বর্তমানকালের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খাবারের নাম ‘স্যুপ’। অতি প্রাচীনকাল থেকেই, যখন থেকে মানুষ আগুনকে রান্নার কাজে ব্যবহার করা শুরু করলো, সম্ভবত তখন থেকেই নানান পদের ‘স্যুপ’ জাতীয় খাবার পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের খাদ্যতালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
তবে আধুনিক যুগে স্যুপের যে জনপ্রিয়তা, তার পেছনে ফরাসিদের অবদান উল্লেখযোগ্য। অষ্টাদশ শতকে ফরাসিরা স্যুপকে একটি বিশেষায়িত ও অভিজাত খাবার হিসেবে বিশ্বদরবারে নতুন করে উপস্থাপন করে। এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী স্যুপের জনপ্রিয়তা কখনো কমেনি, বরং প্রতিনিয়তই তা বেড়ে চলছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানান প্রকার স্যুপের দেখা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ইউরোপ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের বিশেষ কিছু স্যুপ বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
সাধারণত বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি, ফলমূল, গবাদি পশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মাংস-হাড়গোড় কিংবা এসবেরই সংমিশ্রণকে উপযুক্ত মসলা ও প্রয়োজনীয় উপকরণসহ সিদ্ধ করে স্যুপ তৈরি করা হয়। অনেকেই স্যুপকে শুধুমাত্র একটি সুস্বাদু খাবার হিসেবেই চিনে থাকেন। তবে স্বাদের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার স্যুপের যে কিছু স্বাস্থ্যকর দিকও রয়েছে, তা অনেকেরই অজানা। স্যুপ তৈরির ক্ষেত্রে এর স্বাদকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও প্রাচীনকাল থেকেই স্যুপকে ছোটখাট বিভিন্ন রোগের পথ্য হিসেবে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। আবার, স্যুপ যে একটি উপাদেয় খাবার- এ ধারণাও অনেক পুরোনো। আজ আমরা এরকম কয়েকটি ধারণা পর্যালোচনা করবো এবং জানবো স্যুপের কিছু স্বাস্থ্যগত উপকারীতার কথা।
স্যুপ শরীরকে সতেজ রাখে
বিশেষ করে শীতের মৌসুমে, একটুখানি গরম স্যুপ আমাদেরকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে। এটা সকলেরই জানা যে, সুস্বাস্থ্যই মানসিক সুখের উৎস; শরীর সতেজ থাকলে মনও ফুরফুরে থাকে। এখানে চা ও কফির সাথে স্যুপের বিশেষ পার্থক্য হলো, স্যুপ সতেজকারক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আমাদের শরীরের জন্য অতিরিক্ত কিছু পুষ্টিও জোগায়, যা শুধু সাময়িকভাবেই নয়, বরং দীর্ঘ মেয়াদেও আমাদেরকে সুস্থ ও সজীব রাখতে ভূমিকা পালন করে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বালাইনাশক হিসেবে স্যুপ
পৃথিবীর অনেক দেশে প্রাচীনকাল থেকেই ঠান্ডা, সর্দি-কাশি, কফ ইত্যাদি ছোটখাট অসুখ উপশমের জন্য রোগীকে মুরগীর স্যুপ খাওয়ানো হয়। আমাদের দেশেও জ্বরসহ বিভিন্ন রোগ-বালাই থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাওয়ার আশায় অন্যান্য সেবার পাশাপাশি রোগীকে মুরগী বা কবুতরের স্যুপ খাওয়ানোর কথা শোনা যায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে কী বলেন? এ ধরনের স্যুপ ঠিক কতটা কার্যকরী?
সত্যি কথা বলতে, গবেষকরা এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র মুরগীর স্যুপে এমন কোনো উপাদান আলাদাভাবে শনাক্ত করতে পারেননি, যা কি না রোগ প্রতিরোধে সরাসরি কাজ করে। তবে এটা মনে করা হয় যে, মুরগীর স্যুপ তৈরি করার সময় এর সাথে যেসব সবজি বা মশলা ব্যবহার করা হয়, সেগুলোতে থাকা মিনারেল ও ভাইটামিনের সাথে মুরগীর পুষ্টি উপাদানগুলো সমন্বিতভাবে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিশ্চিতভাবেই কিছুটা শক্তিশালী করে তোলে, যা পরীক্ষিত। আবার, কিছু রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, গরম স্যুপের নির্যাস ও ঘ্রাণ নাসারন্ধ্রকে এবং গরম স্যুপ নিজেই শ্বাসনালীকে পরিষ্কার করে তুলতে ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে এ বিষয়টাকে কুসংস্কার বা মিথ হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
স্যুপের পুষ্টিগুণ
বিভিন্ন প্রকার স্যুপে কম-বেশি পুষ্টিগুণ বিদ্যমান। বিশেষ করে যেসব স্যুপ শাক-সবজি বা ফলমূলভিত্তিক হয়ে থাকে, সেগুলোর স্বাস্থ্যগত উপকারিতার জন্য পুষ্টিবিদেরাও সেসব স্যুপ খেতে উৎসাহিত করে থাকেন; বিশেষ করে ডায়েটের জন্য। পানিতে সিদ্ধ করা হয় বলে ফল-মূল ও শাক-সবজির পুষ্টি উপাদানগুলো পানিতে মিশে যায় এবং সেগুলো সহজেই গ্রহণ-উপযোগী হয়। কিছু কিছু খাবার আছে, যেগুলো রান্না করা হলে পুষ্টিগুণ নষ্ট হয় বা কমে যায়। কিন্তু স্যুপের ক্ষেত্রে এমনটা হয় না।
স্যুপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপকারিতা হলো, এতে ব্যবহৃত খাদ্য উপাদানগুলোর আঁশ অক্ষত থাকে, যা পাকস্থলীর স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি।
এছাড়া, গবাদি পশুর অস্থি থেকে তৈরি স্যুপেরও বহুবিধ পুষ্টিগুণ আছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। তবে এগুলোর সত্যতা যাচাই করার জন্য আরো বহু গবেষণার দরকার।
স্যুপের আরেকটি উপকারী দিক হলো, এতে পানির পরিমাণ বেশি বলে এটি দৈনিক দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পানির অধিকাংশই জোগান দিতে পারে। ফলে আলাদাভাবে খুব বেশি পানি পান করতে না পারলেও ডিহাইড্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
খাদ্যে বৈচিত্র ও হজমে সহায়ক
আমাদের আশেপাশে কিংবা আমাদের নিজের পরিবারেই খুঁজলে এমন কাউকে পাওয়া যাবে যিনি প্রায়শই বলতে থাকেন, “এটা খাবো, কিন্তু ওটা খাবো না। এইটা ভালো, কিন্তু ওইটা সুস্বাদু না।”
খাবার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যারা এতশত বাছ-বিচার করে থাকেন, তাদের জন্য খুব ভালো একটা সমাধান হতে পারে স্যুপ। বিশেষ করে শিশুদের জন্য বিষয়টা অনেক উপকারি হতে পারে। বেশিরভাগ শিশুই খাদ্যের বিষয়ে খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়ে থাকে। কিন্তু বাবা-মায়েরা সবসময় চিন্তায় থাকেন যে, সব ধরনের সম্পূরক খাবার না খেলে তাদের শিশুটি হয়তো পুষ্টিহীনতায় ভূগবে। এক্ষেত্রে স্যুপের বিকল্প সমাধান খুব কমই আছে। কেননা, সম্ভাব্য প্রায় সকল প্রকার খাবারেরই স্যুপ বানানো যায় এবং কোনো একটা নির্দিষ্ট খাবারের স্যুপ সে খাবারের বিকল্প হিসেবে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। উদাহরণ হিসেব বলা যায়, যে শিশুটি ফুলকপি একদমই পছন্দ করে না, তার প্রিয় কোনো স্যুপ বানানোর সময় এর সাথে কুচিকুচি করে কেটে ফুলকপি যোগ করা যেতে পারে। আবার একই খাবারের স্যুপ অনেকভাবে বানানো যায়। যে উপাদেয় খাবারটা রান্না করা অবস্থায় কেউ পছন্দ করছে না, উপযুক্ত রেসিপি ব্যবহার করে সেই খাবারের স্যুপ তৈরি করা হলে তা হয়তো সবার কাছেই সুস্বাদু লাগতে পারে।
শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি– যারা হজম সংক্রান্ত সমস্যায় ভুগছেন কিংবা বিশেষ কিছু খাবার হজম করতে সমস্যা হয়, তাদের সমস্যার সমাধানও হতে পারে স্যুপ। যেসব খাবারে জটিল খাদ্য উপাদান বিদ্যমান সেগুলোকে অধিক সময় ধরে পানিতে সিদ্ধ করার ফলে এরা সাধারণত তুলনামূলক সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত হয়, যা প্রায় সকলের জন্যই সহজপাচ্য হয়ে উঠে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা খানিক মাত্রায় পূরণ করতে পারে।
ডায়েট হিসেবে স্যুপ
সাম্প্রতিককালে ডায়েট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ওজন কমানোর জন্য স্যুপ একটি জনপ্রিয় ও কার্যকর মেন্যু হিসেবে খাদ্যতালিকার উপরের দিকে উঠে এসেছে। বিকল্প ডায়েট হিসেবে স্যুপ যে অত্যন্ত ভালো একটি অপশন, তা পুষ্টিবিদ ও ডায়েটিশিয়ানরাও স্বীকার করেন। ডায়েট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ওজন কমানো বা আদর্শ ডায়েটের মূলনীতি হলো- পরিমাণে পর্যাপ্ত কিন্তু তুলনামূলক কম ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতে হবে এবং খাবারের পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে হবে। স্যুপ এ চাহিদাগুলো পূরণে সক্ষম।
যেকোনো স্যুপের সিংহভাগই থাকে পানি। এই পানি কোনো ক্যালরি সরবরাহ করে না। ফলে স্যুপ খেলে পেট ভরে যায় ঠিকই, কিন্তু কম ক্যালরি গ্রহণ করা হয়। আবার খাবারের পুষ্টি উপাদানও বিনষ্ট হয় না। ফলে ভালো ডায়েটের জন্য স্যুপ একটি উৎকৃষ্ট অপশন। এছাড়াও ওজন কমানোর ক্ষেত্রে স্যুপ আরও দুভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। এক, কোনো এক বেলার খাবার শুরু করার আগে অল্প স্যুপ গ্রহণ করলে ক্ষুধা ও খাবারের চাহিদা খানিকটা কমে যায়, ফলে এমনিতেই কম খাবার তথা কম ক্যালরি গ্রহণ করা হয়। দুই, স্যুপে খাদ্য উপাদানগুলো পানির সাথে মিশ্রিত হয়ে থাকে বলে তা হজম করতে পাকস্থলীর বেশি সময় লাগে। ফলে অনেকক্ষণ পর পর ক্ষুধা লাগে এবং স্বাভাবিকভাবেই ক্যালরি গ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। এভাবে স্যুপ স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করতে পারে।
অপচয় রোধ ও সাশ্রয়
এর আগেই বলা হয়েছে, প্রায় সকল প্রকার খাবারেরই স্যুপ বানানো যায়। কোন খাবারটা থেকে স্যুপ বানানো যাবে, আর কোনটা থেকে বানানো যাবে না- তার কোনো নির্দিষ্ট তালিকা নেই; এখানে রাঁধুনীর উদ্ভাবনী চিন্তাধারাই মুখ্য ও একমাত্র নির্ধারক। আমরা যেকোনো শাক-সবজি অথবা গবাদি পশুর নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রান্না করার জন্য বাছাই ও আলাদা করার পর সাধারণত বাকি অংশগুলো ফেলে দিই। ফেলে দেওয়া অংশের মধ্যে কিছু আছে যা প্রচলিত রান্নাবান্নায় ঠিক ব্যাবহারও করা যায় না, আবার পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ, তাই ফেলে দিতেও কুণ্ঠাবোধ হয়। কিন্তু সে অংশগুলো দিয়ে স্যুপ তৈরি করলে অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই খাবার টেবিলে নতুন একটি পদ যুক্ত করা যাবে। এভাবে সাশ্রয়ীভাবে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি খাবারের অপচয়ও রোধ করা যাবে। আবার স্যুপ বানানোর সময় যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়, স্যুপ তৈরি হওয়ার পর স্যুপ থেকে সেগুলো আলাদা করে কোনো তরকারিতেও ব্যবহার করা সম্ভব।
অন্যান্য খাবারের সাথে স্যুপের একটি পার্থক্য হলো, রান্না করা খাবারগুলো সাধারণ যেদিন রান্না করা হয়, তার পরের দিনই খাওয়ার উওযুক্ত থাকে না, কিংবা স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু স্যুপের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটা ঘটে; চাইলে বেশ কয়েকদিনের জন্য স্যুপ সংরক্ষণ করে রাখা যায় এবং পুনরায় গরম করার ফলে স্যুপের স্বাদও বেড়ে যায়। ফলে একই স্যুপ বেশ কয়েকবার পরিবেশন করা যায়।