Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পিরি রেইসের মানচিত্র: অজানা ইতিহাসের এক টুকরো দলিল

১৯২৯ সাল, তুরস্কের কনস্টান্টিনোপল (বর্তমানে ইস্তাম্বুল) শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘তোপকাপি প্রাসাদের গুদামঘর সাফাইয়ের কাজ চলছে। সেখান থেকে উদ্ধার করা বিভিন্ন মূল্যবান পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে জার্মান গবেষক গুস্তাভ ডিসমানের নিকট প্রেরণ করা হলো। তিনি বেশ সতর্কতার সাথে পাণ্ডুলিপিগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। কয়েক শত বছরের পুরাতন পাণ্ডুলিপিগুলো হাতের স্পর্শে ঝরে পড়তে চায় যেন।

বেশ কিছু পাণ্ডুলিপি পরীক্ষা করার পরে তিনি বেশ পুরনো একটি মানচিত্র খুঁজে পেলেন। হরিণের চামড়ায় আঁকা এই মানচিত্রটির প্রায় অর্ধেক অংশ কোনো কারণে ছিঁড়ে গেছে। আতশ কাঁচের নিচে সেটি মেলে ধরলেন তিনি। তার কাছে বেশ অদ্ভুত লাগলো মানচিত্রটি। তাই সেটি আরো নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করতে লাগলেন তিনি। যতই পরীক্ষা করছিলেন, ততই অবাক হচ্ছিলেন। সমসাময়িক অন্য মানচিত্রগুলো থেকে এটি কিছুটা আলাদা। তিনি আধুনিক যুগের কিছু মানচিত্রের সাথে এটিকে মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। কী অদ্ভুত এই মানচিত্র!

আফ্রিকার সাগরসীমায় অবস্থিত বিভিন্ন দ্বীপের অবস্থান বেশ নিখুঁতভাবে অঙ্কিত আছে এটিতে। তিনি অন্যান্য অঞ্চলের মানচিত্রের সাথে এটি মিলিয়ে দেখলেন। প্রায় কয়েক শত বছর পুরনো সেই মানচিত্রে এমন সব অঞ্চলের সীমানা অঙ্কিত আছে, যা বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানীদের নিকটও অজানা ছিল!

এক নজরে পিরি রেইসের মানচিত্র; Source: Wikipedia

তিনি এই মানচিত্রের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে অবগত করেন। জাদুঘরের গুদামঘর থেকে উঠে এসে গবেষণাগারের টেবিলে স্থান লাভ করে সেটি। পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে আসতে থাকে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। ততদিনে মানচিত্রটিকে বিজ্ঞানীরা একটি নতুন নামও দিয়েছেন। নির্মাতার নামানুসারে এর নাম রাখা হয় ‘পিরি রেইসের মানচিত্র’

পিরি রেইস এবং এক টুকরো কাগজ

পিরি রেইস এর আসল নাম ‘হাজি আহম্মাদ মুহাম্মদ পিরি’। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনা কর্মকর্তা (এডমিরাল) ছিলেন। শখের বসে ভূগোল নিয়ে কাজ করার জন্যও তার খ্যাতি ছিল। দক্ষতার সাথে মানচিত্র অঙ্কনের জন্য তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তুরস্কের সেই বিস্ময়কর মানচিত্রের নিচে বেশ স্পষ্টাক্ষরে পিরি রেইসের স্বাক্ষরকৃত সিলমোহরের ছাপ পাওয়া যায়। তাই মানচিত্রটি পিরি রেইস কর্তৃক অঙ্কিত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পল কেহলে নামক এক প্রাচ্যবিদ এই বিষয়টি প্রমাণ করেন।

এডমিরাল পিরি রেইস; Source: Pinterest

পিরি রেইসের মানচিত্রটি দুই আমেরিকা মহাদেশের অবস্থান সূক্ষ্মভাবে অঙ্কিত রয়েছে, এমন মানচিত্রের মধ্যে প্রাচীনতম। আরবি পঞ্জিকা অনুযায়ী ৯১৯ হিজরি বর্ষে অঙ্কিত হয়েছে মানচিত্রটি। ইংরেজি সনের হিসেবে সময়টা ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দ।

১৪৯২ সালের দিকে ক্রিস্টোফার কলোম্বাস সহ অন্যান্য অভিযাত্রীদের প্রচেষ্টায় আবিষ্কৃত হয় দুই আমেরিকা মহাদেশ। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে অঙ্কিত মানচিত্রটি বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছে। সমসাময়িক ইউরোপের বিখ্যাত মানচিত্রকাররাও এতটা নিখুঁতভাবে মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হননি। তাই শুরু থেকেই বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম হয় এই মানচিত্রকে ঘিরে। কীভাবে পিরি রেইস এই মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হলেন? বিপুল তথ্যসমৃদ্ধ এই মানচিত্রের তথ্যসূত্র কী? এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে পৃথিবীর বিখ্যাত গবেষকগণ এই মানচিত্র নিয়ে কাজ শুরু করেন।

মানচিত্রের তথ্যসূত্র

পিরি রেইসের ব্যক্তিগত নথিপত্র থেকে জানা যায়, তিনি এই মানচিত্র অঙ্কনে প্রায় বিশটি প্রাচীন মানচিত্র এবং ভৌগোলিক পাণ্ডুলিপির সাহায্য নিয়েছেন। এর মাঝে প্রায় দশটি আরবি মানচিত্র, চারটি ভারতীয় মানচিত্র এবং কয়েকটি পর্তুগিজ নাবিকদের মানচিত্র রয়েছে। এই তালিকায় বিশ্বজয়ী বীর আলেকজান্ডারের আমলের মানচিত্রের নামও পাওয়া যায়। এসব মানচিত্রের সাহায্যে পুরো মানচিত্রটি প্রস্তুত করেন পিরি রেইস। পিরি রেইসের মানচিত্রের সাথে ইস্তাম্বুলের যোগসূত্রতা থেকে অধ্যাপক চার্লস হেপগুড ধারণা করেন, পিরি রেইসের নিকট প্রাচীন কনস্টান্টিনোপলের হারিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রুসেডে কনস্টান্টিনোপলের পতনের পূর্বে এটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। ভূগোল চর্চায় কনস্টান্টিনোপলের ভূতাত্ত্বিকগণ অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। ক্রুসেড পরবর্তী সময়ে নানা কারণে তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি ধ্বংস হয়ে যায়।

এই মানচিত্র অঙ্কনে প্রায় বিশটি প্রাচীন মানচিত্র এবং ভৌগোলিক পাণ্ডুলিপির সাহায্য নিয়েছেন পিরি রেইস; Source: CORE SPIRIT

পিরি রেইসের মানচিত্রের তথ্যগুলো সমসাময়িক কোনো ইউরোপীয় পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়নি। তাই ধারণা করা হয়, তিনি ইউরোপ বহির্ভূত অন্যান্য উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। পুরো মানচিত্রটি দ্রাঘিমারেখা এবং অক্ষরেখার হিসেব ছাড়াই অঙ্কিত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, তিনি মানচিত্রটি অঙ্কন করতে বিশেষ পদ্ধতিতে কম্পাস ব্যবহার করেছেন। যার ফলে মানচিত্রের বিভিন্ন সীমারেখার হিসেব অত্যন্ত নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত করা সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে মহাকাশ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে আমাদের পৃথিবীকে যেরকম দেখা যায়, পিরি রেইসের মানচিত্রেও পৃথিবীর রূপ ঠিক সেরকম।

আধুনিক প্রযুক্তি এবং জ্যামিতির সাহায্য ছাড়াই পিরি রেইস কীভাবে একটি নিখুঁত মানচিত্র অঙ্কন করেছেন, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মুগ্ধতার শেষ নেই।

মানচিত্রের কথা

বর্তমানে পিরি রেইসের যে মানচিত্রটি বিজ্ঞানীদের সংরক্ষণে আছে, তা মূলত মূল মানচিত্রের প্রায় অর্ধেক অংশ। কোনো অজানা কারণে মানচিত্রের বাকি অংশ আবিষ্কারের পূর্বেই হারিয়ে গেছে। উদ্ধারকৃত পিরি রেইসের মানচিত্রে আফ্রিকা মহাদেশ, পশ্চিম ইউরোপ এবং দুই আমেরিকা মহাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত আছে। মানচিত্রে বাদ যায়নি সর্বদক্ষিণের জনমানবহীন মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকাও। তবে এই তুষারাবৃত মহাদেশকে নিয়েই বিজ্ঞানীদের যত বিস্ময়। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চলুন ঘুরে আসা যাক পিরি রেইসের রহস্যপুরী থেকে।

মানচিত্রটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, এর ভেতরে মহাদেশগুলোর নদী, উঁচু ভূমি, পর্বতমালা, গিরিপথসহ বিভিন্ন ভৌগোলিক রূপ সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রতিটি মহাদেশের পেছনের পাতায় আরবি হরফে লেখা তুর্কি ভাষার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জুড়ে দেয়া হয়েছে। আফ্রিকা এবং ব্রাজিল উপকূলের সীমারেখা বেশ সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হলেও অন্যান্য মহাদেশগুলোর সীমারেখায় যথেষ্ট গরমিল দেখা দেয়।

পিরি রেইস দক্ষতার সাথে মানচিত্রের অভ্যন্তরের ভৌগোলিক রূপ ফুটিয়ে তুলেন; Source: diegocuoghi.com

ইউরোপের মানচিত্রে ইবেরিয়া, গুয়াডাল্কুইভির, ওবারসহ প্রভৃতি প্রাচীন নদীর অবস্থান তুলে ধরা হয়। কিন্তু ইউরোপের ভূতাত্ত্বিকগণ নদীগুলোর অবস্থান সঠিক নয় বলে দাবি করেন। বর্তমান ডেনমার্কের অধীনস্থ গ্রিনল্যান্ড দ্বীপের মানচিত্রটিও অদ্ভুত। পরবর্তীকালে গবেষকরা নিশ্চিত হন যে, পিরি রেইস দক্ষভাবে বরফের নিচে ঢাকা পড়া গ্রিনল্যান্ডের সীমারেখা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।

আফ্রিকার সীমারেখা সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হলেও সাহারা মরুভূমির বর্ণনায় সামান্য ভুল পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, পিরি রেইস তার সময়ের আরো এক হাজার বছর পূর্বের সাহারার মানচিত্র এঁকেছেন। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, প্রাচীন সাহারার মানচিত্র একজন তুর্কি এডমিরালের কী কাজে আসতে পারে? এই বিষয়ে হেপগুড কৌতুক করে বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আপনি সাহারায় নেমে প্লাইস্টোনিক যুগে কোথায় পানি পাওয়া যেত সেটার সন্ধানে মরবেন না!”  

উত্তর আমেরিকার পশ্চিমের দ্বীপপুঞ্জগুলো সম্ভবত এশিয়া; Source: The Epoch Times

পিরি রেইসের সময়ে উত্তর আমেরিকা সম্পর্কে মানুষের তেমন জানাশোনা ছিল না। পিরি রেইসের মানচিত্রে এই না জানার বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, এই মানচিত্রে উত্তর আমেরিকার পশ্চিমে বেশ কিছু দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বাস্তবে উত্তর আমেরিকার পশ্চিমে এরূপ কোনো দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান নেই। বিজ্ঞানী রবার্ট বাইওয়াটারJournal of Spatial Sciencevol’ এর ২০০৪ সংস্করণে এ বিষয়ে একটি তত্ত্ব প্রদান করেন। তার মতে, পিরি রেইস তার মানচিত্রে দ্বীপপুঞ্জের দ্বারা এশিয়া মহাদেশকে বুঝিয়েছেন। কারণ, তৎকালীন অনেক মানচিত্রকারই এশিয়ার সাথে উত্তর আমেরিকার সংযোগ বিদ্যমান বলে বিশ্বাস করতেন। এমনকি ১৬৩৪ সালে জঁ নিকোলে নামক এক নাবিক উত্তর আমেরিকা থেকে পশ্চিমে ভ্রমণ করে চীনে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিলেন।

পিরি রেইসের মানচিত্র নিয়ে গবেষণায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেন চার্লস হেপগুড (মাঝে, কালো শার্ট পরিহিত); Source: Keene State College

অ্যান্টার্কটিকার জট এবং অজানা ইতিহাস

অন্যান্য মহাদেশের সীমারেখায় সামান্য ভুল থাকলেও বর্তমান যুগের মানচিত্রের সাথে পিরি রেইসের মানচিত্রের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ঝামেলা বাঁধে অ্যান্টার্কটিকার বেলায়। এরকম অদ্ভুত অ্যান্টার্কটিকার মানচিত্র এর আগে কখনও দেখেনি কেউ। পিরি রেইস তার মানচিত্রে অ্যান্টার্কটিকার সাথে দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনার উপকূলের সংযোগ দেখান। কিন্তু পৃথিবীর মানচিত্রে চোখ বুলালে অ্যান্টার্কটিকার সাথে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের কোনো সংযোগ লক্ষ্য করা যায় না।

পিরি রেইসের দৃষ্টিতে অদ্ভুত অ্যান্টার্কটিকা; Source: The Epoch Times

একটা সময়ে বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলেন, পিরি রেইস সম্ভবত নিজের মনের খেয়ালে কাল্পনিকভাবে অ্যান্টার্কটিকার মানচিত্র এঁকেছেন। অনেকেই এই তত্ত্ব মেনে নিলেন। কিন্তু আইসল্যান্ডের ভূতাত্ত্বিক ওলাফর ইনগলফসন হাল ছেড়ে দেননি। তিনি দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়ে যান। কয়েক বছর গবেষণার পর তিনি সেই মানচিত্রে অ্যান্টার্কটিকার রহস্যভেদ করতে সক্ষম হন।

তিনি তত্ত্ব প্রদান করেন, বর্তমানের অ্যান্টার্কটিকার প্রায় ৯৮% বরফের নিচে ঢাকা পড়ে আছে। কোনোক্রমে যদি অ্যান্টার্কটিকার সম্পূর্ণ বরফ গলিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, তাহলে যে নতুন অ্যান্টার্কটিকার জন্ম হবে, তা পিরি রেইসের মানচিত্রের সাথে সম্পূর্ণ সদৃশ। তার এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে নতুনভাবে গবেষণা শুরু হয়। ১৯৬১ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর ক্যাপ্টেন লরেঞ্জো বোরো অ্যান্টার্কটিকার সীমারেখা নিয়ে গবেষণা করেন। গবেষণার মাধ্যমে তিনি পিরি রেইসের অ্যান্টার্কটিকার সত্যতার প্রমাণ পান। তিনি গবেষণা শেষে চার্লস হেপগুডের নিকট একটি পত্র প্রেরণ করেন। চার্লস হেপগুড বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের পর ক্যাপ্টেন লরেঞ্জোর সাথে একমত হন। তাদের মতে, পিরি রেইস তার মানচিত্রে ৩০০ বছর পূর্বের অ্যান্টার্কটিকার সীমারেখা তুলে ধরেছেন।

বর্তমান যুগের অ্যান্টার্কটিকা; Source: The Epoch Times

এবার বিজ্ঞানীরা হাঁফ ছাড়লেন। যাক! অ্যান্টার্কটিকার জট তো খুললো। কিন্তু চার্লস হেপগুড মুচকি হাসেন। কারণ, তার কাজ তখনও শেষ হয়নি। বলতে গেলে, কাজ শুরু হলো মাত্র!

পিরি রেইসের মানচিত্রের সাথে আধুনিক মানচিত্রের তুলনা করে দেখা গেলো, অ্যান্টার্কটিকা পূর্বের তুলনার কিছুটা স্থান পরিবর্তন করেছে। হেপগুড হিসেব করে দেখলেন, অ্যান্টার্কটিকা তার অবস্থান থেকে প্রায় ১৫ ডিগ্রী সরে গেছে। পিরি রেইস যেন এক অজানা গল্প শোনাচ্ছেন তার মানচিত্র দিয়ে। হেপগুডের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১১ হাজার বছর পূর্বে এই স্থানচ্যুতি শুরু হয়েছিলো।

স্বয়ং বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন হেপগুডের গবেষণায় মুগ্ধ হয়ে যান। তিনি এই বিষয়ে মন্তব্য করেন,

“ভবিষ্যতে অ্যান্টার্কটিকার এরূপ স্থান পরিবর্তন ভূপৃষ্ঠে একধরনের আন্দোলন সৃষ্টি করবে। যার ফলে দুই মেরু ধীরে ধীরে বিষুবরেখার দিকে ঝুঁকে পড়বে।” 

পরবর্তীতে জন তারাদুনু, অ্যাডাম মালুফসহ বেশ কয়েকজন নামকরা ভূতাত্ত্বিক হেপগুডের ন্যায় অ্যান্টার্কটিকার স্থানচ্যুতি নিয়ে তত্ত্ব প্রকাশ করেন।  তাদের মতে, অ্যান্টার্কটিকার স্থানচ্যুতি ঠিক ১১ হাজার বছর পূর্বে হয়নি। প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে অ্যান্টার্কটিকায় এই পরিবর্তন আসা শুরু করে।

সামান্য একখণ্ড কাগজ থেকে মিলিয়ন বছর পূর্বের ইতিহাস জানা হয়ে গেলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পিরি রেইসের মানচিত্রের বাকি অংশ এখনও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাই অন্ধকারেই রয়ে গেছে আরো অজানা ইতিহাস।

সংরক্ষণ

পিরি রেইসের মানচিত্রটি বর্তমানে তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদের বিশেষ কুঠুরিতে সংরক্ষিত আছে। অতিরিক্ত তাপে মানচিত্রের কাগজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়নি। কর্তৃপক্ষের অনুমতির মাধ্যমে গবেষকগণ মানচিত্রটি ব্যবহার করতে পারেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে পিরি রেইসের মানচিত্রের ৫০০ বছর পূর্তি হয়। এই উপলক্ষ্যে ইস্তাম্বুলে মাত্র ২০ দিনের জন্য মানচিত্রটি দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিলো।

তোপকাপি প্রাসাদের অভ্যন্তরের ছবি; Source: askideas.com

পিরি রেইসের মানচিত্রের মাধ্যমে আমরা অতীতের অনেক অজানা তথ্য জানতে পারি। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, প্রাচীনকালে বিজ্ঞানীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞানে কতটা এগিয়ে ছিলেন। এই মানচিত্র ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে মানচিত্রের বাকি অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হলে হয়তো আরও অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।

ফিচার ইমেজ: Travel Atelier

Related Articles