চীনের শানজি প্রদেশের জিয়ান শহরে বিশ হাজার মুসলিম অধিবাসীর বসবাস। শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাটি জিয়ান মুসলিম কোয়ার্টার নামে পরিচিত। সুস্বাদু খাবার ও বিচিত্র সাংস্কৃতিক জীবনের জন্য এলাকাটি পুরো চীনজুড়ে বিখ্যাত। জিয়ান শহরের কেন্দ্রে ও জিয়ান মুসলিম কোয়ার্টারের ভেতরে ৩০ হুয়াজু লেনে অবস্থিত চীনের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম মসজিদ জিয়ান মসজিদ। চীনা ও ইসলামী স্থাপত্যরীতির অপূর্ব সংমিশ্রমণে গড়া এই মসজিদটি চীনের একটি বিখ্যাত পর্যটন আকর্ষণ। ১৯৮৫ সালে এই স্থাপনাটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত হয়। আজকের আলোচনা জিয়ান মসজিদের ইতিহাস ও স্থাপত্যশৈলী নিয়ে।
জিয়ান মসজিদ সম্পর্কে আলোচনায় যাওয়ার আগে চীনের মুসলমানদের কথা একটু জেনে নেওয়া যাক।
চীনের প্রধান দুই মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাম উইঘুর ও হুই। উইঘুররা একসময় পূর্ব তুর্কিস্তানের বাসিন্দা ছিল। এখন তারা চীনের স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল জিনজিয়াং এ বাস করে। সম্প্রতি চীন সরকারের দমন-পীড়নের শিকার হয়ে বেশ আলোচনায় এসেছে উইঘুররা। অন্যদিকে হুইদের বসবাস প্রায় পুরো চীনজুড়ে। এরা মূলধারার চীনা জনগন হানদের সাথে প্রায় মিশে গেছে। হানদের সাথে হুইদের পার্থক্য শুধু হুইরা মুসলিম, হানরা নয়।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরব বণিকরা স্থল বা জলপথে চীনে আসেন ব্যবসা-বাণিজ্য প্রাসারের লক্ষ্যে। তারা চীনা মেয়েদের বিয়ে করে চীনে থেকে যান। আবার মঙ্গোলদের পশ্চিম অভিযানের সময় মধ্য এশিয়া থেকে বিভিন্ন পেশার লোকজনকে জোরপূর্বক ধরে এনে চীনে বাস করতে বাধ্য করা হয়। এরা ছিলেন মুসলিম। এই আরব বা মধ্য এশীয় মুসলিমরা মূলত হুইদের পূর্বপুরুষ। জিনজিয়াং-এ মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হলেও পুরো চীন কখনো ইসলামী শাসনের আওতায় আসেনি। এজন্য জিনজিয়াংয়ে উইঘুরদের মরুশহর কাশগড় বা তুলুফানে মধ্য-এশীয় রীতিতে গম্বুজ ও মিনারওয়ালা মসজিদ নির্মিত হয় বটে, কিন্তু চীনের মূল ভূখন্ডে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী স্থাপত্যরীতিতে মসজিদ নির্মিত হয়নি। কারণ চীনে অমুসলিম শাসকরা মসজিদ নির্মাণ করতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। সেখানে মধ্য-এশীয় ধাঁচে মসজিদ বানানোর নিয়ম ছিলো না।
মসজিদ বানালে সেগুলো হতে হত বৌদ্ধমন্দিরের মতো। সেই মসজিদগুলোর বৌদ্ধদের ধর্মগৃহের সাথে বাহ্যিক কোনো পার্থক্য ছিলো না। শুধু মসজিদের ভেতরে কোনো মূর্তি বা ছবি থাকতো না। আর ছিল আরবি ক্যালিগ্রাফির উপস্থিতি। এভাবে চীনা মুসলিমরা টালির ছাদযুক্ত কাঠের তৈরি মসজিদ বানাতে শুরু করে। চীনে প্রায় এক হাজার মসজিদ থাকলেও বিভিন্ন যুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় অনেক মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
চীনের অন্যতম সুরক্ষিত মসজিদের নাম জিয়ান মসজিদ। ৭৪২ খ্রিস্টাব্দে ট্যাং রাজবংশের সময় এটি নির্মিত হয়। তারপর বিভিন্ন সময় সংস্কার ও পুনর্নির্মাণের মধ্যে দিয়ে গেছে মসজিদটি। ১৩৯২ সালে মিং রাজবংশের নৌ সেনাপতি চাং হো এটি পুনর্নির্মাণ করেন। চীন সাগর থেকে জলদস্যুদের তাড়ানোর জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত। আজকে আমরা যে জিয়ান মসজিদটি দেখতে পাই তা মূলত সতেরো ও আঠারো শতকে নির্মিত। ১২,০০০ বর্গ মিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বিশাল এই মসজিদ লম্বালম্বিভাবে ক্বাবার দিকে মুখ করে নির্মিত। আয়তাকার এই স্থাপনাটি উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা ও চারটি চত্বরে বিভক্ত। প্রত্যেকটি চত্বরের আলাদা দরজা আছে, আছে আলাদা বাগান।
প্রথম চত্বরের সামনে রয়েছে নয় মিটার উঁচু কাঠের তৈরি ধনুকাকৃতির প্রবেশপথ। মনোমুগ্ধকর ছাদঘেরা এই স্থাপনার বেদীটি পাথরের। দু’পাশে আছে দুটি পার্শ্ব-দরজা। উত্তরের দেয়ালটি মসৃণ ইট নির্মিত। দেয়াল সংলগ্ন ঘরগুলোর দরজা মলিন, ভাঙাচোরা। চত্বরের কেন্দ্রে তিনকোণা নকশা কাটা একটি স্ক্রিন ওয়াল রয়েছে। কেন্দ্রের নকশা করা দরজার আইজেন প্যাভিলিয়ন একসময় লেকচার হল হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
দ্বিতীয় চত্বরটি প্রথম চত্বর থেকে একটি প্যাভিলিয়ন দিয়ে আলাদা। চত্বরের ভেতরে বেশ কিছু পাথরের ফলক আছে যাতে বিখ্যাত চীনা ক্যালিগ্রাফারদের খোদাইকৃত ক্যালিগ্রাফি স্থান পেয়েছে। আরো আছে তিনতলা সমান উঁচু প্যাভিলিয়ন ‘টাওয়ার অভ ভিজিটিং হার্ট’।
তৃতীয় চত্বরে অবস্থিত অষ্টভূজাকৃতির মঠাকৃতির স্থাপনা ‘সেল্ফ এক্সামিনিং টাওয়ার’। মিং রাজবংশের সময় নির্মিত এই টাওয়ারটি মসজিদের মিনারের ভূমিকা পালন করে।
চতুর্থ চত্বরে সবচেয়ে ভেতরের অংশ। এখানেই অবস্থিত মূল প্রার্থনাকক্ষ। বিশালাকার প্রার্থনাকক্ষের বাইরের অংশ ইট-নির্মিত হলেও ভেতরটা কাঠের কলামে আবৃত। সিলিংবিহীন কাঠের ফ্রেমে তৈরি ছাদ দেখা যায়। ভেতরে মিহরাব আছে। দেয়ালে খোদিত আছে কোরআনের আয়াত। ভেতরে মিং রাজবংশের সময়কার হাতে লেখা কোরআন সংরক্ষিত আছে। প্রার্থনাকক্ষের বাইরে দেয়ালঘেরা টিরেস যা উন্মুক্ত হয়েছে মুন প্লাটফর্মে।
চীনে ইসলামের সূচনা যুগের আরো বেশ কিছু মসজিদ আছে যেগুলোর স্থাপত্যে মিশেল ঘটেছে চীনা ও ইসলামী রীতির। এই পর্যায়ে এমন আরো কয়েকটি মসজিদের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
হুয়াশেং মসজিদ
চীনের ওয়াংজো প্রদেশে অবস্থিত হুয়াশেং মসজিদ চীনের বুকে টিকে থাকা অন্যতম প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্য। এটি শুধু চীনই নয়, পুরো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি। ওয়াংজো প্রদেশের এই এলাকাটি প্রথম চীনা এলাকা যা কি না সবচেয়ে আগে ইসলামের সংস্পর্শে আসে।
ট্যাং রাজবংশের সময় মুসলমানরা সিল্করুট হয়ে চীনে আসত। তখনই প্রথম স্থাপিত হয় মসজিদটি। ধারণা করা হয়, মসজিদটি নির্মাণ করেন প্রখ্যাত সাহাবী হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)। মসজিদটি নানাসময়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবে বারবারই পুনর্নির্মিত হয়েছে। ১৬৯৫ সালে একবার আগুন লেগে মসজিদের ক্ষতি হয়। পরে আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়। মসজিদটি ৩,৬০০ বর্গ মিটার এলাকা দখল করে আছে। মসজিদের সীমানার মাঝেই আছে ওয়াংজো ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন এবং হুই হিস্টোরিক্যাল কালচারাল রিসার্চ সোসাইটি। মসজিদটি এখনও মুসল্লীদের আগমনে জীবন্ত থাকে। শুক্রবারে কমপক্ষে দু’হাজার মুসল্লী এখানে জুম’আর নামাজ আদায় করেন।
মসজিদটিতে ঐতিহ্যবাহী চীনা স্থাপত্যরীতি ও আরবীয় স্থাপত্যরীতির মিশ্রণ ঘটেছে। প্রাচীন মসজিদটির বেশ কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য আছে। প্রধান বৈশিষ্ট্য এর ৩৬ মিটার উঁচু সাদা মিনার। এটি একসময় বাতিঘর হিসেবে কাজ করতো। এখন পর্যন্ত মিনারটি এই এলাকার সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা।
মসজিদের সামনে প্রশস্ত চত্বর। চত্বর শেষ হয়েছে করিডোরে। করিডোরের পর কেন্দ্রীয় প্রার্থনাক্ষের প্রবেশপথ। লাল ইটের তৈরি ভবনটির ছাদে নীল-সবুজ টাইলসের কারুকাজ দৃশ্যমান। ভেতরের দেয়াল ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সাজানো। মহিলাদের নামাজের জন্য রয়েছে আলাদা জায়গা। প্রার্থনাক্ষের দক্ষিণ-পশ্চিমে আছে একটি পুরোনো প্যাভিলিয়ন। সেখানে ঠাঁই পেয়েছে একটি পাথরের ফলক। মসজিদের করিডোরের পশ্চিম দিকের দেয়ালে পাথরে খোদাই করে লেখা ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা। মসজিদের সামনে রয়েছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট যেগুলো হালাল খাবারের জন্য বিখ্যাত।
নিউজি মসজিদ
বেইজিংয়ের শিচেং জেলার নিউজি সড়কে অবস্থিত নিউজি মসজিদ। এটি চীনের একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মসজিদ। ৯৯৬ সালে প্রথম নির্মিত হয় মসজিদটি। ৭,০০০ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত মসজিদটিতে মিশ্রণ ঘটেছে চীনা ও ইসলামী স্থাপত্যরীতির। গঠনগত দিক থেকে মসজিদ ভবনটি প্রতিসম। প্রবেশপথ পেরোলে পড়বে মুন টাওয়ার। দোতলা সমান উঁচু টাওয়ারটির ছাদ সোনালি রঙের। এখান থেকে মসজিদের ইমাম সাহবে আগেরদিনে চাঁদ দেখতেন।
৬০০ বর্গ মিটারের প্রার্থনাকক্ষটি কয়েক হাজার মুসল্লী ধারণে সক্ষম। কক্ষের দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি ছাড়াও আঁকা রয়েছে নানা রকম ফুলের ছবি। প্রার্থনাক্ষের বাইরে দুটি প্যাভিলিয়ন আছে, যেগুলোতে আশ্রয় পেয়েছে পাথরের ফলক। ফলকে খোদিত লেখা থেকে মসজিদের ইতিহাস জানা যায়।