Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লা দি কুইমাদা গ্রানদে: বিষাক্ত সাপের দ্বীপ

দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ দেশটির নাম ব্রাজিল। ব্রাজিলের অধিকাংশ অঞ্চল বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ। প্রকৃতির বিস্ময় আমাজনের অধিকাংশ অংশ জুড়েও আছে ব্রাজিল। অপরিচিত ও বিরল প্রজাতির গাছপালা ও পশুপাখির জন্য বিখ্যাত এখানকার জঙ্গলগুলো। এসব জঙ্গলের প্রতিটি পদক্ষেপে আছে রোমাঞ্চ ও বিস্ময়। গাছগাছালিতে ভরা সেই ধরনের একটি দ্বীপ ‘লা দি কুইমাদা গ্রানদে’, যে দ্বীপকে ঘিরে স্থানীয়দের মাঝে বিরাজ করে ভয় আর আতংক। অনেকের ধারণা, এই দ্বীপে যে একবার যায় তার আর ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।

মানচিত্রে ব্রাজিল; Source: kids.nationalgeographic.com

জনসংখ্যার বিচারে ব্রাজিলের বৃহত্তম শহর সাও পাওলো। সাও পাওলো থেকে প্রায় ৯৩ মাইল দূরে লা দ্যা কুইমাদা গ্রানদে দ্বীপটির অবস্থান। প্রায় ১১০ একর এলাকা জুড়ে দ্বীপটি বিস্তৃত। ধারণা করা হয়, অনেক বছর আগে সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দ্বীপটি ব্রাজিলের মূল শহর হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে অনেক সাপ সেখানে আটকা পড়ে পড়ে। পাথুরে মাটির এই দ্বীপে গাছগাছালিও আছে প্রচুর। আরও আছে পাহাড় আর স্থলের সমন্বয়। অতিথি পাখিদের বিশ্রামের জায়গাও এই দ্বীপ। তাই অনেক ধরনের পাখিও দেখা যায় এই দ্বীপে। তবে কোনো মানুষ বাস করে না এই দ্বীপে। এখনও পর্যন্ত অন্য কোনো বিষাক্ত প্রাণীর খবরও মেলেনি। এ দ্বীপে আছে কেবল বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপ। সাপেদের দ্বীপ বলেই বেশি পরিচিত এই দ্বীপটি, যার কারণে সবাই দ্বীপটিকে স্নেক আইল্যান্ডও বলে থাকে।

দি স্ন্যাকস আইল্যান্ড; Source: jbsolis.com

এই দ্বীপের পুরোটা অঞ্চল জুড়ে রয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। স্থানীয় অনেকের মতে, প্রতি বর্গ মিটারে এক থেকে পাঁচটি সাপের দেখা পাওয়া যায় এখানে। তবে শুধু সাধারণ সাপ হলে হয়তো এতটা বিবেচনায় আসতো না এই দ্বীপ। একটি বিশেষ ধরনের সাপের জন্যে এই দ্বীপ নিয়ে সকলের মাঝে আতংক বিরাজ করে। সাপটির আসল নাম বথরোস ইনসুলারিস, তবে দ্য গোল্ডেন লেন্সহেড নামেই অধিক পরিচিত। এই ধরনের সাপের চামড়ায় কিছুটা হলদেটে আভা আছে, যা সূর্যের কিরণে মোটামোটি সোনালি বর্ণ ধারণ করে। এর ফলে সাপগুলো দেখতে অনেকটা সোনালী রঙের মতো দেখায়। এই সাপগুলো কিন্তু অসম্ভব বিষাক্ত। এ সাপের বিষ মাংসের সাথে মিশে গিয়ে এক ঘন্টার মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মেরে ফেলতে পারে। এই বিষের তেমন কোনো কার্যকরী প্রতিষেধকও নেই।

দ্য গোল্ডেন লেন্সহেড; Source: myths-made-real.blogspot.com

এই ধরনের সাপের প্রজাতি কেবলমাত্র এই দ্বীপেই পাওয়া যায়। সাপগুলো লম্বায় যে খুব একটা বড় হয় তা কিন্তু নয়, ৭০ সেন্টিমিটার থেকে বড়জোড় ১১৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দ্বীপে আসা পাখিরা এদের প্রধান খাবার। কিন্তু শিকারের প্রাচুর্যতা মোটেও খুব বেশি নয়। অনেক কসরত করেই সাপগুলোর শিকার করতে হয় সাপগুলোর। মূলত বিশ্রামের জন্যেই অতিথি পাখিদের এই দ্বীপে আগমন। বেশিরভাগ পাখি বসে গাছের ডালের উপর। শিকার ধরতেই হয়তো সাপেদের গাছে ওঠা শেখা। খুব সতর্কে সাপগুলোর পাখি শিকার করতে হয়। একটু শব্দ হলেই পাখি উড়ে যেতে পারে। আর একবার পাখি উড়ে গেলে আরেকটি শিকার পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য। পাখি ছাড়াও এরা ছোটখাট সরীসৃপ এবং পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে।

গাছের ডালের উপর লেন্সহেড স্ন্যাকস; Source: cobras.org

সাও পাওলোর স্থানীয়দের মাঝে এই দ্বীপ নিয়ে এক ধরনের আতংক বিরাজ করে। পারতপক্ষে কেউ এই দ্বীপে যাওয়ার সাহস করে না। তবে জাহাজ চলাচলের সুবিধার জন্যে এই দ্বীপে একটি লাইট হাউজ নির্মাণ করার প্রয়োজন পড়ে ১৯০৯ সালের দিকে। এরপর থেকে কিছুদিন অন্তর ওখানে লাইট হাউসের বাতি পরিবর্তন করার জন্যে লোক পাঠানো হত। সর্বশেষ এক দম্পতিকে লাইট হাউসের দেখাশোনা করার জন্যে পুরো পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু জনশ্রুতি আছে যে সাপেদের কামড়ে পরিবারের সকলেই মৃত্যুবরণ করে। এরপর সরকার লাইট হাউজে স্বয়ংক্রিয় বাতির ব্যবস্থা করে। সেই থেকে নৌবাহিনীর একটি দল পুরো প্রস্তুতি নিয়ে অর্থাৎ বিশেষ গ্যাস এবং ওষুধ নিয়ে লাইট হাউজের বাতি ও ব্যাটারি পরিবর্তন করতে যায়।

ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে স্ন্যাকস আইল্যান্ডে নৌবাহিনীর দল; wearethemighty.com

মানুষের উপর সাপেদের আক্রমণের আরেকটি কাহিনী প্রচলিত আছে স্থানীয়দের মাঝে। একদিন এক জেলে মাছ ধরতে গিয়ে দ্বীপের কাছে চলে যায়। দ্বীপের কাছাকাছি গেলে দেখে কোনো বসতি নেই সে দ্বীপে, কিন্তু গাছ আছে প্রচুর। দূর থেকে কিছু গাছে পাকা কলা দেখে জেলের লোভ হয়। যেহেতু কোনো জনবসতি নেই, সে ভাবে, এ তো জঙ্গলের কলা। তাই সে কলা নেয়ার জন্যে দ্বীপে প্রবেশ করে। কিন্তু কলা কাটার সময় এক বিষাক্ত সাপ তাকে দংশন করে। কোনো রকমে দৌড়ে নৌকায় আসতে পারলেও কিছুক্ষণের মধ্যে তার সারা শরীর রক্তে ভেসে যায়। পরে তার নিথর দেহটি নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয়। এই কাহিনীর তেমন কোনো সত্যতা পাওয়া না গেলেও সাও পাওলোর অধিবাসীদের মুখে মুখে শোনা যায় এ কাহিনী।

অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় তেড়ে আসা একটি লেঞ্চহেড; Source: aphotoeditor.com

ব্রাজিলে নৌবাহিনীর আদেশানুসারে, ১৯২০ সাল থেকে এই জঙ্গলে সাধারণের প্রবেশ পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ। মূলত জনগণের নিরাপত্তার জন্যেই এমন সিদ্ধান্ত। তবে গবেষণার কারণে বা বিশেষ কোনো বৈধ উদ্দেশ্যে নৌবাহিনীর কাছ থেকে অনুমতি সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে যাওয়া যেতে পারে এই দ্বীপে। কিন্তু সেটা মোটেও সহজসাধ্য নয়। কোনো সাধারণ নৌকা সেখানে যেতে রাজি হয় না। যেতে প্রায় ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগে। তাই কেউ সাপের কামড় খেলে তার আর হাসপাতালে আসার সময়টুকুও পাওয়া সম্ভব নয়।

গোল্ডেন লেঞ্চহেডের সামনের অংশ; Source: latam.discovery.com

তবে ধীরে ধীরে কিছু ভিন্ন ধরনের তথ্য উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। সাপের বিষ নিয়ে গবেষণার জন্যে একটি বায়োফার্মাসিটিকেল গবেষণা কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে অনেক বছর ধরে। সেই গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত মার্সেলো ডুয়ার্তে নামে একজন স্থানীয় বায়োলোজিস্ট গবেষণার কাজে ২০ বারের বেশি এই দ্বীপে গিয়েছেন। তার মতে লোকমুখে এই দ্বীপ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত কথাবার্তা প্রচারিত হয়েছে। প্রচলিত কথাগুলো যদি সত্যি হত, তাহলে এ দ্বীপে পা রাখাই মুশকিল হয়ে যেত।

দ্বীপের মধ্যকার বাতিঘরটি; fitflops-sale.us

ধারণা করা হয়ে থাকে, এখানে দু’হাজারের উপর গোল্ডেন লেন্সহেড রয়েছে এবং দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু মার্সেলোর মতে এখানে সাপের সংখ্যা দিন দিন কমেই চলেছে। বিগত ১৫ বছরে প্রায় ১৫ শতাংশ সাপ কমেছে। সাপেদের সংখ্যা হ্রাসের কারণটাও বেশ অদ্ভুত। এই জঙ্গলের বিষাক্ত সাপগুলো মূলত গবেষণার জন্যে ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে এবং শুধুমাত্র গবেষকরাই উপযুক্ত অনুমতি নিয়ে এই জঙ্গলে আসতে পারে। কিন্তু এই সাপের বিষের বেশ চাহিদা রয়েছে বিশ্ব বাজারে। একজন চোরাচালানকারীর মতে, একেকটি গোল্ডেন স্নেক বিশ থেকে পঁচিশ হাজার ডলার পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে আন্তর্জাতিক বাজারে।

মূলত চোরাচালানীদের জন্যেই সাপের সংখ্যা কমে চলেছে এই দ্বীপের। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও চুপিসারে চোরাচালানকারীরা এই দ্বীপে হানা দেয় আর সাপ আহরণ করে। অর্থের কাছে হয়তো ভয়ও হার মানে। তাই হয়তো বেড়েই চলেছে এই চোরাচালানীদের উপদ্রব।

স্নেকস আইল্যান্ডের পথে; Source: atlasobscura.com

তবে সরকার এ ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগও নেয়া হয়নি এখন পর্যন্ত। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন ফর নেচার এই দ্বীপের সাপদের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে হয়তো অচিরেই সাপশূন্য হয়ে পড়বে এই দ্বীপ।

ফিচার ইমেজ-Source: jbsolis.com

Related Articles