খাদ্যাভ্যাসের ছোট্ট যে পরিবর্তনগুলো নিশ্চিত করতে পারে আপনার সুস্থতা

অর্থ, প্রকৃতি, জীবনের সৌন্দর্য- সবটাই উপভোগ্য হয়ে ওঠে শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত হলে। শারীরিক সুস্থতার উপর মানসিক সুস্থতাও নির্ভরশীল। আর আমাদের এই সামগ্রিক সুস্থতাকেই অনেকাংশে প্রভাবিত করে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস। খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন খুব সহজেই আমাদের সুস্থতা বা অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। আপনার প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসেও কি অজান্তেই কোনো ভুল বা কমতি থেকে যাচ্ছে? জানতে পড়ে নিন এই লেখাটি।

১) পরিশোধিত খাদ্যশস্য বা রিফাইন্ড গ্রেইনে তৈরি রুটির বদলে হোল গ্রেইন ব্রেড গ্রহণ

হোল গ্রেইনে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকায় কোলনের স্বাস্থ্য, কোলেস্টরল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে তা সহায়তা করে; Photo Source: Openfit

 

হোল গ্রেইন বা রিফাইন্ড গ্রেইন, যে আটার রুটিই খান না কেন, পার্থক্য রুটিতে নয়, থাকে শস্যের দানায়। হোল গ্রেইনে যে উপকারী অনুজীবগুলো থাকে, তা পরিশোধিত গ্রেইনে থাকে না। ফলে হোল গ্রেইন খাওয়ার ফলে সেটি যেভাবে আপনার হজম প্রক্রিয়া, সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক করে তোলে রিফাইন্ড গ্রেইন তা করে না। ফলে পরিশোধিত আটার রুটি যারা খান, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে তুলনামূলকভাবে বেশি। একইসাথে, হোল গ্রেইনে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকায় কোলনের স্বাস্থ্য, কোলেস্টরল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণেও তা সহায়তা করে।

২) প্রচুর পরিমাণ পানি পান

সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার অনেকটা জুড়েই থাকে পর্যাপ্ত পানি পান। পানি আপনার শরীরকে খাবার হজম করতে, এবং খাবারের পুষ্টিগুণ যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। এছাড়া, পর্যাপ্ত পানি পান করে ক্ষুধাভাবও নিবারণ করা সম্ভব হয়। পানি পান করলে পাকস্থলীর আয়তন বৃদ্ধি পায় এবং মস্তিষ্ক পেট ভর্তি আছে এমন সংকেত পায়। তাই অতিরিক্ত খাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয় না।

২০১৬ সালে পরিচালিত এক নিরীক্ষায় জানা যায়, খাবার খাওয়ার আগে যারা এক গ্লাস পানি পান করেন তারা বাকিদের তুলনায় সাধারণত ২২ শতাংশ কম খাবার খান। পর্যাপ্ত পানি পান করতে তাই খাবারের আগে এক গ্লাস পানি পান করুন, মৌসুমী ফলের রস ও পানি আছে এমন ফল বেশি খান। কোলা বা সোডার মতো অস্বাস্থ্যকর পানীয়ের বদলে পানি পান করুন, এবং সবসময় সাথে একটি পানির বোতল রাখুন।

৩) স্বাস্থ্যকর নাশতা গ্রহণ

গবেষণানুসারে, একসাথে অনেকটা খাবার খাওয়া বা নাশতা হিসেবে খানিক বিরতি নিয়ে খাবার খাওয়া- আপনি যেটাই করুন না কেন, তাতে আপনার শরীরের ক্যালরির উপরে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে আপনি ঠিক কেমন নাশতা বেছে নিচ্ছেন নিজের জন্য সেটা বোঝা খুব প্রয়োজনীয়। প্রাপ্তবয়স্কদের খাবারের মোট ক্যালরির শতকরা ২৪ শতাংশই আসে অস্বাস্থ্যকর নাশতার মাধ্যমে। তাই সাথে সবসময় দই, ফল, সালাদ, হোল গ্রেইন টোস্ট, ডিম সিদ্ধ ইত্যাদি রাখুন। এতে খুব দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে আপনার শরীরে।

৪) বেশি পরিমাণে প্রোটিন বা আমিষ খাওয়া

প্রোটিন অন্য যেকোনো খাদ্য উপাদানের চেয়ে বেশি সময় পাকস্থলী ভরিয়ে রাখতে সাহায্য করে; Photo Source: Harvard

 

আমাদের শরীরে প্রায় ১০,০০০টি ভিন্ন ভিন্ন প্রোটিন রয়েছে। আপনার শরীরের শক্তির উৎস, সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য কাজ করে এই প্রোটিন। আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষেই আছে প্রোটিন। এদের মধ্যে অ্যামিনো এসিডই আমাদেরকে প্রতিদিনের কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে। শুধু তা-ই নয়, প্রোটিন অন্য যেকোনো খাদ্য উপাদানের চেয়ে বেশি সময় পাকস্থলী ভরিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সকালে প্রোটিন গ্রহণ করলে অপ্রয়োজনীয় ক্যালোরির প্রতি শরীরের চাহিদা কমে যায়। খাদ্যতালিকায় তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রোটিন রাখতে সকালের নাশতায় ডিম খান, সাথে বিভিন্ন নাশতায় দই, হোল গ্রেইন, বিন, বাদাম, মাছ ইত্যাদি রাখতেই পারেন।

৫) খাবার সাজানোর মালমশলায় বাড়তি নজর প্রদান

অনেক সময় খুব স্বাস্থ্যকর একটি খাবারও অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে সেটা সাজানোর জন্য ব্যবহৃত ড্রেসিং ও অন্যান্য উপাদানের মাধ্যমে। তাই পরবর্তীতে খাবারে কোনো ড্রেসিং ব্যবহার করলে তার খাদ্যমান সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন। প্রতিবেলার খাবারে ড্রেসিং যা ব্যবহার করতেন তার অর্ধেক ব্যবহার করুন। স্বাস্থ্যকর তেল ব্যবহার করুন খাবারে, এবং মেয়োনেজ, চিনি ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।

৬) বেশি পরিমাণে ফল ও সবজি গ্রহণ

আপনার প্রতিদিনের সুস্থতাকে অনেক বেশি বাড়িয়ে তুলতে খাদ্যাভ্যাসে অত্যন্ত একটি কার্যকরী পরিবর্তন হতে পারে বেশি পরিমাণে ফল ও সবজি খাওয়া। পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি দশজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মধ্যে মাত্র একজন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল ও সবজি খান। উল্লেখ্য, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে দিনে দেড় থেকে দুই কাপ ফল ও ২-৩ কাপ সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ফল ও সবজিতে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও পুষ্টিকর উপাদান সহজেই পাওয়া যায়। এই দুটি খাদ্যোপাদানে সোডিয়াম ও কোলেস্টেরলের পরিমাণও অনেক কম থাকে। তাই সুস্থতা বজায় রাখতে দিনের খাবারের অর্ধেকটায় ফল ও সবজি রাখুন, এবং অস্বাস্থ্যকর ভাজাপোড়া নাশতার বদলে ফল খান। রাখতে পারেন ভেজিটেবল স্যুপ, সালাদ আর ফলের স্মুদিও।

ফল ও সবজিতে আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও পুষ্টিকর উপাদান সহজেই পাওয়া যায়; Photo Source: Harvard

৭) প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা

সহজপ্রাপ্য, মজাদার ও সাশ্রয়ী হওয়ায় আমরা অনেকেই প্রতিবেলার খাবারে বেছে নিই প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন খাবার, যেমন- ক্যানড মাংস, চিংড়ি ইত্যাদি। এসব খাবারের বদলে খাদ্যতালিকায় রাখুন তাজা ফল ও সবজি, বাদাম ও সামুদ্রিক মাছ। এতে প্রাকৃতিক উপাদান গ্রহণের মাধ্যমে শরীর সুস্থ থাকবে।

৮) লো-ফ্যাট ডেইরি পণ্য গ্রহণ

আপনি যদি স্মুদি বা ডেইরি পণ্যের উপরে খুব বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল হন, তাহলে এই একটি উপাদান গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই আপনার স্বাস্থ্যে অনেকটা পরিবর্তন এনে দেবে। না, আপনাকে একেবারে ডেইরি পণ্য খাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে না। তবে আপনি যদি সাধারণ ডেইরি পণ্যের বদলে লো-ফ্যাট ডেইরি পণ্য বেছে নেন, সেক্ষেত্রে প্রতি কাপে ৪৭ ক্যালরি কমে আসবে। এছাড়াও দই আর চিজের মতো লো-ফ্যাট ডেইরি পণ্যও রাখতে পারেন খাবারে।

৯) মাংসের টুকরো পাতলা করে কাটা

খাবারে পাতলা করে কাটা মাংস রাখুন; Photo Source: bbq Champs Academy

 

প্রোটিনের উদ্ভিজ্জ উৎসের পাশাপাশি আপনি খাদ্যতালিকায় অবশ্যই মাংস রাখতে পারেন। তবে সেটা যেন পাতলা করে কাটা হয় তা খেয়াল রাখুন। আর মাংসের ক্ষেত্রে বেছে নিন চামড়া ছাড়া মুরগি, টার্কি, ডিম, সয়া ইত্যাদি।

১০) কার্ব বা শর্করা গ্রহণে সতর্ক হওয়া

কার্ব বা শর্করা সবসময় আমাদের শরীরের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। ফল ও সবজির মধ্যে থাকা শর্করা আমাদের জন্য ভালো। নাশতায় চিপসের বদলে একটা ফলের টুকরো, বড় স্যান্ডউইচের বদলে হোল গ্রেইন ব্রেড হতে পারে চমৎকার খাদ্যোপাদান। তাই শর্করা দিন শরীরকে, তবে সেটাও একটু বেছে বেছে। এতে করে আপনার শরীরে পরিবর্তন আসবে খুব দ্রুত।

খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন শরীরচর্চার বিকল্প না। তবে খাবার অভ্যাসে ছোট্ট পরিবর্তন শরীরচর্চার মতোই আমাদের মধ্যে মানসিক ও শারীরিকভাবে নানারকম পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। খাবার খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানি পান বা খাবারের শুরুটা ভেজিটেবল স্যুপ দিয়ে করাটা খুব কঠিন বিষয় নয়। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ইতিবাচক শুরুটা তাই এভাবে সহজ কিছু ধাপে কিন্তু করতেই পারেন!

This article is written on the fact that how simple chnages in our daily diet can bring positive changes in our health. References have been hyperlinked inside.

Featured Image: USC News

Related Articles

Exit mobile version