Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যাগডালেনের মৎসকন্যা এবং হাজার জাহাজডুবির দ্বীপ

কানাডীয় রুপকথায় উল্লেখ রয়েছে ম্যাগডালেন নামের একটি দ্বীপের। এই দ্বীপের উপকূলে একটি সার্ডিন মাছ বোঝাই জাহাজ ডুবে যায়। তারপর সেই মাছের একটি বাক্স কুড়িয়ে পেয়ে একটি মেয়ে তার খোলার চেষ্টা করতেই ঘুম ভেঙে যায় বিরাট এক চিংড়ির। সে সেই মেয়েটিকে সমূদ্রের নিচে নিয়ে গিয়ে মৎসকন্যায় পরিণত করে। তারপর থেকেই ওই দ্বীপের উপকূলে জেলেরা এবং নাবিকরা শুনতে পায় মৎসকন্যার করুণ গান। এই গানের টানেই ডুবে যায় বহু নৌকা আর জাহাজ।

রুপকথার গল্পে এমনি করেই উঠে এসেছে কানাডার কুইবেক প্রদেশের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপপুঞ্জ মাগডালেন আইল্যান্ডস এর কথা। তবে শুধু রুপকথাতেই নয়, বাস্তবেও জাহাজডুবির জন্য কুখ্যাতি রয়েছে এই দ্বীপপুঞ্জটির। এখন পর্যন্ত এই উপকূলে প্রায় হাজারখানেক জাহাজ ডুবির ঘটনার হদিস পাওয়া গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দ্বীপটির অধিকাংশ বাসিন্দার পূর্বপূরুষই এখানে এসে উঠেছিলেন জাহাজডুবির শিকার হয়ে। আর তাদের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে বাড়িঘর এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, এমনকি আত্মীয়তার বন্ধন সবকিছুই গড়ে উঠেছে জাহাজডুবিকে কেন্দ্র করে।

ম্যাগডালেন দ্বীপপুঞ্জের উপকূল

সেন্ট লরেন্স উপসাগরের ম্যাগডালেন দ্বীপপুঞ্জের আয়তন সর্বসাকুল্যে ২০৫ বর্গকিলোমিটার। এর উপকূলে অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীতেই প্রায় হাজার খানেক জাহাজডুুবির ঘটনা ঘটেছে। এখানে জাহাজডুবির কারণ হিসেবে রুপকথার গল্পের মৎসকন্যার তত্ত্ব যদিও প্রযোজ্য হবে না, তবে এই দ্বীপের আকার এবং গঠনের কারণেই এখানে জাহাজডুবির এত ঘটনা ঘটেছে।

দ্বীপটি অনেকটা অশ্বক্ষুরাকৃতির। আর উপকূলের কাছে পানি সব সময়ই পাথুরে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফেনিল হয়ে থাকে। আর এই অঞ্চলের আবহাওয়ার পরিবর্তনটাও হয় খুব দ্রুত। এই দেখা যায় নীল সমুদ্রের শান্ত জলরাশি, তো কিছুক্ষণ পরেই কুয়াশা আর ফেনিল ঢেউয়ে বিপদজনক হয়ে ওঠে নৌপথ। আর এই কুয়াশা এবং ফেনিল পানির কারণে উপকুলের কাছে পানির নিচ থেকে খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়টি অনেকেরই চোখে পড়তো না। ফলে যা হওয়ার তাই। ধাক্কা খেয়ে জাহাজ ভেঙে চুড়মার হয়ে যেত, আর অনেক যাত্রীরই ঘটতো সলিল সমাধি। এই

দ্বীপের কোস্টগার্ডের এক সদস্য চার্লস কোমিয়ের মতে, বেশিরভাগ জাহাজই জানত না এখানে একটি পাহাড় আছে। তিনি আরো জানান, দ্বীপের প্রচলিত গল্প অনুযায়ী একবার একই দিনে ঝড়ে ৪৮টি জাহাজ এই পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ডুবে গিয়েছিল। গল্পে জাহাজডুবির সংখ্যা যা-ই হোক, এই দ্বীপের উপকূলে জাহাজডুবির প্রকৃত সংখ্যা নির্নর্য়ণ করা সম্ভব হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন দ্বীপের এক বাসিন্দা এবং শখের প্রত্নতত্ত্ববিদ লিওনার্দ ক্লার্ক। তিন পুরুষ ধরে তারা এই দ্বীপের চারপাশে ডুবে যাওয়া জাহাজের তথ্যাদিসহ একটি ম্যাপ বানিয়েছেন।

লিওনার্দ ক্লার্কের তৈরি জাহাজডুবির ম্যাপ

তার ম্যাপে প্রায় ৭০০ জাহাজের বিবরণ উঠে এসেছে। তাকে পানির নিচে ডুব দিয়ে জাহাজগুলোর অবস্থান নির্ণয় এবং সেগুলো থেকে নানা নিদর্শন তুলে আনতে সহায়তা করেছেন এই দ্বীপেরই আরেক বিখ্যাত বাসিন্দা ভুবনবিখ্যাত আন্ডারওয়াটার ক্যামেরাম্যান মারিও কির। এই প্রত্নতাত্বিক নির্দশনের অনুসন্ধান এবং জাহাজডুবির ঘটনার পেছসে স্থানীয় কিংবদন্তীগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি বিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র। ‘লিজেন্ডস অব ম্যাগডালেন’ নামের এই প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে জাহাজডুবির ইতিহাস এবং জাহাজডুবির শিকার মানুষগুলো আশ্রয় নেয়ার ফলে কীভাবে এই দূর সমুদ্রের দ্বীপে ঘটেছে সাংস্কৃতিক বিবর্তন।

লিজেন্ডস অব ম্যাগডালেন প্রামাণ্যচিত্রের পোস্টার

এই দ্বীপে মানব বসতি গড়ে ওঠে সপ্তদশ শতাব্দীতে। প্রথমেই আসে ফরাসিভাষী জনগোষ্ঠী। এরপর বেশিরভাগ মানুষই এসেছে জাহাজডুবির শিকার হয়ে এবং তাদের অনেকেই স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন এই দ্বীপে। দ্বীপের বর্তমান অধিবাসীদের অধিকাংশেরই পূর্বপুরুষরা সপ্তদশ এবং অষ্টদশ শতকে জাহাজডুবির শিকার হয়ে এখানে এসেছিলেন। এদের অনেকেই ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড থেকে কানাডা যাওয়ার পথে জাহাজডুবির শিকার হন। আর তাই এই দ্বীপে ইংরেজি ভাষী একটি গোষ্ঠীর আবাস গড়ে উঠেছে। আবার ফরাসি ভাষী জনগোষ্ঠীও আছেন। তাদেরও অনেকেরই পূর্বপুরুষ জাহাজডুবির শিকার হয়েছিলেন। এর ফলে এই দ্বীপের মানুষগুলো যেন জাহাজডুবি সূত্রে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ।

এই দ্বীপের বাসিন্দারাই শুধু জাহাজডুবির ফলে এখানে আসেন নি তাদের অনেক বাড়িঘরও গড়ে উঠেছিল জাহাজের ভাঙা অংশ দিয়ে। প্রতিটি জাহাজ ডোবার পর এর ভাঙা কাঠ থেকে শুরু করে লোহার অনেক যন্ত্রাংশই ভেসে আসতো দ্বীপের উপকূলে। বাঁচার তাগিদে সংগ্রামী সেই মানুষগুলো তখন সৈকত থেকে সেসব কুড়িয়ে এনে বানিয়ে নিতেন নিজের কুটির। এসব বাড়ির কিছু কিছু এখনো টিকে আছে এবং এই দ্বীপের ঐতিহ্য বলে স্বীকৃতিও পেয়েছে। এমনি একটি বাড়ির মালিক হচ্ছেন স্থানীয় সত্তরোর্ধ নারী রোধা ক্লার্ক। তার বাড়িটির নাম ওল্ড হ্যারি হোম। তার কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী তার প্রপিতামহ সিনিয়র হেনরি ক্লার্ক ১৮৬১ সালে এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। পুরো বাড়িটির প্রতিটি জিনিসই তিনি সৈকতে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।

জাহাজডুবির ধ্বংসাবশেষ দিয়ে তৈরি বাড়ি

বাড়ি ছাড়াও এই দ্বীপে জাহাজের ধ্বংসস্তুপ থেকে পাওয়া কাঠ ও লোহা দিয়ে বানানো একটি গির্জা রয়েছে যা দ্বীপের মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এই গির্জার নাম সেইন্ট পিটারস বাই দ্য সি চার্চ। শতবর্ষী এই চার্চটিকে স্থানীয় মানুষ নানা উদৌাগের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছে। বর্তমানে এই চার্চটিও স্থানীয় মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে পরিকল্পনা করছে একটি ছবির প্রদর্শনী করার। এই প্রদর্শনী হবে দ্বীপের সেসব মানুষের যারা বিভিন্ন জাহাজ নৌ দুর্ঘটনায় সলিল সমাধি লাভ করেছে। প্রদর্শনীর জন্য ১৯৫০ সালের পরে জাহাজডুবির শিকার হওয়া প্রায় ১৩৫ জনের ছবি জোগাড়ও করেছে চার্চ কর্তৃপক্ষ। ধরনের প্রদর্শনীর কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, এই দ্বীপের মানুষের জীবন এবং সংস্কৃতিতে জাহাজডুবির ঘটনার প্রভাব খুব বেশি এবং এই ধরনের ঘটনায় দ্বীপের প্রায় প্রতিটি পরিবারই প্রভাবিত হয়।

এই দ্বীপে শুধু জাহাজডুবিই নয়, সাম্প্রতিক অতীতে একটি বিমান দুর্ঘটনাও বেশ আলোচিত হয়েছে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসের ত্রিশ তারিখে ম্যাগডালেন দ্বীপের বিমানবন্দরে অবতরণ করার আগে উপকূলে কুয়াশা এবং ঝড়ো হাওয়ার কবলে পড়ে বিধ্বস্ত হয়। এতে সাত আরোহীর সবাই নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে ছিলেন কানাডার সাবেক পরিবহনমন্ত্রী ও ব্রডকাস্টার জ্য লাপিয়েরি ও তার পরিবারের সদস্যরা। দ্বীপের স্থানীয় মানুষের কাছে দারুণ জনপ্রিয় লাপিয়েরি কানাডার সিটিভি ও অন্যান্য গণমাধ্যমে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করতেন। তিনি তিনি ২০০৪ সালের জুলাই থেকে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী পল মার্টিনের লিবারেল দলীয় সরকারে পরিবহনমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাদের পারিবারিক নিবাস ছিল এই ম্যাগডালেন দ্বীপে। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে লাপিয়েরিসহ তার পরিবারের সদস্যরা দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট ভাড়া করা একটি মিতশুবিশি বিমানে দ্বীপে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দ্বীপের উপকূলে ঠিক যেসব জায়গায় জাহাজডুবির ঘটনা ঘটতো আগে, সেখানেই বিমান বিধ্বস্ত হয়ে লাপিয়েরির স্ত্রী, দুই ভাই ও এক বোন মারা যায়।

ম্যাগডালেন দ্বীপের বাতিঘর

এই ঘটনাটি দ্বীপের অধিবাসীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল এবং অনেকেই এই ঘটনাকে প্রাচীন জাহাজডুবির মিথের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছেন। এই নিয়ে নতুন করে নানা গল্পও প্রচার হয়েছে। আর এ কারণেই বর্তমানে প্রায় ৭টি নতুন বাতিঘর এবং অত্যাধুনিক জিপিএস ও অন্যান্য নৌ-যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও এই দ্বীপের জেলে ও নাবিকরা এখনো জাহাজডুবির ভয় করেন। একাকি নিশিথে অনেক নাবিকই নাকি এখনো শোনেন রুপকথার সেই মৎসকন্যার করুণ সুর। আর ভয়ে থাকেন জাহাজ ডুবিয়ে সেই একাকি মৎসকন্যা বুঝি পূর্বপূরুষদের মতো তাদেরও টেনে নিতে চাইছে সমূদ্রের অতলে।

তথ্যসূত্র

১) bbc.com/travel/gallery/20170523-a-tempestuous-isle-of-1000-shipwrecks

২) imdb.com/title/tt3590910/plotsummary?ref_=m_tt_ov_pl

৩) en.wikipedia.org/wiki/Magdalen_Islands

Related Articles