রাশিয়ায় মরুভূমি রয়েছে – এই তথ্য যে অনেককেই হতচকিত করবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র রুশ ফেডারেশন মরুর দেশ নয়, মেরুর দেশ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, রাশিয়াকে মানুষ বরফের দেশ হিসেবেই জানে, এবং এই ধারণাটি বহুলাংশে সঠিক। কিন্তু রাশিয়ায় মেরু/তুন্দ্রা অঞ্চলের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ স্তেপ/তৃণভূমি ও তৈগা/সরলবর্গীয় বৃক্ষের বন রয়েছে। কেবল তাই নয়, ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোকে ‘অর্ধ–মরুভূমি’ (semi-desert) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
অবশ্য রাশিয়ায় সত্যিকার মরুভূমিও রয়েছে, তা-ও কেবল একটি স্থানে নয়, একাধিক স্থানে। অবশ্য রুশ মরুভূমিগুলো আয়তনের দিক থেকে ক্ষুদ্র। রাশিয়ায় অবস্থিত এরকমই একটি ক্ষুদ্র মরুভূমির নাম ‘চারা বালুভূমি’।
চারা বালুভূমি (রুশ: Чарские пески, ‘চারস্কিয়ে পেস্কি’) রাশিয়ার ট্রান্সবৈকাল সীমান্ত প্রদেশের (রুশ: Забайкальский край, ‘জাবায়কালস্কি ক্রাই’) কালারস্কি জেলায় (রুশ: Каларский район, ‘কালারস্কি রায়ন’) অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মরুভূমি। এটি চারা গ্রামের ৯ কি.মি. দক্ষিণ–পশ্চিমে কোদার পর্বতশ্রেণির পাদদেশে চারা নিম্নভূমিতে অবস্থিত। চারা, মধ্য সাকুকান আর উচ্চ সাকুকান – এই তিনটি নদীর উপত্যকায় চারা বালুভূমির অবস্থান।
চারা বালুভূমি থেকে ৯ কি.মি. দক্ষিণ–পূর্বে ‘বিএএম নোভায়া চারা’ রেল স্টেশন অবস্থিত। বালুভূমিটির চারপাশে তৈগা ও জলাভূমি অবস্থিত। অর্থাৎ চারা বালুভূমি এমন একটি মরুভূমি, যেটির চারপাশে হ্রদ, নদী ও বরফাচ্ছাদিত পর্বতশৃঙ্গ অবস্থিত। ব্যতিক্রমধর্মী এই বালুভূমিটি কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূতাত্ত্বিক প্রাকৃতিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
বালুভূমিটি দক্ষিণ–পশ্চিম থেকে উত্তর–পূর্বে অনুকূল বায়ুপ্রবাহের দিকে ৯ কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এটির প্রস্থ প্রায় ৪ কি.মি.। প্রায় ৩০ বর্গ কি.মি. অঞ্চল জুড়ে বালুভূমিটি অবস্থিত। চারা বালুভূমির একেকটি বালুর স্তূপের উচ্চতা ১৫০ থেকে ১৭০ মিটার এবং উচ্চতা প্রায় ৮০ মিটার। বালুভূমিটির উত্তর–পূর্ব দিক প্রায় ৩২ ডিগ্রি পর্যন্ত ঢালু। ট্রান্সবৈকালিয়া তো বটেই, সমগ্র সাইবেরিয়ার অন্য কোনো স্থানে এরকম মরু অঞ্চল নেই। এজন্য ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে চারা মরুভূমি সাইবেরিয়ার খুবই ব্যতিক্রমধর্মী একটি স্থান।
বাহ্যিকভাবে চারা বালুভূমি মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত বৃহৎ মরুভূমিগুলোর (যেমন: কারাকুম, কিজিলকুম প্রভৃতি) অনুরূপ। এখানকার গাছগাছালি তৈগা থেকে খানিকটা আলাদা। এই তৈগায় লার্চ, ক্ষুদ্র বার্চ আর আর্দ্রতা–পছন্দকারী ক্ষুদ্র পাইন গাছ রয়েছে। চারা বালুভূমির উত্তর–পূর্বে দুটি ক্ষুদ্র হ্রদ অবস্থিত, যেগুলোর নাম ‘আলিয়োনকা’ এবং ‘তায়োঝনোয়ে’। ২০১০ সাল থেকে চারা বালুভূমিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ট্রান্সবৈকালিয়ার সপ্তাশ্চর্যে’র একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ক্ষুদ্র মরুভূমিটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ট্রান্সবৈকালিয়া সীমান্ত প্রদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তসংস্থান বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওপরে ন্যস্ত।
চারা বালুভূমি একটি প্রকৃত মরুভূমি, কিন্তু এর চতুর্দিকে রয়েছে হ্রদ, নদী এবং পর্বতশৃঙ্গ। এই বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে অদ্ভুত মরুভূমি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কারণ বিশ্বের অন্যত্র এরকম কোনো মরুভূমির দেখা পাওয়া কঠিন, যেটির ঠিক আশেপাশে একই সঙ্গে হ্রদ, নদী, তৈগা আর পর্বতমালা অবস্থিত।
অবশ্য কিছু কিছু দিক থেকে এটি একটি সাধারণ মরুভূমি যেটিতে উঁচু বালুর স্তূপ রয়েছে এবং যেখানে প্রায়ই বালুঝড় দেখা দেয়।
কিন্তু এই ক্ষুদ্র মরুভূমিটি তৈগা, নদী, জলাভূমি ও ঝর্ণা দ্বারা পরিবেষ্টিত। তাই এই মরুভূমি অতিক্রমকারীদের পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করার কোনো আশঙ্কা নেই।
শুধু তা-ই নয়, এই অদ্ভুত বালুময় ভূমি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে বরফাবৃত কোদার পর্বতমালা ও আরেকটু দূরে উদোকান পর্বতমালা অবস্থিত। এখানে আসা পর্যটকরা তাই মরুভূমি দেখার পর ইচ্ছে হলে পাহাড়ি অঞ্চলেও ঘুরে আসতে পারে। বহু পর্যটকই চারা মরুভূমি পরিদর্শনের পরে ট্রেকিংয়ের উদ্দেশ্যে কোদার পর্বতমালা অভিমুখে যাত্রা করে। ভৌগোলিক দিক থেকে এটি খুবই বিরল একটি ব্যাপার, কারণ বিশ্বের খুব কম জায়গাতেই উজ্জ্বল হলদে বালির স্তূপ আর বরফাচ্ছন্ন পর্বতমালাকে কাছাকাছি দেখা যায়, আর চারা বালুভূমির ক্ষেত্রে মরু আর পাহাড়কে যেরকম একেবারে পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায়, সেরকম আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে।
কোনো কোনো ভূগোলবিদের মতে, প্রায় ৪০,০০০ বছর আগে চারা মরুভূমির উৎপত্তি হয়েছিল। আবার কারো কারো বক্তব্য অনুযায়ী, এই মরুভূমিটি আরো পুরনো এবং ৫৫,০০০ থেকে ১,০০,০০০ বছর আগে এর উৎপত্তি হয়েছে। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলে একটি হ্রদ ছিল। কালক্রমে সেটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায় এবং চারা মরুভূমির সৃষ্টি হয়।
চারা মরুভূমি যেহেতু সাইবেরিয়ার গভীরে অবস্থিত, কাজেই এই কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক যে, সাইবেরিয়ার তীব্র শীতকালে এই মরুভূমিটির পরিস্থিতি কেমন হয়? বস্তুত শীতকালে সাইবেরিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো চারা মরুভূমিও বরফাবৃত হয়ে পড়ে এবং সেসময় সেখানকার তাপমাত্রা কখনো কখনো -৫০° সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়!
মরুভূমিটি হঠাৎ করেই এক স্থানে শেষ হয়ে গেছে। মরুভূমিটি আর তার পার্শ্ববর্তী জঙ্গলের মধ্যে কোনো অন্তর্বর্তী অঞ্চল/ভূমি (transition zone) নেই। চারা মরুভূমির শেষ প্রান্তে দুইটি ক্ষুদ্র হ্রদ – আলিয়োনকা এবং তায়োঝনোয়ে – অবস্থিত এবং হ্রদ দুইটি অতিক্রম করলেই সাইবেরীয় তৈগার দেখা পাওয়া যায়। শীতকালে এই হ্রদ দুইটি পুরোপুরি জমে বরফে পরিণত হয়।
বাতাসের কারণে মরুভূমিটির বালু উড়ে ধীরে ধীরে উত্তর–পূর্ব দিকে এবং পার্শ্ববর্তী তৈগা অভিমুখে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, সময়ের পরিক্রমায় হয়তো মরুভূমিটির ভৌগোলিক অবস্থান এখনকার অবস্থানের চেয়ে ভিন্ন হয়ে যাবে! অবশ্য এটি খুবই সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া, যেটি সম্পন্ন হতে শত শত বছর লেগে যেতে পারে।
চারা মরুভূমি একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। অনেকেই হলদে মরুভূমি আর শ্বেত বরফাচ্ছন্ন পর্বতকে পাশাপাশি দেখার উদ্দেশ্যে এখানে বেড়াতে আসে। মরুভূমি থেকে সবচেয়ে কাছের মানব বসতিটি (চারা গ্রাম) মাত্র ৯ কি.মি. দূরে অবস্থিত। কিন্তু তার পরেও সরাসরি মরুভূমিটিতে পৌঁছানো কিছুটা কঠিন।
প্রথমে বিমানে অথবা রেলগাড়িতে করে চারা গ্রামে পৌঁছাতে হয়। এরপর মরুভূমিটিতে পৌঁছানোর জন্য মধ্য সাকুকান আর চারা নদীদ্বয় অতিক্রম করতে হয়। এই নদীগুলো তীব্র স্রোতের জন্য প্রসিদ্ধ। অবশ্য একবার মরুভূমিটিতে পৌঁছানোর পর পর্যটকরা যে একটি বিচিত্র ও চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা লাভ করেন, সেটি বলাই বাহুল্য।