প্রকৃতি কখনোই তার বিস্ময় ও অনিন্দ্য সৌন্দর্যে আমাদের আশ্চর্য করতে ব্যর্থ হয় না! তবুও এমন কয়েকটি জায়গা পৃথিবীতে রয়েছে যেগুলোর সৌন্দর্য ছাড়িয়ে যায় অন্য সবকিছুকেই। আজ থাকছে তেমন কিছু জায়গারই বর্ণনা।
স্পটেড লেক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা
বহু বছর ধরেই ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ওসইউস শহরের স্থানীয় জনগোষ্ঠী ওকানাগান (সিল্কজ) এই লেকটির প্রার্থনা করে আসছে। প্রকৃতিগত বিচিত্র বৈশিষ্ট্য দেখলেই এর কারণ বোঝা যায়। পুরো বছর সাধারণ অবস্থায় থাকলেও শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালে একেবারে ভিন্ন রূপ ধারণ করে এটি। স্পটেড লেকের পানিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, সিলভার, টাইটেনিয়াম এবং সোডিয়াম সালফেট । তাই গ্রীষ্মকালে এর পানি বাস্পে পরিণত হয় এবং পানির উপরের স্তরে থাকা খনিজ লবণগুলোর ছোপ ছোপ নকশা বা মিনারেল পুল তৈরি হয়, যেগুলোর প্রতিটির রঙ ভিন্ন হয়ে থাকে। এই লেকটিকে ঘিরে বিভিন্ন রকম কুসংস্কার থাকায় এর পার্শ্ববর্তী উপজাতীয় এলাকায় বা এর ধারের কাছে যাওয়া অনেকটা নিষিদ্ধই বলা চলে।
দ্য জায়ান্টস্ কসওয়ে, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড
৬০ মিলিয়ন বছর আগে প্রকাণ্ড এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত থেকে গলিত শিলা এসে এই জায়গায় পড়ে। পরবর্তীতে ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ায় এই গলিত শিলাগুলোই দৃঢ়, সংকুচিত এবং ফাটল ধরার পর বর্তমান রূপ ধারণ করে। এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটটিতে আনুমানিক ৩৭ হাজার বহুভূজ স্তম্ভ রয়েছে। জ্যামিতিক আকৃতির এই স্তম্ভগুলো এই জায়গার সৌন্দর্যে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
থরস্ ওয়েল, অরেগন, যুক্তরাষ্ট্র
থরস্ ওয়েলকে স্পাউটিং হর্ন বা গেট টু হেলও বলা হয়ে থাকে। প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ২০ ফুট গভীর এই খাদটিতে সহজেই একটি বড় নৌকা ঢুকে যেতে পারে। পানির স্রোত বেশ জোরে আছড়ে পড়ে গর্তের মধ্যে, আবার ভেতর থেকে বেশ বেগেই বাইরে বেরিয়ে আসে। এই ওয়েলটি আপনি দেখতে পারেন ক্যাপ্টেন কুক ট্রেইল থেকে। তবে সতর্কতা অবলম্বন করতে জোয়ার ও শীতকালীন ঝড়ের সময় সেখানে যাওয়ার চিন্তা এড়িয়ে চলাই ভালো।
পামুক্কালে, তুরস্ক
১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে জায়গা করে নেয় তুরস্কের অদ্ভুত সুন্দর এই জায়গাটি। সেখানকার স্থানীয় ভাষায় ‘পামুক্কালে’ শব্দটির অর্থ হলো- ‘তুলার প্রাসাদ’। তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দেনিজলি প্রদেশের মেন্দারিস নদীর উপত্যকায় অবস্থিত পাললিক শিলা দ্বারা নির্মিত পামুক্কালের সৌন্দর্য একেবারে নজর কাড়ার মতো। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মেন্দারিস নদীর জলধারা অবস্থিত। বছরের অধিকাংশ সময়ই সেখানের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ থাকে। এর ঢেউয়ের মতো আকৃতির মধ্য দিয়ে টলমল করে অনবরত পানি প্রবাহিত হতে থাকে। এই পামুক্কালে প্রায় ২০ লক্ষ বছর পুরনো। বহু বছর আগে ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের কারণে মাটিতে বেশ কয়েকটি ফাটল ধরায় মাটির নিচের ক্যালসিয়াম কার্বনেট যুক্ত গরম পানি বের হয়। আর সেই পানি এসে জমা হতে থাকে উপরের দিকে। পানি গরম হওয়ার কারণে তা বাষ্প হয়ে উড়ে যায় এবং রয়ে যায় শুধু ক্যালসিয়াম কার্বনেট, যা মূলত একধরনের লবণ। লেকগুলোর কাঠামো তৈরি হয়েছে এই লবণ জমেই। ধীরে ধীরে সেগুলো শক্ত হতে থাকে এবং বৃষ্টির পানি জমে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে রূপ নেয় লেকগুলো।
হিলিয়ার লেক, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া
যদি আপনাকে বলা হয়, পানির রঙ গোলাপি, তাহলে কি বিশ্বাস করবেন সেটা? পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় আসলেই রয়েছে গোলাপি পানির হ্রদ, লেক হিলিয়ার। হ্রদের পানির রঙ গোলাপি হওয়ার কারণ এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরাও অনুসন্ধানে বের করতে পারেনি। তবে ধারণা করা হয় যে, দুনালিলা স্যালাইনা নামক এক প্রকার জৈব ও গোলাপি রঙের ব্যাক্টেরিয়া- হালোব্যাকটেরিয়াই পানির এরকম রঙ হওয়ার মূল কারণ। হ্রদটির চারপাশ সাদা কাদামাটি দিয়ে ঘেরা। গবেষণার কাজ অব্যাহত রাখার জন্য হ্রদটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই পর্যটক হোক বা স্থানীয় লোকজন, কারোরই সেখানে যাবার তেমন একটা সুযোগ হয় না। প্রায় ২,০০০ ফুট লম্বা ও ৬০০ মিটার বিস্তৃত এই হ্রদটি প্রথম আবিষ্কার করা হয় ১৮০২ সালে। ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ডার্স এবং তার দল সেই আবিষ্কারের কৃতিত্বের অধিকারী।
বাদাব-ই-সুরত, ইরান
‘বাদাব’ শব্দটির অর্থ মাটির নিচ থেকে আসা গ্যাসীয় পদার্থের সাথে পানির মিশ্রণ। আর ‘সুরত’ শব্দটির অর্থ গভীরতা। বাদাব-ই-সুরতকে পাহাড়ের চূড়া থেকে দেখলে মনে হবে যেন ধাপে ধাপে নিচের দিকে সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে। আর সেই সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ দিয়েই অবিরাম বয়ে চলে গরম পানির ঝর্ণা। পাথরের তৈরি এই সিঁড়িগুলো সৃষ্টি হয়েছে মূলত দুটি গরম পানির ঝর্ণার খনিজ ও চুনাপাথর দিয়ে। ঝর্ণা দুটি একটি অন্যটি থেকে বিভক্ত অবস্থায় আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই বিস্ময়টির অবস্থান ইরানের মাজানদারান প্রদেশে। ট্রাভেরটাইন নামক একধরনের খনিজ পদার্থ বসন্তের শেষের দিকে এর আকৃতি ও রূপে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসে। বাদাব-ই-সুরতে মাটির নিচ থেকে আসা পানির সাথে ক্যালসিয়াম যোগ হয়ে বিশাল এক স্তর তৈরি করে। বসন্তের সময়টাতে ক্যালসিয়ামের সাথে আয়রন অক্সাইড যুক্ত হয়ে স্তরগুলোর লাল ও কমলা রঙ ধারণ করে।
চকলেট হিলস্ অব বোহোল আইল্যান্ড, ফিলিপাইন
ফিলিপাইনের কারেমান, বাটুয়ান এবং সাগবায়ান এলাকা মিলে বিস্তীর্ণ ৫০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে চকলেটের পাহাড়। সেখানকার কোণ বা ডোম আকৃতির প্রায় ১,২৬৮টি পাহাড় দেখলে মনে হবে যেন উপরের অংশে চকলেটের প্রলেপ দেয়া। শুষ্ক আবহাওয়ায় পাহাড়ের ঘাসগুলো শুকিয়ে বাদামি রঙের হয়ে যায়। মূলত বালু সমৃদ্ধ সামুদ্রিক চুনাপাথরের সৃষ্টি এই পাহাড়গুলোর উপরের অংশ ঘাস দিয়ে ঘেরা। পাহাড়গুলোর চুনাপাথরে প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক কোরাল, ফোরামেনিফেরা, কোরাল, শামুক এবং এলজি প্রকারের জীবাশ্ম পাওয়া যায়। ৩০-৫০ মিটার উঁচু এই পাহাড়গুলোতে দেখা যায় বেশ কয়েকটি ঝর্ণা ও গহ্বর। চকলেট হিলস্-এর সবচাইতে উঁচু পাহাড়টি প্রায় ১২০ মিটার লম্বা। বৃষ্টির পানি পড়ে পাহাড়গুলো ক্ষয় হওয়াতে কিছুটা দ্রবীভূত হয়ে ভেসে গিয়ে এরকম রূপ ধারণ করেছে। পাহাড়গুলো ঘিরে প্রচলিত আছে নানা ধরনের কল্পকাহিনী।
রেড বীচ, পাঞ্জিন, চীন
চীনের পাঞ্জিন থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই জলাভূমি এলাকাটিতে বহু অতিথি পাখি ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে। গ্রীষ্মকালে এই সৈকতটি সবুজ রঙের সামুদ্রিক শৈবালে ঢাকা থাকলেও শরৎকালে লাল রঙে সেজে ওঠে পৃথিবীর সবচাইতে ভেজা এই সমুদ্র সৈকতটি। সামুদ্রিক এই শৈবালের নাম সুয়েডা। তবে পর্যটকদের জন্য সমুদ্রসৈকতটির খুব স্বল্প একটি অংশ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, তাও আবার সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে। কারণ এ সময়টাতেই শৈবালগুলো লাল রঙ ধারণ করে। কাঠের একটি ঘর থেকে লম্বাভাবে সিঁড়ি চলে গিয়েছে সমুদ্রের দিকে। সেখান থেকেই পর্যটকরা উপভোগ করতে পারেন প্রকৃতির এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য।
গ্লাস বিচ, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র
সমুদ্রপাড়ে রঙিন কাঁচপাথরের বাহার! শুনতে যেমন অদ্ভুত লাগছে, দেখতেও কিন্তু ঠিক একই রকম অদ্ভুত সুন্দর। ফোর্ট ব্র্যাগের কাছেই ম্যাক্যারিচার স্টেট পার্কে কাঁচপাথরের এই সমুদ্র সৈকতের শুরুটা ১৯০৬ সালে হলেও এটি কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়নি। সেখানকার অধিবাসীরা তাদের নিত্যদিনের বাতিল জিনিসপত্র এই সমুদ্র সৈকতে ফেলতো। এগুলোর অধিকাংশই ছিলো অপ্রয়োজনীয় কাঁচের টুকরো এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। বহু বছর ধরে সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের ঘষায় মসৃণ হয়ে তৈরি হয় চকচকে ও মহামূল্যবান সব পাথর।