মাটির গভীরে উচ্চচাপের কারণে তরল অবস্থায় থাকা গরম ম্যাগমা বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। যখনই ভূপৃষ্ঠে কোনো ফাঁক পায় , তখনই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে সেই উত্তপ্ত ম্যাগমা। যে স্থান থেকে এই গরম ম্যাগমা বেরিয়ে আসে তাকে বলা হয় আগ্নেয়গিরি। আর অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বেরিয়ে আসে সেই লাভা বা ম্যাগমা। এই পৃথিবীতে ত্রিশ হাজারের মতো আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যার মধ্যে দেড়শোটির মতো রয়েছে জীবন্ত। আর অবশিষ্ট অধিকাংশই সুপ্ত ও লুপ্ত অবস্থায় রয়েছে।
এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা সব জায়গাতেই ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়গিরি। তেমনি কয়েকটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে জেনে নিই।
১) মাউন্ট এৎনা (ইতালি)
ইতালির আগ্নেয়গিরির কথা বলতেই মাউন্ট ভিসুভিয়াসের কথা সবার প্রথমে চলে আসে যার প্রভাবে ধ্বংস হয়েছিল আস্ত এক পম্পেই নগরী। ভিসুভিয়াসের মতোই ইতালিতে আরেক জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে যা মাউন্ট ভিসুভয়াসের মতোই সমান সক্রিয়। বর্তমানে ইতালির সবচেয়ে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি এই মাউন্ট এৎনা। ইতালির দক্ষিণপ্রান্তে এবং সিসিলি দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে ক্যাটানিয়া শহরে এই আগ্নেয়গিরিটির অবস্থান। এর উচ্চতা প্রায় ১১ হাজার ফুট।
আফ্রিকান প্লেট আর ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে মাউন্ট এৎনা, যা সংযুক্ত ধরনের এক আগ্নেয়গিরি। এই আগ্নেয়গিরির মুখ চারটি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই আগ্নেয়গিরিটির বয়স প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর। নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে জেগে ওঠে সে।
ইতিহাসের পাতায় গত বেশ কয়েক দশক ধরে থেমে থেমে এই আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে। ১৬৬০ সালের পর ১৯২৮ সালে বেশ বড়সড় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মাউন্ট এৎনা জেগে উঠে। তারপর ১৯৪৯ সাল থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে লাভা, ছাই, ধোঁয়া বেরিয়ে এসেছে প্রচুর পরিমাণে। ২০১৬ সালেও দুই দফা এই আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে।
অগ্ন্যুৎপাতের ফলে আগুনের ধোঁয়া ও স্ফুলিঙ্গ এতটাই উঁচুতে উঠে গিয়েছিল যে তা পূর্ব সিসিলির শহর থেকেও দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তবে এই আগ্নেয়গিরি থেকে বড় কোনো উল্লেখযোগ্য দুর্ঘটনা ঘটেনি। বর্তমানে মাউন্ট এৎনা ইতালির এক নামকরা ট্যুরিস্ট স্পট।
এই জীবন্ত আগ্নেয়গিরির পায়ের কাছেই রয়েছে ক্যাটানিয়া শহর। ক্যাবল কারে করে ট্যুরিস্টদের নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ের কাছে। আগ্নেয়গিরিকে ঘিরে একশো বছর আগেই তৈরি হয়েছে রেলপথ। ২০১৩ সালে ইউনেস্কো মাউন্ট এৎনা আগ্নেয়গিরিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ বলে ঘোষণা দিয়েছে।
২) সাকুরাজিমা (জাপান)
জাপানে ১০০টিরও বেশি আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব রয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই জীবন্ত। তার মধ্যে এক উল্লেখযোগ্য আগ্নেয়গিরি হলো এই সাকুরাজিমা। জাপানের দক্ষিণে চিসু প্রদেশে সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু এই আগ্নেয়গিরির তিনটি মুখ রয়েছে। কিতাদাকে (উত্তর-চূড়া), নাকাদাকে (মধ্য চূড়া) ও মিনামিদাকে (দক্ষিণ চূড়া)। দক্ষিণ চূড়াটিই বর্তমানে বেশি সক্রিয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,১১৭ মিটার (৩,৬৬৫ ফু) উঁচু কিতাদাকে হল সাকুরাজিমার সর্বোচ্চ চূড়া। প্রায় সময়েই এই আগ্নেয়গিরি জীবন্ত হয়ে ওঠে।
এই আগ্নেয়গিরির ৮ কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে কাগোশিমা শহর। শহরটিতে প্রায় ৫ লক্ষ লোকের বসবাস। তার ৫০ কিলোমিটার দূরে রয়েছে সেনডাই নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্লান্ট। নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে এখান থেকে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে, অষ্টম শতাব্দী থেকে সাকুরাজিমা আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে নিয়ত লাভা, ছাই বেরুচ্ছে। যদিও ৫ হাজার বছর আগেও যে এই আগ্নেয়গিরি সক্রিয় ছিল এমন প্রমাণও তারা পেয়েছেন।
১৯১৪ সালে এই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্রচুর পরিমাণে যে লাভা বেরিয়ে আসে তা থেকে সৃষ্টি হয় এক নতুন দ্বীপের। ১৯৬০ সালে জাপান সরকার সাকুরাজিমার আগ্নেয়গিরি নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য গবেষণাগার তৈরি করে। এই শতাব্দীতে ২০০৯ সাল থেকে কয়েক বছর পর পর জেগে উঠছে সাকুরাজিমা। ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০১৬ এর জুলাই মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আগ্নেয়িগিরির মুখ থেকে লাভা ধোঁয়া আর ছাই বেরিয়ে এসেছে, যা ছড়িয়ে পড়ে দুই কিলোমিটার জায়গা জুড়ে।
এই অগ্ন্যুপাতের ফলে প্রায় সময় আশেপাশের জায়গায় ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়। তাই এই আগ্নেয়গিরির চারপাশকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হয়। সাকুরাজিমা আগ্নেয়গিরিকে ডিকেড ভলকানোর তালিকায় রাখা হয়েছে।
৩) ভিয়ারিকা, চিলি
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তের দেশ চিলি দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘রিং অফ ফায়ার’-এর উপর। দেশটিতে প্রায় পাঁচশরও বেশি আগ্নেয়গিরির সন্ধান পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ আগ্নেয়গিরি এখন সুপ্ত অবস্থায় আছে। আর কিছু কিছু আগ্নেয়গিরি লুপ্ত হয়ে গেছে। তবে বর্তমানে ৯০টিরও বেশি সক্রিয় জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে দেশটিতে। তাদের মধ্যে অন্যতম ভিয়ারিকা আগ্নেয়গিরি। নয় হাজার ফুটেরও বেশি এর উচ্চতা। আগ্নেয়গিরির চূড়া পুরো বরফে ঢাকা।
চিলির দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এই আগ্নেয়গিরি। চিলির রাজধানী শহর সানতিয়াগোর ৭৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এটি। স্থানীয়রা মাপুচে ভাষায় একে ‘রুকাপিয়ান’ মানে অশরীরির আড্ডাখানা বলে ডাকেন। আগ্নেয়গিরির পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভিয়ারিকা লেক। পাশেই রয়েছে ভিয়ারিকা নামেই ছোট্ট এক শহর।
সংযুক্ত ধরনের এই আগ্নেয়গিরির দুটি মুখ। প্রথম মুখটি দশ বছর আগে সৃষ্টি হওয়া, যা ৬ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয় মুখটি ২ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এটি সৃষ্টি হয়েছে।
১৫৫৮ সাল থেকে ভিয়ারিকায় যে অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে তার প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ১৯৬৪ ও ১৯৭১ সালে এই আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্রচুর গরম লাভা বের হয়, যা হিমবাহের বরফ পর্যন্ত গলিয়ে ফেলে। এসময় এই এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং আশেপাশের শহর বেশ কিছুদিন ধোঁয়া ও ছাইয়ে ঢাকা পড়ে।
এরপর নিয়মিত ২০ থেকে ২২ বছর ব্যবধানে জেগে উঠেছে ভিয়ারিকা। শেষবার মার্চ, ২০১৫ সালে লাভা উদগিরণ করেছে এই আগ্নেয়গিরি। সেই সময় টানা চার মাস ধরে বিক্ষিপ্তভাবে লাভা বের হয় ভিয়ারিকা থেকে। আগ্নেয়গিরি থেকে বের হওয়া গ্যাস ও ধোঁয়া বায়ুমন্ডলে মিশতে থাকায় প্লেন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। ফলে আশেপাশের শহরগুলোতে রেড এলার্ট জারি করতে হয়।
প্রচুর মানুষকে শহর ছেড়ে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হয়। লাভা প্রায় এক হাজার ফুট উঁচুতে উঠে যায়। তবে অন্যদের তুলনায় এই আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মাত্রা অনেকটাই কম হয়।
৪) মাউন্ট পেলে (মার্টিনিক)
ক্যারিবিয়ান সাগরের মাঝে ছোট্ট একটা দ্বীপ মার্টিনিক। দ্বীপটির আয়তন মাত্র ১,০০০ বর্গ কিলোমিটার। ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণাধীন এই দ্বীপেই অবস্থিত মাউন্ট পেলে নামের এক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। এর উচ্চতা ১,৩৯৭ মিটার (৪৫৮৩ ফুট)। এটি একটি স্টারটো বা সংযুক্ত ধরনের আগ্নেয়গিরি। বর্তমানে এই আগ্নেয়গিরি জীবিত, লুপ্ত না ঘুমন্ত তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কারণ এই আগ্নেয়গিরির পাদদেশে এখনো ভূমিকম্পজনিত কম্পন অনুভূত হচ্ছে।
আবার অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, লাভা উদগিরণের মতো যথেষ্ট পরিমাণে ম্যাগমা নেই মাউন্ট পেলের অভ্যন্তরে। ১৭৯২ সালে এবং ১৮৫১ সালে বেশ হালকা মাত্রার অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল এই আগ্নেয়গিরি থেকে। তবে ১৯০২ সালের ৮ মে হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণে জেগে উঠেছিল আগ্নেয়গিরিটি। বড় ধরনের অগ্ন্যৎপাত ঘটে এই আগ্নেয়গিরি থেকে। প্রচন্ড আগুনের স্ফুলিঙ্গ, মারাত্মক দূষিত গ্যাস ও ছাই সারা দ্বীপে ছড়িয়ে পড়ে।
সেই সময় তছনছ হয়ে যায় গোটা দ্বীপ। সেইবার প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল এই আগ্নেয়গিরি। দ্বীপটির সবচেয়ে বড় আর সুসজ্জিত শহর ছিল সাঁ পিয়াহো, যাকে বলা হতো ‘প্যারিস অফ ওয়েস্ট ইন্ডিজ’।
সেই ভয়াবহ দিন সকাল আটটার দিকে শুরু হয়ে তিন মিনিটের মধ্যে মাউন্ট পেলের লাভায় চাপা পড়ে যায় সাঁ পিয়াহো। ১৯২৯ সালের দিকে আরেকবার খুব অল্প হলেও গ্যাস আর ধোঁয়া বের হতে দেখা গিয়েছিল মাউন্ট পেলের শিখর থেকে। এখন এই দ্বীপটি পর্যটকদের কাছে এক অত্যন্ত জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। যদিও মাউন্ট পেলের খামখেয়ালিপনা নিয়ে বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তা এখনো পর্যন্ত রয়েই গিয়েছে।
৫) মাউন্ট নিরাগঙ্গো, গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গো
আফ্রিকা মহাদেশে বর্তমানে দেড়শরও বেশি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে। তার একটি বড় অংশ পড়েছে মহাদেশের পূর্বভাগে। পৃথিবীর মানচিত্রে এই জায়গাতেই রয়েছে আফ্রিকা, আরব এবং ভারতীয় এই তিন টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল। আফ্রিকার আগ্নেয়গিরির মধ্যে এখন সবচেয়ে সক্রিয় হলো কঙ্গোর নিরাগঙ্গো।
কঙ্গোর পূর্ব দিকে গোমা শহরের কাছেই অবস্থিত এই আগ্নেয়িগিরি। এর পাশেই রয়েছে কিভু লেক এবং তার ২০ কি.মি. দূরে ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক। এখানেই আছে ১.২ কি.মি. ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট বিশ্বের সবচেয়ে সক্রিয় ও বৃহত্তম লাভা হ্রদ। এই লাভা হ্রদের গভীরতা প্রায় ১০,৭০০ ফুট। জ্বালামুখ থেকে ২৫ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায় এই আগ্নেয়গিরির লাভা।
গত একশো বছরে ৪০ বার সক্রিয় হয়ে লাভা ছড়িয়ে দিয়েছে সে। ১৯৭৭ সালে এই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে প্রবল বিস্ফোরণসহ লাভা বের হতে থাকে। ঘন্টায় ৬০ মাইল বেগে জ্বালামুখ থেকে বের হতে থাকা গলিত লাভা এক ঘন্টার কম সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে নিকটবর্তী শহরে। ফলে শহরটিতে বয়ে আনে মারাত্মক বিপর্যয়। প্রায় ৭০ জনেরও বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটে। আহত হয় আরো বহু লোক।
এই আগ্নেয়গিরি থেকে শেষবার লাভা বের হয়েছিল ২০১১ সালে। তারপর ২০১৩ ও ২০১৪ সালে লাভা না বের হলেও ধোঁয়া আর ছাই এর জ্বালামুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।
সতর্ক রয়েছেন বিজ্ঞানীরা, সতর্ক স্থানীয় প্রশাসনও। কারণ আশেপাশে মানুষের বাস না হলেও ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল ফরেস্টে প্রচুর শিম্পাঞ্জি রয়েছে। লাভার আক্রমণে তাদের জীবনহানি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। আগ্নেয়গিরিটির কিছু দূরেই রয়েছে নিহিয়াঙ্গু নামে আরো একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি।
ফিচার ইমেজ – YouTube.com