ইউরেশিয়ান স্তেপ এর নাম আমরা কম-বেশি সবাই শুনেছি। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যভাগে অবস্থিত বিস্তীর্ণ এই তৃণভূমির সাথে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের ইতিহাস। কত সভ্যতা বা সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটেছে এই স্তেপকে কেন্দ্র করে, আবার কত সভ্যতা বা সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেছে খড়কুটোর মতো!
স্তেপ মূলত একধরনের বাস্তু-অঞ্চল। প্রকৃতিকভাবে পার্বত্য গুল্মময় এলাকা, নাতিশীতোষ্ণ তৃণভূমি, সাভানা ও বিস্তৃত জীব-অঞ্চলকে স্তেপ (Steppe) বলা হয়। নদী বা হ্রদের তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এ অঞ্চল পুরোটাই থাকে সবুজে আচ্ছাদিত।
সাধারণত খুব বেশি বৃক্ষরাজি এই অঞ্চলে জন্মায় না। স্তেপ অঞ্চলে মূলত আবহাওয়ার সাথে বাহ্যিকতার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কখনো আংশিক মরুভূমি, কখনো তৃণ ও সবুজে আচ্ছাদিত। এ অঞ্চলের মাটি সাধারণত হিউমাস-সমৃদ্ধ ও কালো হয়ে থাকে।
হলিউড মুভিতে প্রায় আমরা স্তেপ দেখে থাকি। ঝলমলে নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ যেন স্পর্শ করছে দূরের পাহাড়ে বিছানো সবুজের চাদরকে! বিখ্যাত টিভি সিরিজ গেম অভ থ্রোন্স-এর বেশ কিছু অংশ চিত্রায়িত হয়েছে বুলগেরিয়ার বিস্তৃত স্তেপ জুড়ে।
ইউরেশিয়ান স্তেপকে গ্রেট স্তেপও বলা হয়ে থাকে। এটি বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, মলদোভা থেকে ইউক্রেন হয়ে রাশিয়া, কাজাখস্তান, চীনের জিনজিয়াং এবং মঙ্গোলিয়া হয়ে মঞ্চুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এর মধ্যে প্যাননোনিয়ান স্তেপের অধিকাংশ অঞ্চল হাঙ্গেরিতে অবস্থিত।
প্যালিওলিথিক যুগ থেকেই ইউরেশিয়ান স্তেপ রুটটি পূর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, এবং মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়নের উৎকর্ষ সাধন করে আসছে। এই স্তেপ শুধুমাত্র পূর্বযুগ এবং মধ্যযুগের সময়ই সভ্যতা বিকশিত করেনি, বরং আধুনিক যুগ এবং বর্তমানে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে এই ইউরেশিয়ান স্তেপ-বেল্টকে কেন্দ্র করে।
ইউরেশিয়ান স্তেপের সাথে জড়িত আছে বহু জাতির উত্থান-পতন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। জড়িয়ে আছে অনেক সভ্যতা।
জিয়ানগনু, সিথিয়া, সিমেরিয়া, সারমটিয়া, হানিক সাম্রাজ্য, কোরাসমিয়া, সোগডিয়ানা, জিয়ানবি, মঙ্গোলিয়ানসহ ইতিহাসের অনেক যাযাবর সাম্রাজ্য ও উপজাতীয় রাজ্যের উৎপত্তিস্থল ও সাংস্কৃতিক তীর্থ ছিল ইউরেশিয়ান স্তেপ। দানিয়ুব নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত কয়েক হাজার মাইলব্যাপী বিস্তৃত ছিল এই স্তেপ।
ভৌগোলিক অবস্থান
উত্তরে এটি রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশ, এশিয়ার কিছু অংশ এবং সাইবেরিয়ার বিস্তৃত বনভূমি দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। আর দক্ষিণে রয়েছে বিস্তীর্ণ উষ্ণ তৃণভূমি। বলতে গেলে দক্ষিণে স্পষ্ট কোনো সীমানা নেই। কয়েক হাজার মাইলব্যাপী বিস্তৃত এই স্তেপটি দুটি পয়েন্টে সংকুচিত হয়েছে। সেই অর্থে এই ইউরেশিয়ান স্তেপকে তিনটি মূল ভূখণ্ডের বিভক্ত করা যায়।
১. পশ্চিম স্তেপ
পশ্চিম অংশকে পন্টিক ক্যাস্পিয়ান স্তেপ বলা হয়ে থাকে। এটি দানিয়ুব উপকূল থেকে শুরু হয়ে রাশিয়ার কাজান এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উরাল পর্বতমালার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। ক্যাস্পিয়ান স্তেপ দক্ষিণ-পূর্বে কৃষ্ণ সাগর এবং কাস্পিয়ান সাগরের মধ্যে ককেশাস পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
পন্টিক ক্যাস্পিয়ান স্তেপের উত্তর অংশটি ছিল বিস্তৃত বনভূমি সমৃদ্ধ। বর্তমানে এই বনভূমি বিলুপ্ত করে সম্পূর্ণ উর্বর কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। পশ্চিমে গ্রেট হাঙ্গেরিয়ান সমভূমি দ্বারা মূল স্তেপ থেকে ক্যাস্পিয়ান স্তেপ পৃথক হয়েছে।
কৃষ্ণসাগরের উত্তর তীরে ক্রিমিয়ান উপদ্বীপের কিছু উপকূলীয় স্তেপ মূল ক্যাস্পিয়ান স্তেপের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এই অংশের সাথে জড়িত রয়েছে ভূমধ্যসাগরের অববাহিকায় গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি সভ্যতার ইতিহাস।
২. সেন্ট্রাল স্তেপ
সেন্ট্রাল স্তেপকে কাজাখ স্তেপ বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণে এটি মরুভূমি এবং দুটি বিখ্যাত নদী আমু দরিয়া তথা অক্সাস ও সিরি দরিয়া তথা জেকার্তেস দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। আরাল সাগরে পতিত হওয়া সেই দুই নদী ওই অঞ্চলের কৃষি ও সেচ কাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ ফারগানা উপত্যকা এবং এর পশ্চিমে জেরভশন নদীর তীরবর্তী তাসখন্দ সমরকন্দ এবং বোখারার ঐতিহাসিক শহরগুলো।
৩. পূর্ব স্তেপ
এই অংশটি চীনের শিনজিয়াং প্রদেশ এবং মঙ্গোলিয়া জুড়ে বিস্তৃত। পশ্চিমে জঞ্জারিয়া তারাবাগাতাই পর্বতমালা দ্বারা সীমাবদ্ধ। এর জঞ্জারিয়া প্রান্তে রয়েছে মরুভূমি। তবে মরুভূমির চারপাশে বিস্তীর্ণ সবুজ ও তৃণভূমিও রয়েছে। এই স্তেপটি মঙ্গোলিয়ানদের সভ্যতার সাথে জড়িত। চেঙ্গিস খানের পাশ্চাত্যে আক্রমণ প্রসারের ক্ষেত্রে এই স্থানটি মূল ভিত্তি ছিল।
এই অঞ্চলটি কিছুটা শুষ্ক এবং উষ্ণ। তবে চারপাশের পাহাড় থেকে নেমে আসা নদী কৃষি ও সেচ কাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মূলত সেই সময় এই নদীগুলোকেই ভিত্তি করে আশপাশের শহরগুলো অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ইতিহাস
এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণতার মতো ইতিহাসও অনেক বিস্তৃত। বিস্তীর্ণ সমভূমি হওয়ায় এ অঞ্চলে ঘোড়া খুব জনপ্রিয়। অসংখ্য যুদ্ধ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার উত্থান পতনের ইতিহাস জড়িত রয়েছে এই স্তেপকে কেন্দ্র করে। মঙ্গোলীয় সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটেছিল এই স্তেপকে ভিত্তি করেই। এই অঞ্চলের যাযাবরদের সাথে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যের সৈন্যদের প্রায়ই সংঘাতের সৃষ্টি হতো।
তখন মূলত এ অঞ্চলে স্থায়ী কোনো সম্প্রদায় বসবাস করতো না। যারা বসবাস করতো, তারা যাযাবর নয়তো আদিবাসী। এই অঞ্চলের দখল নিয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিরোধ দেখা দিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চীনারা যখন মঙ্গোলিয়ায় সৈন্য পাঠাত, তখন যাযাবররা পালিয়ে যেত। কারণ তারা তুলনামূলকভাবে সংখ্যায় অনেক কম ছিল।
এছাড়া পুরো স্তেপজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যাযাবরদের একত্রিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা ছিল। তাদের নিজেদের মধ্যেই কৃষিজমি দখল ও পশুপাল চুরি করে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল।
উত্তর সীমান্তের বন্য উপজাতিরা যাযাবরদের বেশ শ্রদ্ধা ও সম্মান করত। পরে দক্ষিণাঞ্চলের কাজাখ জনগোষ্ঠীদের সাথে উপজাতিরা একত্রিত হয়। এরপর বিভিন্ন সময় কৃষি জমি দখল এবং পশুপাল লুট করে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে প্রায় উপজাতি ও যাযাবরদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে থাকত।
ইতিহাসের প্রথম থেকেই মঙ্গোলিয়া এবং চীনাদের মধ্যে বড় ধরনের বিরোধ ছিল। তাদের মধ্যে প্রায়ই যুদ্ধ লেগে থাকত। আর যুদ্ধের যতগুলো ক্ষেত্র আছে, সবগুলোই ছিল এই বিস্তৃত স্তেপের মধ্যেই।
ইউরেশিয়ান স্তেপে অন্তর্গত মঙ্গোলিয়ান স্তেপ ইতিহাসের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত। কারণ এই অঞ্চলের বিরোধ নিয়ে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এসব সংঘর্ষের আগুনেই জন্ম নেন তেমুজিন। যুদ্ধ বিগ্রহ আর ধ্বংসলীলার মাধ্যমে জয় করতে থাকেন একের পর এক রাজ্য। ইতিহাসের পাতায় নাম বদলে তার ঠাঁই হয় ‘চেঙ্গিস খান’ হিসেবে।
বর্তমানে মঙ্গোলিয়ান সরকার চেঙ্গিস খানের স্মরণে মঙ্গোলিয়ান স্তেপে নির্মাণ করেছে বিশালাকৃতির একটি ভাস্কর্য। রাশিয়ার সংস্কৃতিও স্তেপবাসী যাযাবর এবং এশিয়ান যাযাবরদের দ্বারা অনেক প্রভাবিত।
এ অঞ্চলের বিখ্যাত তেনগ্রিবাদ তুরস্ক-মঙ্গোল যাযাবরদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল। সে সময় নেস্টোরিয়ানিজম এবং ম্যানচিইজম তারিম অববাহিকা এবং চীনে ছড়িয়ে পড়ে। তবে তারা কখনও ঐ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম হয়ে উঠতে পারেনি।
এরপর উত্তর ভারত থেকে তারিম অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়ে বৌদ্ধধর্ম এবং চীনে গিয়ে তীর্থস্থলে পরিণত হয়। এরপর ঐ অঞ্চলে ধীরে ধীরে ইসলামের প্রসার ঘটতে থাকে। প্রায় ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে, জঞ্জুরিয়ার পশ্চিমে পুরো স্তেপটি ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে। প্রায় ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই তারিম বেসিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর জঞ্জারিয়া এবং মঙ্গোলিয়ায় তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
সব মিলিয়ে ইতিহাসের পাতায় পাতায় জড়িয়ে আছে ইউরেশিয়ান স্তেপের নাম। সভ্যতা আর সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে এই স্তেপ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বাণিজ্যিকভাবেও এর গুরুত্ব কম নয়।