Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যাট আইল্যান্ড: যে দ্বীপে চলছে বিড়ালের রাজত্ব

জাপানের অধিবাসীদের বিড়ালপ্রীতিটা যেন একটু বেশি বেশিই। এই তো কয়েক বছর আগে একটি বিড়ালের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করা হলো বেশ আড়ম্বড়পূর্ণভাবে। হবেই না বা কেন! সে তো আর যেমন-তেমন বিড়াল নয়; রীতিমতো দীর্ঘ আট বছর ধরে জাপানের পশ্চিমাঞ্চলের একটি স্থানীয় রেলওয়েতে স্টেশন মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে সে! তার নামও ছিল বেশ চটকদার, টামা। টামার স্থানে স্থলাভিষিক্ত করা হয় আরেক বিড়ালকে, যার নাম ‘নিতিমা’। আবার যে ডোরেমন নিয়ে ঘরে-বাইরে বাচ্চাদের যে উচ্ছাস চোখে পড়ে, তার মূল চরিত্রেও আছে সেই বিড়ালেরই রূপ। আজকের লেখা মূলত বিড়ালদের একটি দ্বীপ নিয়ে, যাকে সকলে বিড়ালদ্বীপ বা ক্যাট আইল্যান্ডও বলে থাকে।

জাপানের বিড়ালদ্বীপ; Source: exc-adventures.com

বিড়াল আমরা অনেকেই ভালোবাসি। অনেকে ভালোবেসে নিত্যদিনের সঙ্গী হিসেবে বিড়াল পুষে থাকেন। এমন যদি হয়, আপনার চারপাশে অসংখ্য বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আপনি মনের আনন্দে তাদের সাথে খেলা করছেন। অনেকে হয়তো আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়বেন, আবার অনেকেই হবেন কিংকর্তব্যবিমূড়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন ধারণা কিছুটা কাল্পনিক হলেও, জাপানের বিভিন্ন দ্বীপে এমনটা দেখতে পাওয়া আশ্চর্যজনক কিছু নয়।

বিড়ালদ্বীপের চারপাশের বিড়াল; Source: .straitstimes.com

প্রশান্ত মহাসাগরের ওশিকা উপদ্বীপের তীরবর্তী একটি ছোট্ট দ্বীপ তাশিরোজিমা। দ্বীপটির আয়তন সব মিলিয়ে দেড় বর্গ কিলোমিটারের কাছাকাছি। ১৯৫০ সালের দিকে এই দ্বীপে হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করতো বলে নথিভুক্ত আছে। ক্রমান্বয়ে এই সংখ্যা কমে একশতে এসে ঠেকেছে। তাহলেই বুঝতে পারছেন, এই দ্বীপের চারপাশ কতটা নিরিবিলি আর শান্ত। কিন্তু লোকসংখ্যার কমতি থাকলেও একটি বিশেষ প্রাণীর কমতি নেই এই দ্বীপে, আর তা হলো বিড়াল। দ্বীপটির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে অসংখ্য বিড়াল।

বিড়ালদের খাওয়ার দিতে ব্যস্ত এক স্থানীয়ে; Source: reuters.com

এখানে বিড়ালের সংখ্যা বেড়ে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে, বিড়ালের সংখ্যা মানুষের সংখ্যার প্রায় ছয়গুণের কাছাকাছি হয়ে গেছে। তাই দ্বীপটিতে বেড়াতে গিয়ে মানুষের দেখা পাওয়া না গেলেও, বিড়ালের সঙ্গ আপনাকে পেতেই হবে। আর এ কারণেই ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে বেশ জমে উঠেছে দ্বীপটি। দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক ভিড় করছেন এই দ্বীপে, বিড়ালের অভয়ারণ্য দেখার জন্যে। প্রতিদিন একটি ট্রলার দু’বার আসা যাওয়া করে ভ্রমণপিপাসুদের পারাপারের জন্যে।

প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কী করে এলো এত বিড়াল? এর পেছনের গল্পটিও বেশ মজার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়েও এই এলাকায় বেশ মানুষজন ছিল। তাদের মূল জীবিকা ছিল মৎস্য আহরণ। আর দ্বীপের চারপাশ মাছ শিকারের জন্য বেশ অনুকূলও ছিল। তখন এই দ্বীপে টেক্সটাইলের জন্য এক ধরনের শূককীট উৎপাদন করা হতো। কিন্তু ইঁদুরের যন্ত্রণায় এই কাজ বেশ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। আবার জেলেদের জালগুলোও প্রায় প্রতিদিন কেটে দিচ্ছিল বিচ্ছু ইঁদুরের দল। ইঁদুরের উৎপাতে জেলেরা পড়ে গেল মহা মুশকিলে। আর সেই জেলেরা তেমন সচ্ছলও ছিল না যে, চটজলদি কোনো সমাধান বের করতে পারবে। ফলে তারা সবাই মিলে একটি সিদ্ধান্ত নিল। শহর থেকে কিছু বিড়াল নিয়ে আসা হলো দ্বীপে, আর ছেড়ে দেওয়া হলো অবাধ বিচরণের জন্য। কয়েকদিনের মধ্যেই আশানুরূপ ফল পাওয়া গেল। ইঁদুরের উপদ্রব থেকে খুব সহজেই মুক্তি পাওয়া গেল বিড়ালগুলোর বদান্যতায়।

বিড়ালের মুখে মাছ; Source: kore.am

এদিকে দিন দিন দ্বীপে জীবন ধারণ করা কষ্টসাধ্য হতে লাগল মানুষের জন্য। শুধু মাছ  ধরে আর সেভাবে চলছিল না। পাশাপাশি দ্বীপে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধাও ছিল না। ছিল না কোনো স্কুল, হাসপাতাল, এমনকি বাজারও। আগে বাচ্চাদের একটি স্কুল ছিল, কিন্তু সেটিও বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮৯ সালের দিকে। ফলে লোকজন অন্য জীবিকার সন্ধানে শহরের দিকে স্থানান্তরিত হতে শুরু করে। সুযোগ-সুবিধার অভাবের কারণে অন্য জায়গা থেকেও লোকজনের খুব একটা এই দ্বীপে আসা হতো না। দিন দিন দ্বীপটিতে একদিকে সাধারণ লোকসংখ্যা কমতে থাকে, আর অন্যদিকে বিড়ালদের বংশবিস্তার ঘটতে থাকে। আর এভাবেই দ্বীপে মানুষের চাইতে বিড়ালের সংখ্যা বেশি হয়ে পড়ে।

অসংখ্য বিড়ালের একত্রে অবস্থান; Source: ibtimes.co.uk

যারা কিছুটা শক্ত-সামর্থ্য ছিল বা যাদের কাজ করার কিছুটা ক্ষমতা ছিল, তাদের সকলেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে গেছে। আছেন কেবল ষাটোর্দ্ধ বয়সের বৃদ্ধ জনগণ। তাদের কেউ কেউ মাছ শিকার করেন, আবার কেউ কেউ গাইডের কাজও করে থাকেন। এই বয়স্ক লোকদের আপন বলে কেউ আর সেখানে থাকে না। সকলেই চলে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তাই এই আত্মীয়-স্বজনহীন দ্বীপে বিড়ালগুলোই যেন তাদের একমাত্র অবলম্বন। বিড়ালগুলোকে দেখে-শুনে রাখার জন্যই যেন তাদের বেঁচে থাকা।

এক বৃদ্ধের সাথে কিছু বিড়াল; Source: btls.com

বিড়ালের প্রতি জাপানের অধিবাসীদের অন্য ধরনের স্নেহ-মমতা কাজ করে। কেননা তাদের বিভিন্ন লোকগাঁথায় বিড়াল বারবার এসেছে এক ধরনের আধাত্মিক শক্তি হিসেবে। বিড়ালকে তারা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখে থাকে। জাপানের অনেক ব্যবসায়ী দোকানের সামনে আঙুল নাড়ানো বিড়ালের পুতুল রাখে, কারণ তারা আশা করে, বিড়ালের হাতের থাবা দোকানে ক্রেতা আনতে সাহায্য করবে। এখানকার অধিবাসীদের ধারণা, বিড়াল লালনপালন করলে সৌভাগ্য ও সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

দোকানের সামনে রাখা বিড়াল; Source: mykittycare.com

তবে বেশ ভিন্ন এক কারণে এই দ্বীপের বিড়ালদের একটু অন্য চোখে দেখা হয়। আর তা হলো, ২০১১ সালে ঘটে যাওয়া তুহোকো সুনামি। সুনামিটিতে দ্বীপটির বেশ ক্ষয়-ক্ষতি হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, কিন্তু সৌভাগ্যবশত তেমন কোনো বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি। ফলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, এখানকার বিড়ালগুলোর জন্যই এমনটা সম্ভব হয়েছে। তবে সুনামির জের ধরে অল্প যে ক’জন কমবয়সী সেখানে ছিল, তারাও দ্বীপ ত্যাগ করে। বর্তমানে এটি শুধু বিড়াল আর বৃদ্ধ কিছু মানুষের দ্বীপ হয়ে রয়েছে।

এই দ্বীপের বিড়ালদের সুরক্ষার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে কুকুর পোষা এবং বাইরে থেকে কুকুর নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ২০১৩ সালে টুইটারে বিড়াল দ্বীপের প্রসঙ্গে ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পর্যটকদের নজর কাড়ে এই দ্বীপ। তাশিরোজিমা ছাড়াও জাপানের আরেকটি বেশ জনপ্রিয় বিড়াল দ্বীপ রয়েছে, যেটি আওশিমা নামে পরিচিত। জাপানি ভাষায় এসব দ্বীপকে বলা হয় নেকোজিমা অর্থাৎ বিড়ালের দ্বীপ।

দ্বীপের ঘুরতে আসা পর্যটকরা; Source: japantimes.co.jp

তবে জাপান ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াতেও যথাক্রমে ১৫ থেকে ১৮টি এমন দ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু সেসব দ্বীপ অনেকটাই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে করা। জাপানের এই বিড়াল দ্বীপগুলো প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে। জাপান এই বিড়ালপ্রীতি যে শুধু দ্বীপেই ধরে রেখেছে তেমন নয়, পুরো দেশে ক্যাট-ক্যাফে, ক্যাট-সাইন ও ‘হ্যালো কিটি’ নামে প্রচুর ক্যাট-শপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ক্যাট আইল্যান্ড ছাড়াও জাপানে র‍্যাবিট আইল্যান্ড ও ফক্স আইল্যান্ডও বেশ জনপ্রিয়।

তাশিরোজামায় সূর্যাস্তের দৃশ্য; Source: thedailybeast.com

দ্বীপটির চারপাশ ভীষণ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। এখানে আছে ছোট ছোট পাহাড় আর সবুজের সমারোহ। শহর থেকে দ্বীপে যাওয়ার পথের বোট ভ্রমণটিও বেশ রোমাঞ্চকর। এই নৈসর্গিক বেলাভূমিতে পর্যটকদের ভিড় বসে প্রকৃতির সাথে প্রাণের মিলনমেলা দেখার আনন্দে। তবে বর্তমানে বিড়ালদের রক্ষণাবেক্ষণ বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে এখানে। দ্বীপে বিড়ালদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের অভাব রয়েছে। এদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে বলেই স্থানীয়দের ধারণা।

ফিচার ইমেজ- theatlantic.com

Related Articles