দুধের স্বাদ মাঝে মধ্যে ঘোলে মেটানো গেলেও মরিচই হয়তো একমাত্র জিনিস যার স্বাদ অন্য কিছু দিয়ে মেটানো যায় না। মরিচ ভাত বা গমের মতো জীবন বাঁচানো খাদ্য না বা এটা না খেলেও কারো কিছু আসে যায় না। তবে এই মরিচ খাবারে এমন স্বাদ নিয়ে আসে যা ভালোবাসেন না এমন মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না। তাই এই মরিচের উৎপত্তি নিয়েও কম বিবাদ হয়নি।
আমরা প্রতিদিন মরিচ খাই এবং জিনিসটা আমাদের কাছে খুবই সাধারণ। কিন্তু এই সাধারণ, সহজলভ্য জিনিসটার রয়েছে এক অসাধারণ ইতিহাস। আজ প্রত্যেক মানুষের রান্নাঘরে যে মরিচ পাওয়া যায় তা একসময় পুরো দেশে এমনকি পাঁচ মহাদেশের মাত্র এক মহাদেশে পাওয়া যেত। মজার বিষয় হচ্ছে বাকি পৃথিবীর প্রায় কেউই এটা সম্পর্কে জানতো না।
এশিয়া এবং ইউরোপের অনেক দেশই দাবি করে মরিচের উৎপত্তি তাদের দেশে। এক্ষেত্রে চীন আর ভারতের জনগণ সবার আগে। তবে মজার ব্যাপার হলো মরিচের উৎপত্তি এশিয়া-ইউরোপ দূরে থাক, আফ্রিকাতেও নয়। গবেষক আর ঐতিহাসিকগণ একমত যে, মরিচের উৎপত্তি সুদূর আমেরিকা মহাদেশে।
গ্রিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে ইউরোপিয়ান খাদ্যাভ্যাসে গোলমরিচ ছিল খাবারকে ঝাল স্বাদ দেওয়ার সবচেয়ে ভাল মশলা। সুগন্ধি এবং চিকিৎসাক্ষেত্রেও এর ব্যবহার হতো। আর এই গোলমরিচের প্রধান উৎপাদনস্থল ছিল এশিয়ার বিভিন্ন ট্রপিক্যাল দ্বীপ। সমুদ্রপথে এই গোলমরিচ এশিয়া থেকে আলেকজান্দ্রিয়া, ভেনিসের মতো বন্দর ঘুরে ইউরোপে ঢুকতো। মধ্যযুগে গোলমরিচের ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে এটি বিলাসদ্রব্যে পরিণত হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তখন তাদের নৌ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এশিয়া থেকে নিয়ে এসে ইউরোপে গোলমরিচের ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় তৎকালীন অটোম্যান সাম্রাজ্যের নৌ-আধিপত্যের কারণে। এশিয়া থেকে ইউরোপে আসার জলপথগুলো সবই অটোম্যান সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। যার ফলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে ইউরোপিয়ান বণিকরা বিকল্প জলপথ খুঁজতে থাকে।
১৪৯২ সালে ইতালীয় নাবিক এবং ঔপনিবেশিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন ভারত তথা পুরো এশিয়ায় যাওয়ার বিকল্প জলপথের সন্ধানে বের হন তখন তিনি নিজেও জানতেন না যে তার লক্ষ্যে তিনি না পৌঁছালেও এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবেন যেখানে পাওয়া ঝাল মশলা পুরো পৃথিবীর রন্ধন প্রণালী বদলে দেবে।
১৪৯২ সালে কলম্বাস এবং তার জাহাজের লোকেরা এশিয়ার বদলে পৌঁছে যান আমেরিকার ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে। মেক্সিকোতে তারা প্রথমবারের মতো দেখা পায় ক্যাপসিকামের যাকে আমরা বর্তমানে মরিচ বলে চিনি। তারা গোলমরিচকে Black Pepper বলতেন।
দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বুনো মরিচ জন্মাতো। এখান থেকেই সম্ভবত পাখির মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিম দিকে ছড়িয়ে পড়ে মরিচ গাছ। মানুষ বন থেকে ফল সংগ্রহের সময় প্রথম এই ঝাঁঝালো ফলের সন্ধান পায়। যদিও মরিচের সব প্রজাতি ঝাল না; যেমন: ক্যাপসিকাম। তবে যেগুলো ঝাল সেগুলো স্থানীয় আমেরিকানরা ব্যবহার করা শিখে ফেলে। শিকার করা মাছ আর বন্য প্রাণীর স্বাদ বাড়াতে আর পানীয় তৈরিতে মরিচের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় সাড়ে সাত হাজার বছর ধরে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে মরিচের ব্যবহার রয়েছে। প্রায় ৬,৫০০ বছর আগে থেকে মেক্সিকো এবং এর আশেপাশের অঞ্চলে মরিচ চাষ হয়ে আসছে। এমনকি এই মরিচ আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন চাষকৃত শস্যের একটি।
ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রির গবেষক লিন্ডা পেরি আন্দিজ, ভেনিজুয়েলা এবং ক্যারিবিয়ানে প্রাচীন আমেরিকার বিভিন্ন সভ্যতার ব্যবহার্য রান্নার সামগ্রী এবং মশলা পেষার পাথরে লেগে থাকা শস্যকণা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন যে, চাষকৃত মরিচ প্রায় ৬,২৫০ বছর আগে ইকুয়েডরে প্রথম পাওয়া যায়। কিন্তু এই অঞ্চলে কোনো বুনো মরিচ নেই। এর অর্থ এই যে, এখানে মরিচ অন্য কোনো অঞ্চল থেকে এনে চাষ করা হয়। তিনি মনে করেন যে, পেরু বা বলিভিয়া থেকে ইকুয়েডরে মানুষ মরিচের বীজ নিয়ে আসে এবং ঐ অঞ্চলেই সম্ভবত মরিচের সর্বপ্রথম চাষ হয়।
সে যা-ই হোক, কলম্বাস যখন মরিচ খুঁজে পান, তিনি অন্যান্য দ্রব্যের সাথে মরিচও ইউরোপে নিয়ে আসেন। তবে প্রথমদিকে আমেরিকার মানুষের মতো তারা মরিচের প্রেমে পড়ে যাননি, বরং নতুন আবিষ্কৃত উদ্ভিদ হিসেবে দুই-একটা গাছ বাড়িতে লাগাতো। কিন্তু ইউরোপীয়রা নিজে না খেলেও সেই জিনিসের ব্যবসা করতে ওস্তাদ ছিল। তাই ১৫ শতকের শেষের দিকে পর্তুগিজরা প্রথম মরিচ ভারতবর্ষে নিয়ে আসে অন্যান্য দ্রব্যের সাথে বিনিময় করতে।
ভারতীয়রা প্রথম আস্বাদনেই ভালবেসে ফেলে এই নতুন ঝাল ফলকে। ভারতের গোয়ায় ছিল পর্তুগিজ উপনিবেশ। এখানে রান্নায় প্রচুর পরিমাণে মরিচ ব্যবহার শুরু হয়। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং ভারতীয় উভয় সম্প্রদায়ই মরিচ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না শুরু করে। পাকা লাল মরিচ শুকানোর পদ্ধতি বের করার পর মরিচ দূরদূরান্তে বহন করা সহজ হয়। ফলে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে দ্রব্যের বিনিময় মাধ্যম হিসেবে মরিচ ছড়িয়ে পড়ে। পরের শতকে পুরো ভারতবর্ষ এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে শুরু করে আফ্রিকা-ইউরোপে রান্নায় মরিচের ব্যবহার এতই বৃদ্ধি পায় যে মরিচ ছাড়া কোনো দেশেই রান্না কল্পনা করা যেত না।
ভারত থেকে মরিচ যায় থাইল্যান্ডে। সেখানে পর্তুগিজরা উপনিবেশ স্থাপন করতে না পারলেও রন্ধনপ্রণালীকে বদলে দিয়ে যায়। এরপর যায় জাপান, চীন, তিব্বত এবং এশিয়ায়। ৩০ বছরের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে আফ্রিকার সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল হয়ে মরিচের জোয়ার স্পেনে গিয়ে পৌঁছায়। ইউরোপের রন্ধনপ্রণালীতে পাকাপাকি জায়গা করে নেয় মরিচ। তবে ইউরোপে মরিচ জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ রয়েছে। ষোড়শ শতকে নেপোলিয়ন বিভিন্ন বাণিজ্যপথের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করার পর ইউরোপে গোল মরিচের আমদানি কমে যায়। মরিচ যেহেতু সব জায়গায় উৎপাদন করা যায়, তাই তখন ইউরোপীয়রা একেই তাদের প্রধান মশলা হিসেবে বেছে নেয়।
পর্তুগিজরা যেদিকে গেছে সাথে করে মরিচ নিয়ে গেছে। তারা তাদের যাত্রাপথে যতটা মানুষের ভাষা আর জীবন-ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে তার চেয়ে বেশি খাদ্যাভ্যাসকে প্রভাবিত করেছে। ইউরোপে মরিচের বিভিন্ন জাতের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন নতুন মরিচের জাত উদ্ভাবন করা হয়।
মরিচ সাধারণত কাচা-পাকা, শুকনা, এবং গুড়া এই তিন অবস্থায় পাওয়া যায় এবং এগুলো থেকেই বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে মরিচ পাওয়া যায় না বা রান্না হয় না। ঝাল ছাড়া সব তরকারি বিস্বাদ। এশিয়ার অনেক দেশ মরিচ খাওয়ায় শীর্ষে। ভূটানের প্রধান ফল মরিচ। বাংলাদেশ এবং ভারতে সব বাড়িতেই মরিচ পাওয়া যাবে। ভারতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করে মরিচ-লেবু অশুভ শক্তি তাড়ায়। বাংলাদেশে ওঝারা ভূত তাড়াতে মরিচ পোড়া আর মরিচের গুড়া ব্যবহার করে।
মরিচ ক্যাপসিকাম বর্গের একটি উদ্ভিদ। এই বর্গে ২৫ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে যার মাত্র পাঁচ প্রজাতির চাষ করা হয় এবং এই পাঁচ প্রজাতির মধ্যে সংকরায়ন করেই বর্তমানে মরিচের যত প্রজাতি দেখা যায় তার সৃষ্টি। কারণ কিছু প্রজাতিতে ঝাঁঝালো স্বাদ নেই, আর কিছু অল্প পরিমাণে ফল দেয়। তবে একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার বনাঞ্চলেই দেখা পাওয়া যাবে বুনো মরিচের।
মরিচের ঝাল স্বাদের জন্য দায়ী ক্যাপ্সাইসিন নামে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ। এছাড়া আরও কিছু রাসায়নিক দ্রব্য আছে যেগুলো গরম অনুভূতি দেয়। সবগুলোকে একত্রে ক্যাপ্সাইসিনয়েড বলে। যখন কোনো প্রাণী বা মানুষের জিহ্বায় এই ক্যাপ্সাইসিনয়েড পৌঁছায় তখন পেইন রিসেপ্টরকে মনে করায় প্রচুর গরম কিছু মুখে ঢুকেছে। ফলে জ্বলুনির অনুভূতি হয়। এই জ্বলুনির মাত্রা সাধারণত কেলভিন স্কেলে অথবা স্কোভিল তাপ ইউনিটে মাপা হয়। মরিচ গাছ কেন এই ক্যাপ্সাইসিনয়েড উৎপন্ন করে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন এবং তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মরিচ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পোকার হাত থেকে ফলকে রক্ষার জন্য এই রাসায়নিকগুলো তৈরি করে। আর জাতভেদে ঝালের মাত্রার তারতম্য হয়, কারণ কিছু জাত মরিচ গাছে যেসব ক্ষতিকারক ক্ষুদ্র অণুজীব এবং ছত্রাক থাকে সেগুলো ধ্বংস করার জন্য মরিচে ক্যাপ্সাইসিনয়েড বৃদ্ধি করে এবং গাছ ও পাতায় কিছু পরিমাণে এসব রাসায়নিক উৎপন্ন হয়।
বর্তমানে মরিচ উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে চীন। ২০১৪ সালের বিশ্ব উৎপাদন পরিসংখ্যান অনুযায়ী চীন প্রায় ১৬ মিলিয়ন টন মরিচ উৎপাদন করে যা মোট উৎপাদনের ৪৬%। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মরিচের জন্মস্থান মেক্সিকো এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে তুরস্ক। তবে শুকনো মরিচ উৎপাদন এবং রপ্তানিতে ভারত সবসময়ই শীর্ষে।
মরিচ এমন এক জিনিস যা ছাড়া আমরা আমাদের খাবার কল্পনা করতে পারি না। মরিচের মতো আর কোনো খাবার এত দ্রুত বিস্তার লাভ করেনি এবং এতভাবে রান্নায় ব্যবহৃত হয়নি। লবণের পরে মরিচই রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। যারা ঝাল ভালোবাসে তাদের কাছে মরিচ এক সুখের অনুভূতির নাম। আর যারা ভালোবাসেন তারাও মাঝে মধ্যে টক-ঝাল-মিষ্টিতে একটু ঝাল দিয়ে খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। তাই হয়তো মানবজাতি যতদিন থাকবে রন্ধনপ্রণালী থেকে মরিচের বিলুপ্তি ঘটবে না।