিতে পারে সেই সাধ্য মা-খালা বা অন্য কারোরই নেই!
ঘরে সাত পদের তরকারি দিয়ে দুপুরে ভরপেট খাওয়ার পর বিকেলের নাস্তাটিও মন্দ হবে না বলে মা জানিয়েছেন; তাতে পেট শান্ত হবে বটে, কিন্তু পাশের গলির মোড়ে যে মামা সন্ধ্যা হলেই চটপটি-ফুচকা নিয়ে বসবেন, তার গাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় মন আপনার একটুও আনচান করবে না? বুকে হাত রেখে বলুন তো? এলাকার বাজারের সামনে বিকেল হতেই যে নানা পদের ভর্তার সাথে চিতই পিঠার পসরা বসে, সেখানকার শুঁটকি ভর্তার সাথে চিতই পিঠা যে আপনার ভীষণ প্রিয় একটা খাবার, ওটা কয়দিন না খেয়ে থাকতে পারবেন আপনি? বাইরের খাবারের মজাটা আসলে পুরোই অন্য এক মাত্রার। চলতি কথায় যাকে স্ট্রিট ফুড বলা হয়, তরুণদের তো বটেই, মাঝ বয়সের মানুষের কাছেও সে এক ভালোবাসার নাম। এই লেখায় আশেপাশের অলি-গলিতে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা এমন কিছু স্ট্রিট ফুডের সচিত্র বর্ণনাই দিচ্ছি, বাংলাদেশের পথের খাবারের তালিকায় শীর্ষে যাদের স্থান। এসব বেশি খাওয়া আবার মানা, কিন্তু স্বাদে তারা এতোই মনোলোভা যে, দূরে থাকা দায়!
শুরুতে অবধারিতভাবেই আসবে ফুচকা আর চটপটির নাম। একই জায়গায় পাশাপাশি তৈরি হয় এই দুই খাবার। চুলোর উপর বিশাল এক পাতিলে থাকে চটপটি, ভ্যানগাড়ির পাটাতনের উপর আরেক পাতিলে রাখা থাকে ফুচকার পুর। ফুচকা, নামটাই কেমন যেন মন আনচান করে দিয়ে যায়! বোঝা কঠিন, ওই গোলকটার ভেতর পেঁয়াজ মেশানো আলু-কাবলি আর নুনে-ঝালে কী এমন জাদু তৈরি হয়, যেটার মায়া কাটানোই যায় না। বিকেল গড়াতেই ভ্যানগাড়িতে ফুচকা আর চটপটির জাদুর পাতিল নিয়ে হাজির হন বিক্রেতা মামারা। স্কুল-কলেজের সামনে অবশ্য সকাল থেকেই বিক্রি চলে মজার এই খাবারের।
ফুচকার আছে ছোট, বড় আর মাঝারি, তিনখানা আকার। বড় ফুচকা পরিবেশন করা হয় আলাদা পাত্রে, তেঁতুলের টকের সাথে। বেশিরভাগ জায়গাতেই ঝাল-টক আর মিষ্টি-টক নামে দুই স্বাদের টক পরিবেশন করা হয় ফুচকার সাথে। ক্রেতারা নিজেদের পছন্দ মত টকের স্বাদ বেছে নিতে পারে। টকের পাত্রে মিশিয়ে নেওয়া যায় চটপটির ডাল, যেটা স্বাদে আনে অন্য মাত্রা। মাঝারি আকারের ফুচকা পরিবেশন করা হয় সাধারণত দু’ভাবে। কোথাও এটি বড় ফুচকার মতো আলাদা টকের সাথে দেওয়া হয়, আবার কোথাও বাটিতে টকের ভেতর ডুবিয়ে চামচ দিয়ে বাটি দেওয়া হয় ক্রেতার হাতে। ছোট ফুচকাটা আবার টকের ভেতর থেকে উঁকি দিতে দিতে চামচে তুলে মুখে পুরে নেওয়ার জন্যেই তৈরি। পাশের দেশ ভারতে এই জনপ্রিয় খাবার পানিপুরি নামে পরিচিত হওয়াতে আমাদের দেশেও আজকাল ছোট ফুচকাকে পানিপুরি নামে ডাকা হয়। পানির ভেতর ডুবন্ত পুরির মতন থাকে বলেই হয়তো!
ফুচকার দোকানে থাকা অন্য খাবারটি হলো চটপটি। স্বাদের মাত্রায় প্রতিবেশী ফুচকার চেয়ে পিছিয়ে নেই সে মোটেও। ডাবলি বুটের সাথে মশলা, তেল আর ঝালে রান্না করা হয় চটপটি নামক এই অমৃত। সেদ্ধ ডিমের ঝুরি, পেঁয়াজ কুঁচি আর ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী শুকনো বা কাঁচা মরিচ অথবা বোম্বাই মরিচের আগুন ঝাল মেশানো হয় পরিবেশনের সময়। মুচমুচে ফুচকা ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তার উপর। সাথে তেঁতুলের টক তো অবধারিত এর স্বাদ পরিপূর্ণ করতে। কিছু দোকানে চটপটির সাথে লেবুর ঘ্রাণটা মেশানো হয় দারুণ ভাবে। তাতে কারো কারো লোভ বেড়ে যায় আরেকটুখানি। খিদের মুখে কয়েক প্লেট চটপটি সাবাড় করে দিতে খুব বেশি খাদক গোত্রের না হলেও চলবে।
ফুচকা-চটপটির সব দোকানেই যে মন ভোলানো জিনিস মেলে, তা কিন্তু নয়। বরং স্বাদ নিয়ে সামান্য ছাড় দিতেও নারাজ যারা, তাদের মনের মতো খাবার খুব কম জায়গাতেই পাওয়া যায়। নিজ এলাকায় না হলেও আশেপাশের এলাকায় ঘুরে অবশ্য ঠিকই এমন দুয়েকটা প্রিয় জায়গা বের হয়ে যায়। কেননা এ তো পেটের দায়, সাথে মনেরও!
ফুচকা গোত্রেরই আরেক লোভনীয় খাবার হলো ভেলপুরি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই ভেলপুরি নামের খাবারটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনেই বেশি দেখা যায়। ফুচকা কিংবা চটপটির মত ব্যাপক আকারে সারাবেলার নাস্তা হিসেবে তেমন চাহিদা নেই ভেলপুরির। তবে তাতে তার বেশি কিছু ক্ষতি হচ্ছে না, সে হ্যাপি স্টুডেন্ট মিল হয়েই দিব্যি ভালো আছে। তাকে বানানো হয় একটু মোটা ধাঁচের পুরির উপরের অংশ খানিকটা ভেঙ্গে নিয়ে তার ভেতর ঘুগনি মিশিয়ে। শসা আর পেঁয়াজ-মরিচ ছড়িয়ে দেওয়া হয় তার উপর। বাড়তি লবণ দিয়ে তারপর টক মিশিয়ে তুলে দেওয়া হয় ক্রেতার হাতে। বেশিরভাগ জায়গায় এক প্লেটে পাঁচটা মাঝারি কিংবা বড় আকারের ভেলপুরি দেওয়া হয়। হালকা খিদে মেটাতে এক প্লেট যথেষ্ট, খিদের মুখে কারো আবার একাধিক প্লেটেও আপত্তি হবে না।
প্লেটে কিংবা বাটিতে করে কি সব আনন্দ পাওয়া যায়? কিছু আনন্দ আছে, যেগুলো কেবল ঠোঙায় ভরলে তবেই পাবেন। বলছিলাম ঝালমুড়ির কথা, কিংবা ধরুন, চানাচুর। আজকাল সেই বিরাট টান দিয়ে চানাচুউউউরর বলে ডেকে ডেকে আনন্দ বিলানো চানাচুরওয়ালা মামারা প্রায় হারিয়েই গেছেন। তবুও সেটি পাওয়া যাবে এখনো কোথাও কোথাও। রেলওয়ে স্টেশনের চানাচুরের স্বাদ আজ অবধি অন্য কোথাও খুঁজে পাননি, এমন মানুষ সংখ্যায় কম হবে না। শহরের রাস্তাঘাটে ছোট একখানা টুল নিয়ে বসে চানাচুর আর বাদামের স্তূপ সাজিয়ে রেখে বেচাবিক্রি করে চলেছেন, এমন মামারা আছেন এখনো। তবে ঝালমুড়ি জিনিসটা বেশি সহজলভ্য পথেঘাটে। ঘুগনি মেশানো মুড়ি, সাথে কেউ কেউ খানিক তেল-মশলা ব্যবহার করে থাকেন। বাদামও চলে ক্রেতার পছন্দ হলে। আর থাকে পেঁয়াজ-মরিচ কুঁচি, এতেই অসাধারণ স্বাদ তৈরি হয় মামাদের হাতে। পকেটে যখন খরার মৌসুম, পেট ভরাতে পাঁচ টাকা নিয়েই চলে যান ঝালমুড়িওয়ালা মামার কাছে। পেট একটু অল্প ভরলেও, মন ভরবে ভরপুর!
ভর্তার সাথে চিতই কিংবা চাপড়ি পিঠা, বাংলার পথেঘাটে সহজলভ্য আরেক ভালোবাসার নাম। শুরুটা হয়েছিলো শীতকালের পিঠা সংস্কৃতি থেকেই। শীতের হিম ছড়ানো সন্ধ্যায় ভাপা পিঠার সাথে চিতই পিঠার পসরা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় দোকান বসতো। সেই থেকে চিতই পিঠা বাইরের খাবারের তালিকায় থেকে গেলো বারোমাসি নমুনা হয়ে। এখন বছরের যেকোনো সময় রাস্তায় দেখা মিলবে এই পিঠার। তার সাথে থাকে হরেক পদের ঝাল ঝাল ভর্তা। সরিষা ভর্তা, কালোজিরা ভর্তা, রসুন ভর্তা, মরিচের কয়েক রকম ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, পুঁদিনা কিংবা ধনেপাতার ভর্তা; একটি পিঠা অথবা চাপড়ির সাথেই চেখে দেখতে পারেন সব কয়টি ভর্তা। দোকান বলতে পিঠা রাখার একটুখানি জায়গা, আর চুলো। ভ্যানগাড়িতেও বিক্রি হয় অবশ্য এই পিঠা। চালের গুঁড়ো আগে গুলিয়ে নিতে হয় কুসুম গরম পানিতে, তারপর বিশেষ এক রকম মাটির হাঁড়ি যাকে খোলা বলে, তাতে গোলাকারে ছড়িয়ে দেয়া হয় মিশ্রণটি। কিছু সময় ঢেকে রাখতে হয়, তবেই তৈরি হয় এই বিশেষ পিঠা। রাস্তার দোকানে অবশ্য এতো আয়োজন সম্ভব হয় না, বিক্রেতারা তাই নিজের সুবিধা মত বানিয়ে থাকেন চিতই পিঠা। লোহার কড়াই ব্যবহার করা হয়, মিশ্রণ গোলানোর পানিটা আবার ঠাণ্ডাই রয়ে যায় কোথাও কোথাও। তাতে পিঠার স্বাদে তারতম্য এলেও, এর জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ে না তেমন। চাপড়ি জিনিসটায় আটা কিংবা ময়দার ব্যবহার চলে চালের গুঁড়োর পাশাপাশি। চিতইয়ের মতো খুব যত্ন না নিলেও হয় তার। তাওয়াতে অবহেলা করেও বানিয়ে নেওয়া যায় দিব্যি। স্বাদের বেলায় কম নয় সেও। ভর্তার সাথে তার মেলবন্ধন মুগ্ধ করতে পারে যেকোনো ভোজনরসিক মানুষকে।
এসব খাবারের সামনে হাজারটা নিষেধাজ্ঞা থাকুক, থাকুক অসুখ কিংবা মায়ের বকুনির ভয়, এদের হাতছানি উপেক্ষা করাটা যে এক প্রকার অসম্ভব কাজ, তা আপনাকে মানতেই হবে! মানুষের ভালোলাগার সাথে মিশে থাকা এসব খাবার প্রতিনিধিত্ব করে এই দেশের সংস্কৃতিরও। রাস্তায় ঘুরে সস্তায় খাওয়া যায় এমন খাবারগুলো তাই টিকে থাকুক চিরকাল।