গ্রাম বাংলায় একটি কথা প্রচলিত আছে যে, “মাঘের শীত বাঘেও ভয় পায়”। কথাটি মিথ্যা কিছু নয়। মাঘ মাস আসলেই আমরা কিছুতেই ঘর থেকে বের হতে চাই না। মন চায় সারাদিন লেপের নিচেই শুয়ে থাকি। এই অল্প শীতে যদি আমাদের এই অবস্থা হয়, তাহলে রাশিয়ার একটি দুর্গম শহর, যেটিকে দুনিয়ার সবচেয়ে শীতল শহর বললেও ভুল হবে না, সেই শহরের মানুষদের অবস্থা চিন্তা করুন। দুনিয়ার সবচেয়ে ঠাণ্ডা শহর হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এই শহরের নাম হচ্ছে অইমিয়কন। স্থায়ীভাবে মানুষের বসবাস আছে এমন শহরের মাঝে এই শহরটিকেই সবচেয়ে ঠাণ্ডা জায়গা হিসেবে ধরা হয়ে থাকে, যেখানে জানুয়ারিতে গড় তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৫০ ডিগ্রি। ১২ মাসের মাঝে শীতই থাকে ৯ মাস! সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে। সে সময়ে দিন থাকে মাত্র ৩ ঘণ্টা। ১৯৯৩ সালে অইমিয়কনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় মাইনাস ৬৭.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। শুধুমাত্র এন্টার্কটিকাতেই এর চেয়ে নিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড রয়েছে।
দুর্গম এই শহরের জীবনযাত্রা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সেখানে যান নিউজিল্যান্ডের ফটোগ্রাফার আমোস চ্যাপেল। তিনি প্রায় ১০,০০০ মাইল ভ্রমণ করেছেন সাইবেরিয়ার একদম কোণায় অবস্থিত এই ছোট শহরটির ছবি তুলতে। এখানকার আবহাওয়া এতটাই খারাপ যে, এখানে প্লেন যেতে পারে না। গাড়িতে করে ৫৭৬ মাইল দূরে অবস্থিত পার্শ্ববর্তী শহর থেকে এখানে পৌঁছাতে সময় লাগে দুই দিন। চ্যাপেলের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে কিছু অসাধারণ আলোকচিত্র, যেগুলোতে ফুটে উঠেছে অইমিয়কনের ৫০০ বাসিন্দার দৈনন্দিন জীবনের হালচাল। আমোস চ্যাপেল তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, “মাঝেমাঝেই আমার থুথু জমে শক্ত হয়ে যেতো, আর আমার ঠোঁটে গুঁতো লাগতো। আমার ক্যামেরা চালানোই কষ্টসাধ্য ছিল”।
এই শহরে নেই কোনো হোটেল। কিন্তু এই শহরের লোকেরা খুব বন্ধুত্বপূর্ণ, কেউ এখানে বেড়াতে আসলে তাদেরকে নিজেদের ঘরেই থাকার জায়গা করে দেয় এখানকার বাসিন্দারা। তারা নিজেদের খাবারের জন্য পশু এবং মাছ শিকার করে। কেউ কেউ আবার কৃষক রয়েছে, তবে সেটি বছরে অল্প কিছু সময়ের জন্য। গরুগুলো শুধু গ্রীষ্মের সময়েই দুধ দেয় এবং সেটিকে হিমায়িত করে পুরো বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। বেশি শীতের সময়ে সারাক্ষণই আগুন জ্বালিয়ে রাখতে হয়। এখানে নেই কোনো পানির ব্যবস্থা, কারণ পাইপে পানি বরফ হয়ে যায়। বরফ গলিয়েই খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করে এখানকার বাসিন্দারা। এত বৈরি আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পেরে এখানকার লোকেরা খুব গর্বিত। এই শহরে যারাই বেড়াতে যায়, তাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হয় প্রমাণস্বরুপ যে, তারা দুনিয়ার সবচেয়ে শীতল শহরের সাক্ষী হয়েছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক আমোস চ্যাপেলের তোলা অসাধারণ ছবিগুলো।
ঘন কুয়াশার মাঝে হেঁটে যাচ্ছেন একজন নারী। এই ঘন কুয়াশার সৃষ্টি হয় গাড়ির ধোঁয়া, মানুষ এবং ফ্যাক্টরি থেকে নির্গত বাষ্প থেকে। জানুয়ারির তীব্র শীতে এই কুয়াশা খুব গাঢ় এবং ভারী হয় © Amos Chapple
খারাপ আবহাওয়ার কারণে এখানকার কর্মীরা দুই সপ্তাহ কাজ করে আর দুই সপ্তাহ ছুটি কাটায়। দুর্গম অঞ্চলের এই শহরের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা এই গ্যাস স্টেশনগুলো অনেক বড় ভূমিকা পালন করে © Amos Chapple
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রান হারানো সৈনিকদেরকে উৎসর্গ করে বানানো বরফে ঢাকা ভাস্কর্য © Amos Chapple
শুধু মানুষকেই বৈরি আবহাওয়ার মোকাবেলা করতে হয় না এই শহরে, সাথে রয়েছে অন্যান্য পশুরাও। ক্যাফে কিউবার সামনে একটি কুকুর ঘোরাঘুরি করেছে আর অন্য একটি গুটিসুটি হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে © Amos Chapple
ইয়াকুতিয়া বিভাগের প্রথমদিকে গভর্নরদের একজন ছিলেন ইভান ক্রাফট। তার ভাস্কর্য বছরের বেশিরভাগ সময়েই থাকে বরফে ঢাকা © Amos Chapple
কারো গ্রীষ্মকালের জুতা বরফে শক্ত হয়ে অপেক্ষা করছে শীত শেষ হওয়ার © Amos Chapple
জেলবন্দীদের দ্বারা নির্মিত এই রাস্তা যেটি ‘Road of Bones” নামে পরিচিত, এটিই এই শহরে যাওয়ার এবং বের হওয়ার একমাত্র স্থলমাধ্যম © Amos Chapple
মাইনাস ৫৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিপজ্জনক ঠাণ্ডা থেকে মুখকে রক্ষার জন্য হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছেন এক মহিলা। পিছনে ভ্লাদিমির লেনিনের ভাস্কর্য ঝাপসাভাবে দেখা যাচ্ছে © Amos Chapple
এখানকার বাজারে মাছ, মাংস সংরক্ষণের জন্য কোনো ফ্রিজের দরকার হয় না। শুকনো বায়ু নিশ্চিত করে যাতে মাছ এবং খরগোশ হিমায়িত এবং তাজা থাকে। ঠাণ্ডায় জমে জমি শক্ত হয়ে যাওয়ায় সবজির উৎপাদন হয় না। ফলে এখানকার মানুষদের মাছ এবং মাংসের উপরই বেশি নির্ভর করতে হয় © Amos Chapple
বরফে জমে থাকা এরকম বাড়ির দৃশ্য এখানকার খুব সাধারণ ঘটনা © Amos Chapple
ছবি তোলার আগ মুহুর্তে এই মদ্যপ ব্যক্তি চ্যাপেলকে সতর্ক করে জানিয়ে দেয়- “রাতের বেলা এই শহরের দখল আমার” © Amos Chapple
মশাল দিয়ে জমে যাওয়া ট্রাকের ইঞ্জিন গরম করছেন একজন ব্যক্তি © Amos Chapple
একজন খামারি তার গরুগুলোকে ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি ঘরে বেঁধে রাখে। এখানেই রাতে গরুরা ঘুমায় © Amos Chapple
অমিয়কনের বিচ্ছিন্ন এই জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করতে থাকে এখানকার এই একমাত্র দোকানটি © Amos Chapple
প্রতিদিন সকালেই হিটিং মেশিনে নতুন কয়লা দেয়া হয় এবং আগের দিনের পুড়ে যাওয়া কয়লাগুলোকে সরিয়ে নেওয়া হয় © Amos Chapple
কমিউনিস্ট আমলের একটি প্রতীক, যেটিতে লেখা আছে- “Oymyakon : The pole of Cold” © Amos Chapple
এখানকার বাসিন্দাদের ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচানোর কাজটি করে চলেছে এখানকার একমাত্র হিটিং চিমনীটি। ভারি কুয়াশার সাথে মিশে যাচ্ছে চিমনীর ধোঁয়া © Amos Chapple
ভারী বরফে ঢাকা একটি সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন অইমিয়কনের এক নারী © Amos Chapple
নিকোলাই পেত্রোভিচ নামক এই কৃষক শহরের কিনারায় উষ্ণ পানির ধারায় তার গরুদের পানি পান করাচ্ছেন © Amos Chapple
পানি পান করে গরুরা ফিরে যাচ্ছে তাদের গোয়ালে © Amos Chapple
এখানকার ঘোড়ারা হয়েছে বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়বস্তু, কারণ তারা খুব সহজেই পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে © Amos Chapple
মাটি শক্ত হয়ে ঘরের ভেতর খননকাজ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় অইমিয়কনের বাসিন্দাদের ঘরের বাইরেই টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হয় © Amos Chaple
শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গরম পানির ধারা © Amos Chapple
আমোস চ্যাপেলের ক্যামেরায় ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন এক অইমিয়কন নারী © Amos Chapple
গাড়ির ইঞ্জিন চালু রেখেই দোকানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন একজন ব্যক্তি। এখানকার লোকেরা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে না, কারণ একবার বন্ধ হলে ঠাণ্ডায় জমে দিয়ে আবার চালু না-ও হতে পারে © Amos Chapple
মাইনাস ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে অইমিয়কনের যাওয়ার মহাসড়কের দৃশ্য © Amos Chapple
ফিচার ইমেজ- © Amos Chapple