ভোজনরসিক মানুষের কাছে যে খাবারের নামটি আকর্ষণের শীর্ষে থাকে, সেটা হলো বিরিয়ানি। আর এ দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছেই বিরিয়ানি হলো সবচেয়ে প্রিয় ও সুস্বাদুতম খাবার। ভারতীয় উপমহাদেশে বিরিয়ানি ব্যাপক প্রসার ও আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা লাভ করে মূলত মোঘল সম্রাটদের শাসনামলে। আসুন জেনে নিই বিরিয়ানির জগতের সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয় বিভিন্ন দেশের চারটি বিরিয়ানি সম্পর্কে ও সেগুলোর রেসিপি।
কাচ্চি বিরিয়ানি
বাংলাদেশের বিখ্যাত সব খাবারের তালিকায় প্রথমেই যে খাবারের নাম আসে, সেটি হলো ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি। দেশে ও বিদেশে এর স্বাদ মন জয় করেনি, এমন মানুষ দুর্লভ। ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি জনপ্রিয় হয় বিখ্যাত বাবুর্চি ফখরুদ্দীনের হাত ধরে। চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা ফখরুদ্দীন ভাগ্যের খোঁজে ভারতের পাটনা থেকে ঢাকায় এসে ভিকারুন্নেসা স্কুলে নৈশপ্রহরীর কাজে যোগদান করেন। নবাবদের মুসলিম বাবুর্চির কাছ থেকে রান্নার কাজ শিখে আসা ফখরুদ্দীন স্কুলের সামনে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করা শুরু করেন কাচ্চি বিরিয়ানি। সেই বিরিয়ানি ঢাকাবাসীর মন জয় করে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে হালের বিখ্যাত কাচ্চি বিরিয়ানি। নিচে দেওয়া হলো ঢাকার বিখ্যাত কাচ্চি বিরিয়ানির রেসিপি (পরিমাণ সহ),
প্রথমেই এক কাপ পেঁয়াজ বেরেস্তা করে নিতে হবে। এক কেজি খাসির মাংস ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিয়ে তাতে অর্ধেক কাপ তেল, আগের করে রাখা বেরেস্তা, টক দই এক কাপ, রসুন বাটা দুই টেবিল চামচ, আদা বাটা দেড় টেবিল চামচ, শুকনা মরিচের গুঁড়া দুই চা চামচ, হলুদের গুঁড়া এক চা চামচ, জয়ফল বাটা এক চা চামচ, গরম মসলার গুঁড়া এক টেবিল চামচ, জয়ত্রী খুব সামান্য, লবণ স্বাদ অনুযায়ী দিয়ে খুব ভালো করে মাখাতে হবে। মাখানো মাংস দুই ঘণ্টা ঢেকে রেখে দিতে হবে। এবার আধা কেজি পোলাওয়ের চাল খুব ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনমতো আটা পানিতে মাখিয়ে খামির তৈরি করে নিতে হবে। আধা কেজি মাঝারি আকারের আলু ধুয়ে, ছিলে খুব সামান্য জাফরানি রঙ মাখিয়ে নিতে হবে। ফুটন্ত পানিতে ধুয়ে রাখা চালগুলো দিয়ে তাতে এক চা চামচ শাহী জিরা দিতে হবে।
চালগুলো আধা সিদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার একটা পাত্রে এক চা চামচ ঘি দিয়ে তাতে মাখিয়ে রাখা আলুগুলো ভেজে নিতে হবে। মাখিয়ে রাখা মাংসগুলো একটা পাত্রে নিয়ে তার ওপর আলুগুলো সাজিয়ে নিয়ে, আধা সিদ্ধ করা চালগুলো তার ওপর সাজিয়ে তাতে কেওড়ার জল এক টেবিল চামচ, গোলাপ জল এক টেবিল চামচ ছড়িয়ে দিতে হবে। সাত/আটটা আলুবোখারা চালের ওপর ছড়িয়ে দিতে হবে। লবণ স্বাদ অনুযায়ী, দুই টেবিল চামচ ঘি ও সবশেষে এক কাপ দুধ দিয়ে দিতে হবে। এবার মাখিয়ে রাখা আটা দিয়ে পাত্রের মুখে লাগিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে দিতে হবে। গরম তাওয়ার উপরে বিরিয়ানির পাত্রটি বসিয়ে ভারি কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে পূর্ণ জ্বালে দশ মিনিট রান্না করে, আঁচ কমিয়ে চল্লিশ মিনিট রান্না করলেই হয়ে যাবে স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কাচ্চি বিরিয়ানি!
হায়দ্রাবাদি দম বিরিয়ানি
বলা হয়ে থাকে, হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি নিজাম বংশীয় মুসলিম নবাবদের রান্নাঘর থেকে এসেছে। ভারতীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের রান্নার এক অপূর্ব মিশ্রণে সৃষ্টি এই বিরিয়ানি। আজ ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে এর জয়জয়কার। ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি ও হায়দ্রাবাদি দম বিরিয়ানির প্রস্তুত প্রণালি অনেকটা একই রকম হলেও পার্থক্য থাকে মসলার উপকরণে। বিশেষ করে মাংসে ব্যবহৃত মসলা ও চালে ব্যবহৃত মসলা কাচ্চি থেকে অনেকটাই আলাদা।
হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানির মাংস প্রস্তুত প্রণালি এরূপ-
৬০০ গ্রাম খাসির মাংস ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে তাতে এক টেবিল চামচ কাঁচা পেঁপে বাটা, দেড় টেবিল চামচ রসুন বাটা, তিন চা চামচ শুকনো মরিচের গুঁড়া, এক চা চামচ হলুদের গুঁড়া, দুই টেবিল চামচ বিরিয়ানি মসলা, লবণ স্বাদ অনুযায়ী, চার/পাঁচটা লবঙ্গ, পাঁচ/ছয়টা এলাচ, এক কাপ টক দই, এক চা চামচ শাহী জিরা, তিন টেবিল চামচ কুচি করে কাটা ধনিয়াপাতা, চারটি কাঁচা মরিচ, আট/দশটি পুদিনাপাতা, পেঁয়াজ বেরেস্তা এক কাপ, তিন টেবিল চামচ তেল, এক টেবিল চামচ লেবুর রস ও আদা কুচি এক চা চামচ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে নিতে হবে। মাখানো মাংস দুই থেকে তিন ঘণ্টা ঢেকে রাখতে হবে। অন্যদিকে চালগুলো প্রস্তুত করতে হবে এভাবে- ৫০০ গ্রাম বাসমতি চাল ভালো করে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে কিছুক্ষণ। এবার পাত্রের গরম পানিতে চার/পাঁচটা সবুজ এলাচ, দারচিনি, তিন/চারটা লবঙ্গ, একটা তেজপাতা ও লবণ স্বাদ অনুযায়ী দিয়ে তাতে ভিজিয়ে রাখা চালগুলো দিতে হবে। মিনিট পাঁচেক রান্নার পর চালগুলো পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার একটি পাত্রে মাখিয়ে রাখা মাংস নিয়ে তার ওপর চালগুলো দিয়ে তাতে কেওড়ার জল আধা টেবিল চামচ, গোলাপজল আধা টেবিল চামচ, দুধে ভিজিয়ে রাখা জাফরান ছড়িয়ে দিতে হবে। এখন কাচ্চি বিরিয়ানির মতো করে মাখিয়ে রাখা আটা দিয়ে পাত্রের মুখে লাগিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে, গরম তাওয়ার উপর বিরিয়ানির পাত্রটি বসিয়ে ভারি কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে অথবা সরাসরি চুলাতেই ৪০ মিনিট রান্না করলেই তৈরী হয়ে যাবে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি।
অ্যারাবিয়ান কাবসা
অ্যারাবিয়ান কাবসা মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর প্রধান খাবার। প্রচুর বাদাম ও শরবতের সাথে পরিবেশিত ভাত ও মাংসের মিশ্রণের এই খাবারটির উৎপত্তি হয় ইয়েমেনে।
প্রথমে দুই কেজি মুরগির মাংস দুই বা চারভাগ করে কেটে, ভালো করে ধুয়ে নিয়ে তাতে এক চা চামচ লবণ, এক চা চামচ খাবার রঙ (কমলা), এক চা চামচ রসুন বাটা, এক চা চামচ কাঁচামরিচ বাটা, চার টেবিল চামচ টক দই দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে রেখে দিতে হবে। গুঁড়া মসলা তৈরির জন্য চারটা সবুজ এলাচ, চার/পাঁচটা লবঙ্গ, দারচিনি ও তারা মসলা দিয়ে ভালো করে গুঁড়া করে রাখতে হবে। এবার একটা পাত্রে আধা কাপ তেল দিয়ে তাতে দুই টেবিল চামচ পেঁয়াজ কুচি, এক চা চামচ রসুন বাটা, এক চা চামচ আদা বাটা, চার টেবিল চামচ টমেটো বাটা, এক চা চামচ গরম মসলা, এক চা চামচ ধনিয়া গুঁড়া, এক চা চামচ জিরা গুঁড়া, এক চা চামচ মুরগির মসলা ও দুই টেবিল চামচ সাদা গোল মরিচের গুঁড়া দিয়ে তাতে অল্প একটু পানি দিয়ে মসলা কষিয়ে নিতে হবে। এবার আগে থেকে তৈরি করা মসলা গুঁড়া দিয়ে তাতে মাখিয়ে রাখা মুরগির মাংস দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। মাংস ভালোভাবে কষিয়ে গেলে তাতে তিন কাপ পানি দিয়ে, এক চা চামচ লেবুর খোসা কুঁচি ছড়িয়ে দিয়ে আবার ঢাকনা দিয়ে দশ মিনিটের জন্য ঢেকে রাখতে হবে।
অন্যদিকে ৫০০ গ্রাম বাসমতি চাল ভালো করে ধুয়ে ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে। দশ মিনিট পর ঢাকনা খুলে মাংস তুলে অন্য একটি পাত্রের রেখে দিয়ে পাত্রের বাকি মসলার পানিতে আগের ভিজিয়ে রাখা চালগুলো ও স্বাদ অনুযায়ী লবণ দিয়ে আবার দশ/পনেরো মিনিটের জন্য ঢাকনা লাগিয়ে দিতে হবে। সবশেষে মাংস ভাতের ওপর দিয়ে ঢাকনা লাগিয়ে দমে রেখে দিতে হবে। অ্যারাবিয়ান কাবসা পরিবেশন করার জন্য কাজু ও পেস্তা বাদাম ভেজে নিতে হবে। পাঁচ মিনিট পর ঢাকনা খুলে প্রচুর বাদাম ও কিসমিস ওপরে ছড়িয়ে দিলেই তৈরী হয়ে যাবে সুস্বাদু অ্যারাবিয়ান কাবসা।
সিন্ধি বিরিয়ানি
পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ থেকে উদ্ভুত এই বিরিয়ানি নিজের ব্যাপক জনপ্রিয়তায় এখন হয়ে উঠেছে পাকিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশের অন্যতম প্রধান খাবার। পাকিস্তানের প্রায় সকল আন্তর্জাতিক বিমানে যাত্রীদের জন্য এই বিরিয়ানি পরিবেশন করা হয়।
প্রথমে এক কেজি মুরগীর মাংস ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। এবার মাঝারি আকারের দুইটা আলু ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে আধা সিদ্ধ করে রেখে দিতে হবে। একটা পাত্রে এক কাপ ঘি দিয়ে তাতে চার টেবিল চামচ পেঁয়াজ কুচি দিয়ে ভালো করে ভেজে নিয়ে, এক টেবিল চামচ রসুন বাঁটা, এক টেবিল চামচ আদা বাটা, আস্ত গরম মসলা (চারটা এলাচ, এক চা চামচ শাহী জিরা, এক চা চামচ গোল মরিচ, পাঁচ/ছয়টা লবঙ্গ, দু’টি তারা মসলা, দুইটা সাদা এলাচ) এক চা চামচ হলুদ গুঁড়া, স্বাদ অনুযায়ী লবণ, দুই চা চামচ শুকনো মরিচের গুঁড়া ও মাংসগুলো দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিয়ে তাতে আগে থেকে আধা সিদ্ধ করে রাখা আলুগুলো, টকদই ও পানি দিয়ে পনেরো মিনিটের জন্য ঢেকে দিতে হবে।
অন্যদিকে, ৫০০ গ্রাম বাসমতি চাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে এক ঘণ্টার জন্য। আলাদা একটি পাত্রে পানি গরম করতে দিয়ে তাতে এক চা চামচ লবণ দিয়ে চালগুলো সিদ্ধ হতে দিতে হবে, চালগুলো সিদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে। পনের মিনিট পর তিনটা আলুবোখারা, চার টেবিল চামচ কুচি করে কাটা টমেটো, চার টুকরো গোল করে কাটা লেবু, দুই টেবিল চামচ পুদিনা পাতা কুঁচি ও দশ/বারোটা কাঁচা মরিচ দিয়ে তার ওপর আধা সিদ্ধ চালগুলো দিয়ে এক চা চামচ খাবারের রঙ উপরে ছড়িয়ে দিয়ে পাঁচ মিনিট পূর্ণ জ্বালে ও ত্রিশ মিনিট আঁচ কমিয়ে রান্না করলেই তৈরী হয়ে যাবে মজাদার সিন্ধি বিরিয়ানি।
উল্লেখ্য, এই বিরিয়ানিগুলোর রেসিপি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে চারজন খাবারের পরিমাণ অনুযায়ী। তাহলে এবার উপভোগ করুন আপনার বিরিয়ানি!