আগ্নেয়গিরি শব্দটি শুনলেই সবার চোখে ভেসে ওঠে লাভা, ম্যাগমা, অগ্ন্যুৎপাত আর জ্বালামুখের কথা। তবে আগ্নেয়গিরি শুধু এ ব্যাপারগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। আগ্নেয়গিরির ব্যাপ্তি এবং প্রভাব আরো সুদূরপ্রসারী। পৃথিবী নামক গ্রহের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য হলো এ আগ্নেয়গিরি, যা ক্ষেত্রবিশেষে মানচিত্রের চেহারা পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। আগ্নেয়গিরি এবং এর আশেপাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাসহ স্থাপনা, প্রাণীর জীবাশ্ম ও বনের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়ার কথাও জানান ভূতত্ত্ববিদেরা। আগ্নেয়গিরি সংলগ্ন অঞ্চল থেকে এরকম প্রায় কিছু আবিষ্কার সম্প্রতি তারা তুলে ধরেন।
ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া জীবাশ্ম
৯০ মিলিয়ন বছর আগের কথা। ‘টিংমিয়াটরনিস আর্কটিক’ নামে একটি পাখি মরে পড়ে থাকে আর্কটিক সাগরের কানাডিয়ান অংশে। করমোরেন্ট এবং সিগালের মাঝামাঝি দেখতে এ পাখি যখন ২০১৬ সালে আবিষ্কৃত হয়, তখন এ পাখির সূত্র ধরে সেকালের অনেক তথ্যই বেরিয়ে আসে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, ৯০-৯৫ মিলিয়ন বছর আগেও পৃথিবীতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির মতো সমস্যা বিদ্যমান ছিলো। তবে এ ধরনের উষ্ণ পরিস্থিতিতেও কানাডিয়ান আর্কটিক সাগরে বরফের সৃষ্টি হতো। এতে করে অন্য জীব-জন্তু খাবার সংগ্রহে যেতে পারতো না। কিন্তু শারীরিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণেই টিংমিয়াটরনিস নামে এ পাখি খাবার সংগ্রহ করতে পারতো। আগ্নেয়গিরি অধ্যুষিত এ অঞ্চলের মাটি এবং জীবাশ্ম পরীক্ষা করে সেখানে ডাইনোসরসহ স্তন্যপায়ী বিভিন্ন প্রাণীর অস্তিত্বের কথাও বলেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া ওই আগ্নেয়গিরি থেকে উৎপাদিত কার্বন ‘গ্রিনহাউজ ইফেক্ট’ তৈরিতেও পরোক্ষ ভূমিকা রাখতো। বিজ্ঞানীরা আরো বলেন, টিংমিয়াটরনিস পাখির জীবাশ্ম থেকে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কেও ধারণা নেন তারা।
একটি ছোট্ট পৃথিবী
মেক্সিকোর ইজতাসিসুয়াটল আগ্নেয়গিরির নিকটেই ছিলো একটি পুকুর। সম্প্রতি এ পুকুরটি যখন শুকানো হয়, এ পুকুরেই পাথরের একটি মন্দিরের ধ্বংসাবেশেষ আবিষ্কৃত হয়। মেক্সিকোর অ্যাজটেক স্থপতিরা অসাধারণভাবেই হ্রদের মতো দেখতে এ পুকুর নির্মাণ করেছিলেন। পুকুরের পার থেকে দেখে মনে হতো, পানির ভেতর পাথরের এ মন্দির ভেসে বেড়াচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, এ আগ্নেয়গিরির আশেপাশের এলাকা থেকে প্রাপ্ত শিলাখণ্ড, তৈজসপত্র এবং অন্য জিনিসপত্র সঙ্গে অ্যাজটেকদের বৃষ্টি খোদারও সম্পর্ক খুঁজে পান। মন্দিরটি একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করছেন, মন্দিরের এ মডেলের সাথে অ্যাজটেকদের পৃথিবীর ধারণার সাথে মিলে যাবে। এছাড়া তাদের পৌরাণিক ধ্যান-ধারণারও আভাসও এ মন্দির এবং আশেপাশের স্থাপনা থেকে পাওয়া যায় বলে মত দেন তারা।
একজন ফেরারির গুহা
২০১৪ সালে গুহা অনুসন্ধানকারীরা আইসল্যান্ডের স্নায়েফেলসনেস ন্যাশনাল পার্ক চষে বেড়ানোর ইচ্ছা পোষণ করেন। তারা যখন নেশারুনের আগ্নেয়গিরির লাভা মাঠ ঘুরে দেখছিলেন, তখন তারা একটি গুহার সন্ধান পান। এ গুহাতে তারা প্রাচীনকালের বিভিন্ন সৃষ্টিকর্ম দেখতে পান। ছোট চুলা ছাড়াও একটি বিছানা এবং ঘোড়ার হাড়গোড় খুঁজে পান তারা। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা বিশ্বাস করেন, এগারো বা বারো শতাব্দীতে এ গুহায় কেউ আত্মগোপন করেছিলেন। তবে ঠিক কারণে ওই ব্যক্তি এ গুহায় ছিলেন, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি তারা। ধারণা করা হচ্ছে, প্রচলিত আইন অমান্য করে সম্ভাব্য কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচতেই এ গুহাতে ঢুকে পড়েন ওই ব্যক্তি। এই গুহাতে প্রাপ্ত ঘোড়ার হাড়গোড় সাক্ষ্য দেয়, ওই ব্যক্তি হয়তোবা নৈশভোজ সম্পন্ন করতে ওই ঘোড়া ভক্ষণ করেন। এক হিসেবে দেখা যায়, খ্রিস্টান ধর্মের আবির্ভাবের পর একহাজার খ্রিস্টাব্দে আইসল্যান্ডে হরিণের মাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই তথ্য থেকেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাচ্ছেন গুহা অনুসন্ধানকারীরা। তাদের মতে, আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির লাভা খুঁড়লে প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে আরো অনেক যুগান্তকারী তথ্য পাওয়া যাবে।
দৈত্যাকৃতির রিং
দক্ষিণ আফ্রিকার পিলানেসবার্গ ন্যাশনাল পার্কে কিছু বৃত্ত দেখা যায়, যেসব দেখতে অনেকটা পর্বত-উপত্যকার মতো দেখায়। প্রকৃতপক্ষে এ বৃত্ত হলো, কয়েক হাজার বছর আগের আগ্নেয়গিরির রেখে যাওয়া পদচিহ্ন। আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) উপগ্রহেই এ সত্যটা ধরা পড়ে। নাসার পক্ষ থেকে বলা হয়, আগ্নেয়গিরি থেকে লাভা উদগিরণ হয়ে শীতল ও কঠিন হওয়ার পর সময়ের সাথে এ রূপ ধারণ করে। এগুলোকে রিং ডাইক বলা হয়। বিশ্বে এ ধরনের রিং ডাইক খুব বেশি অবশিষ্ট নেই। প্রতিবার অগ্ন্যুৎপাতের পরই এ ধরনের রিংয়ের সৃষ্টি হতো। পরবর্তীতে মহাদেশীয় প্লেট পরিবর্তিত হয়ে গেলে পিলানেসবার্গ নামে এ আগ্নেয়গিরি সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়।
জীবাশ্মকৃত বন
আধুনিক মঙ্গোলিয়ায় ৩০০ মিলিয়ন বছর আগের একটি আগ্নেয়গিরি পুরো একটি নিরক্ষীয় বনকে রীতিমতো জীবাশ্মে পরিণত করেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা বলেন, এ আগ্নেয়গিরি একটা সময়ে পুরো বনকে ১০০ সেন্টিমিটার ছাইয়ের আবরণে ঢেকে দিয়েছিল। অনুসন্ধানকারীরা এ ছাইয়ের নিচে এ বনের সন্ধান পেয়ে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। গাছগুলো দেখতে বেশ পুরোনো মনে হচ্ছিল তাদের কাছে। তবে যে গাছগুলো দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলো, সেগুলো আগ্নেয়গিরি ছাই করতে পারেনি। ছাইয়ের নিচে আটকে পড়া গাছগুলোই প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খুঁজে পান। বনের সবার ওপরের চাঁদোয়া ২৫ মিটার উঁচু বলেও জানান তারা।
সুপার-ইরাপশন (শক্তিশালী অগ্ন্যুৎপাত)
২০১২ সালে বিজ্ঞানীরা ইতালির একটি সুপার-ইরাপশন পুনরায় খতিয়ে দেখতে যান। ২ লক্ষ বছর আগে এ আগ্নেয়গিরি যখন বিস্ফোরিত হয়েছিল, তখন এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় অগ্ন্যুৎপাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এ অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পেতে আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে পরিত্যক্ত ছাই পরীক্ষা করেন। শতাধিক ছাইয়ের গাদা পরীক্ষা করে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এটি অতীতের যেকোনো উদগিরণের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। এ উদগিরণে ৪৫০ মিলিয়ন কিলোগ্রাম সালফার ডাই-অক্সাইডের সৃষ্টি হয়েছিল। এ অগ্ন্যুপাতের ফলে সৃষ্ট ছাইয়ে বিজ্ঞানীরা ফ্লুরিন নামে রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্ব খুঁজে পান বলে জানান।
আফ্রিকা দুই ভাগ!
বিজ্ঞানীদের ধারণা, আফ্রিকা মহাদেশ ধীরে ধীরে ভৌগোলিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। তবে তা ১০ মিলিয়ন বছরের বেশি সময় নেবে। কিন্তু ২০০৫ সালে ইথিওপিয়ার নিকটে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশ দ্রুতগতির ফাটল লক্ষ করা যায়। দশদিনের ব্যবধানে প্রায় ৬০ কিলোমিটার জুড়ে প্রস্থে ২৬ মিটার ফেটে যায় এবং এর অন্যতম কারণ ছিলো ভুপৃষ্ঠে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। এর ফলে আফ্রিকা মহাদেশের ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অংশটি আফ্রিকার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। ফাটলটা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা বেশ অস্বাভাবিক বলেও মনে করেন তারা।
ভ্রান্ত আগ্নেয়গিরি
বেশ কয়েক দশক আগে বিজ্ঞানীদের কাছে পেরুর নেপানা উপত্যকায় ৫০ ফুট উঁচু একটি চোঙাকৃতির ঢিবি পরিলক্ষিত হয়। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, এটি সম্ভবত একটি আগ্নেয়গিরি। ২০১৭ সালে একটি সরেজমিনে তদন্ত চালানোর পর এ সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে আরো কাছ থেকে পরীক্ষা করে দেখার পর জানা যায়, কে বা কারা পিরামিডের মতো করেই এটি বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা সম্পন্ন করতে পারেননি। ধারণা করা হচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫৬৩ সালেই এ ঢিবি তৈরি করা হয়েছিল।
আগ্নেয়গিরি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণেই এর আশেপাশের অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন তারা। কারণ এর মাধ্যমে আগ্নেয়গিরি ছাড়াও ভবিষ্যতের পৃথিবীর অবস্থা কীরূপ ধারণ করতে পারে, সে সম্পর্কে ল ধারণা স্থির করতে পারবেন বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
ফিচার ইমেজ: Pixabay