রাতের আকাশ যেন এক টাইম মেশিন। কোটি কোটি নক্ষত্রের মহাসম্মেলন সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে মানুষকে করেছে বিস্মিত দর্শক, ভাবুক বোদ্ধা, উদাসীন মুসাফির, বিমুগ্ধ শিল্পী। কী লক্ষ বছর আগের আদিম মানুষ, কী আধুনিক যুগের এই আমরা- সবাই যেন এক ধ্রুবক বৈশিষ্ট্যে একই সূত্রে গাঁথা। নক্ষত্রের রাতের অমোঘ আকর্ষণ যেন মানব মনের প্রাগৈতিহাসিকভাবে পাওয়া এক রহস্যময় মাত্রা। এই বিশ্ব চরাচরের প্রায় সব জায়গা থেকেই আমরা মহাজাগতিক নক্ষত্রদের উপস্থিতি দেখতে পাই। তবুও পৃথিবীতে এমন কিছু স্থান আছে, যেগুলো নক্ষত্রের রাতের জন্য শত সহস্র বছর ধরে বিখ্যাত হয়ে আছে। এরকম অজস্র স্থান থেকে অত্যল্প কিছু স্থানের গল্প নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
আটাকামা মরুভূমি, চিলি
হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত এক ঊষর মালভূমি দক্ষিণ আমেরিকার আটাকামা। আন্দিজ পর্বতমালার পশ্চিমে, প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বতীরে অবস্থিত এই মরুভূমি পৃথিবীর অন্যতম শুষ্কতম স্থান। এখানে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫ মিলিমিটারেরও কম। তবে যতই শুষ্ক হোক তার প্রবহমান বাতাস কিংবা নীরস থাকুক এর লাল পাথুরে উত্তপ্ত জমিন, আটাকামা মরুভূমি সুন্দর তার রাতের সৌকর্যে। রাতের আকাশ দিয়ে মানব মনকে তন্ময় করে দিতে পৃথিবী বিখ্যাত চিলির আটাকামা মরুভূমি।
আটাকামার নক্ষত্রের রাত উপভোগের জন্য ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আলমা (Atacama Large Millimeter/submillimeter Array); পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেডিও টেলিস্কোপ। আলমাতে আছে ১২ মিটার ব্যাসের ৬৬টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টেনা।
হান্টার উপত্যকা, নিউ সাউথ ওয়েলস
নিউ সাউথ ওয়েলসের এক ছোট্ট গ্রাম ব্রুক। মাত্র ৬৩৬ জন অধিবাসীর এই গ্রামটি অস্ট্রেলিয়ার সিঙ্গলটনে অবস্থিত। সিডনী শহর থেকে প্রায় ১৫৭ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামের অধিবাসীরা রাতের আসমান পানে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে কিনা জানা নেই; তবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকেরা এখানে এসে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। হান্টার উপত্যকার আকাশ সাজে লক্ষ কোটি তারার মেলায়।
সাগরমাথা জাতীয় উদ্যান, নেপাল
এভারেস্ট পর্বতের কোলে এক সংরক্ষিত স্থান সাগরমাথা জাতীয় উদ্যান। প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার হেক্টরের বিশাল এলাকা জুড়ে এই পার্কটি নেপালের সলু-খুম্বু জেলায় অবস্থিত। আড়াই হাজারেরও বেশি শেরপার এই আবাসভূমি ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে উদ্যানটি ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়।
ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ, স্পেন
আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত স্পেনের এই দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় হাইকিং ও নক্ষত্র দর্শনের ‘স্বর্গ’। ক্যানারির অন্যতম দ্বীপ সান মিগেল দে লা পালমা (সংক্ষেপে লা পালমা)। সবুজে আচ্ছাদিত এই দ্বীপটি যেন সৌন্দর্যের খনি। এ কারণেই দ্বীপটির আরেক নাম ‘Isla Bonita’; স্প্যানিশ Isla Bonita অর্থ সুন্দর দ্বীপ (Beautiful Island)। ¹
মাউনা কিয়া, হাওয়াই
মাউনা কিয়া হাওয়াই দ্বীপের একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩, ৮০৩ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই আগ্নেয় পর্বতটি হাওয়াইয়ের সবচেয়ে উঁচু স্থান এবং একইসাথে এখানকার বায়ুমণ্ডল প্রচণ্ড শুষ্ক। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই হাওয়াই দ্বীপের মাউনা কিয়া রাতের আকাশ দেখার জন্য একটি বিখ্যাত স্থান।
প্রশান্ত অববাহিকার সর্বোচ্চ বিন্দু এবং পৃথিবীর উচ্চতম দ্বীপস্থ পর্বত মাউনা কিয়াকে বলা হয় ‘White Mountain’; যার উপরে স্থাপন করা হয়েছে মাউনা কিয়া মানমন্দির (Observatory)। হাবল টেলিস্কোপ থেকে ৬০ গুণ বেশি শক্তিশালী এখানকার টেলিস্কোপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই মহাকাশীয় মানমন্দিরটি এগারোটি দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দ্বারা পরিচালিত।
ন্যামবং জাতীয় উদ্যান, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া
দেখলে মনে হবে কোনো কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্রের জন্য তৈরিকৃত স্থান অথবা রূপকথার কোনো কল্পিত জগত। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থ শহর থেকে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত ন্যামবং জাতীয় উদ্যান।
হাজার হাজার চুনাপাথরের স্তম্ভ ‘পিনাকল’-এর বিশাল ভান্ডার পিনাকল মরুভূমি এই উদ্যানেই অবস্থিত। নক্ষত্রের রাত উপভোগের জন্য ক্যাম্পিং করা ছাড়াও পর্যটকেরা এখানে আশেপাশের জীববৈচিত্র্য দেখতে আসেন।²
মাউন্ট ব্রোমো, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভাতে অবস্থিত ২,৩২৯ মিটার উচ্চতার সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ব্রোমো। বিভিন্ন সময় সক্রিয় হয়ে ওঠা এই আগ্নেয় পর্বতের চারপাশের পরিবেশ রাতের বেলা উপহার দেয় কোটি কোটি নক্ষত্রখচিত এক ঝলমলে আকাশ। কখনো বা দেখা যায় উল্কাপাতের বিরল দৃশ্য।
আলকেভা, পর্তুগাল
চিন্তা করে দেখুন তো, মানুষ রাতের আকাশের আঁধারকে রক্ষা করছে শিল্পায়ন ও নগরায়নের আলোক দূষণ থেকে! দক্ষিণ পর্তুগালের আলেনতেখো অঞ্চলের আলকেভা লেক সংলগ্ন এলাকাটি ঠিক এরকমই একটি জায়গা।
পর্যটকেরা এখানে দল বেঁধে যায় রাতের আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত আলকেভার এই Dark Sky Reserve।
আলেনতেখোতে আরো একটি স্থান আছে, যেখানে রাতের আকাশ দেখার জন্য পর্যটকেরা ভিড় করে। এটি হাজার বছরের পুরাতন আলমেন্দ্রেস ক্রমলেখের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটি আলকেভা থেকে ১০০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত।
মিটিয়োরা, গ্রীস
গ্রীসের থেসালিতে অবস্থিত মিটিয়োরা ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। একাদশ শতকের দিকে কিছু সন্ন্যাসীর দ্বারা এখানকার দুর্গম খাড়া অঞ্চলে প্রাচ্যের সনাতন ধর্মীয় ভাবধারার উপর ভিত্তি করে কিছু উপাসনালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জনবিচ্ছিন্ন এই মিটিয়োরা সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি রাতের নক্ষত্রবিধৌত আকাশের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
উলুরু-কাটা জাতীয় উদ্যান, অস্ট্রেলিয়া
শতাব্দী প্রাচীন আনাংগু আদিবাসী ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর তারা ঝলমলে দক্ষিণের আকাশ- এই হলো ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মধ্য অস্ট্রেলিয়ার উলুরু-কাটা জাতীয় উদ্যান।
নুব্রা উপত্যকা, ভারত
নুব্রা লাদাখে অবস্থিত ভারতের উত্তরের উপত্যকা। চারপাশের সুউচ্চ পাহাড় আর উন্মুক্ত বিশাল আকাশ ক্ষণিকের জন্য হলেও মানুষকে ভাবুক করে তুলবে। নুব্রা উপত্যকার রাতের আকাশ যেন এক অন্য রকম অপার্থিব আবহ নিয়ে হাজির হয় সবার সামনে।
বান্দরবান, বাংলাদেশ*
বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার অন্যতম বান্দরবান। ১৯৮১ সালে জেলার মর্যাদা লাভ করা বান্দরবান সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে চলা সাঙ্গু নদীর তীরে অবস্থিত। গুহা, ঝর্ণা আর পাহাড়ের অপরূপ লীলাভূমি বান্দরবান হলো নির্মেঘ রাতের আকাশে অগণিত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করার একটি অন্যতম স্থান।
ফুটনোট:
1. Hughes, H., Flippin, A. L., Duchaine, J., & Murphy, S. (2010). Frommer’s 500 Extraordinary Islands. Frommers. p. 91.
2. Nambung National Park Management Plan 1998-2008 (1998). Management Plan No. 37. Department of Conservation and Land Management, Perth, Western Australia, p. 1.
* বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার প্রতিটি কোণের রাতের আকাশ নক্ষত্রখচিত। সেইন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের ফসলি জমিন, সুন্দরবনের গহীন অরণ্য থেকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, বাংলাবান্ধার সীমান্তসকাশ থেকে পাহাড়ি বন্ধুর পথ- এই জন্মভূমির ‘প্রতিটি’ আনাচে-কানাচের রাতের আসমান যেন একেকটি নক্ষত্রখনি। এই লেখায় বান্দরবান এই সৌন্দর্যের লীলাভূমির একটি প্রতিনিধিত্বকারী উদাহরণমাত্র।
ফিচার ইমেজ – Hayley Jones/flickr.com