Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সোয়াম্প ফরেস্ট: প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য

বন যেখানে জলের সীমানায় মিশেছে গভীর মায়ায়, যেখানে জলের স্বচ্ছ বুকে গাছের ডাল আর পাতারা প্রতিনিয়ত জলছবি এঁকে চলে, সেখানে পাখিরা গাছের শাখায় বসে অবিরত কিচিরমিচির শব্দে বলে যায় কত না বলা কথা, জলচর পাখিরা জলের আড়ালে খেলে লুকোচুরি। প্রকৃতির এমন মনোহারিণী সৌন্দর্যের পরশে থমকে দাঁড়ায় মানবমন। কী এক অদ্ভুত আবেশে অতি সচেতন মাবমস্তিষ্কও হারিয়ে ফেলে সময়ের হিসেব।

হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক, বলছি সোায়াম্প ফরেস্টের কথা। যে বনভূমি সারা বছর জলে নিমগ্ন থাকে অথবা বর্ষাকালে জলে প্লাবিত হয়ে সাময়িকভাবে জলমগ্ন থাকে, তাকে সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলাভূমির বন বলে। সোয়াম্প ফরেস্ট গড়ে ওঠে সাধারণত লেকের আশেপাশে কিংবা যে এলাকায় নদী নিম্নভূমি হয়ে বয়ে গেছে সেখানে। সেখানে আটকে থাকা পানি হতে পারে মিঠাপানি, নোনাপানি বা কালোপানি (Black water)।

আরেক ধরনের সোয়াম্প ফরেস্ট আছে যাকে পীট সোয়াম্প ফরেস্ট বলে। পীট সোয়াম্প ফরেস্টে জলে নিমজ্জিত মাটি ঝরা পাতা আর মরা গাছপালা সম্পূর্ণরুপে পচাতে পারে না। তখন গাছের কান্ড আর  পাতার আংশিক পচনের ফলে মাটির উপর গাছপালার অবশেষের একটা পুরু স্তর জমা হয়, যাকে পীট বলে। পীটের উপস্থিতিই পীট সোয়াম্প ফরেস্ট আর সাধারণ সোয়াম্প ফরেস্টের মৌলিক পার্থক্য। দুই ধরনের সোয়াম্প ফরেস্টেরই বাস্ততন্ত্র ও প্রাণীবৈচিত্র্য অনন্য এবং বিশেষত্বপূর্ণ।

বিশ্বজুড়ে নানা বৈশিষ্ট্যের অসংখ্য সোয়াম্প ফরেস্ট রয়েছে। আজ আমরা জানবো পৃথিবীর  সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং অতুলনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত কিছু সোয়াম্প ফরেস্টের কথা।

পান্টানাল সোয়াম্প ফরেস্ট (ব্রাজিল,প্যারাগুয়ে,বলিভিয়া)

পান্টানালকে বলা হয় পৃথিবীর সববৃহৎ সোয়াম্প ফরেস্ট। এটি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। প্রায় পর্তুগালের সমান আয়তনের পান্টানালের নামটিও এসেছে পতুগিজ ভাষা থেকে। পর্তুগিজ পান্টানালের অর্থ জলাভূমি বা জলজ। ১,৪০,০০০ থেকে ১,৯৫,০০০ বর্গ কি.মি. আয়তনের সুবিশাল এই সোয়াম্প ফরেস্ট ছড়িয়ে আছে ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও বলিভিয়া জুড়ে।

Source: MARKUS MAUTHE, LAIF/REDUX

জলাভূমি বললেও এখানে রয়েছে মৌসুমী প্লাবনে প্লাবিত হওয়া বিস্তৃত তৃণভূমিও। পান্টানাল একটি বিশাল ঢালু অববাহিকা যাতে আশেপাশের সমভূমির সমস্ত পানি এসে জমা হয়। পান্টানালের শ্লথগতির স্রোত এই পানিকে সযত্নে ঢেলে দেয় প্যারাগুয়ে নদী আর এর শাখা-উপশাখায়। বর্ষাকালে পান্টানালের পানির উচ্চতা ২-৫ মিটার বেড়ে যায়। পানির এই নাটকীয় পরিবর্তন বর্ষাকালে পান্টানালের রুপসুষমা বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।

Source: Alamy Stock Photo

পান্টানাল পৃথিবীর অন্যতম সেরা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এর প্রাণী বৈচিত্র্যের প্রাচুর্য অকল্পনীয় রকমের। আপনি যদি ব্রাজিল বা দক্ষিণ আমেরিকার বিচিত্র জীবজন্তর সাথে সাক্ষাৎ করতে চান, তাহলে আপনাকে যেতে হবে পান্টানাল। আমাজনে তো আছেই তারা, কিন্তু আমাজন অনেক বেশি বিপদসঙ্কুল। তাই জাগুয়ার, এলিগেটর, এনাকোন্ডা বা পিরানহাকে তাদের নিজস্ব আবাসে স্বমহিমায় দেখার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান হচ্ছে পান্টানাল সোয়াম্প।

বলিভিয়া সীমান্তের বনে এমনও হতে পারে যে, আপনার সামনে দিয়েই হেঁটে চলে যাবে প্রাণীর দল। এ যেন এক প্রাকৃতিক প্রামাণ্যচিত্র যা আপনাকে বিস্ময়াভিভূত চোখে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করবে।

Source: Joel Sartore/Getty Images/National Geographic Creative

পান্টানালে রিও নিগ্রো নদীর দু’পাশে গাছের ডালে ডালে রঙের পসরা মেলে উড়াউড়ি করে পাখিরা। তাদের সুরেলা গলার মিষ্টি গানে মুখরিত হয়ে থাকে বন। আর সন্ধ্যায় আকাশ যখন লাইলাক বর্ণ ধারণ করে, তখন চোখে পড়ে জোড়াবেঁধে শত শত লাল, নীল ম্যাকাও আর সবুজ টিয়াদের ঘরে ফেরার দৃশ্য। আইবিসের বহর আকাশে দৃষ্টিনন্দন V তৈরী করে উড়ে চলে। টাউকান, নাইটজার, ল্যাপউইংসেরও দেখা মেলে এখানে।

পান্টানাল প্রান্তর ঘুরে দেখার বাহন হিসেবে সাধারণত ঘোড়া ব্যবহৃত হত। সোয়াম্পের আশেপাশে অনেক ক্যাটল র‍্যাঞ্চ আছে যেখানে ঘোড়া পাওয়া যায়। তবে বর্ষার সময় ক্যানুই ভরসা। আকাশ থেকে পান্টানালের সৌন্দর্য ধরা পড়ে অনন্য রুপে। সবুজে বনানীর বুক চিরে এঁকেবেঁয়ে বয়ে যাওয়া নীল প্যারাগুয়ে নদীকে মনে হয় শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো জলরং ছবি। প্রাকৃতিক রুপসৌন্দর্যের তীর্থক্ষেত্র পান্টানাল একটি  ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।

আচাফালায়া  সোয়াম্প (লুইজিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র)

সুউচ্চ সাইপ্রেস আর টুপেলোর ছায়ায় আচ্ছাদিত, অগণিত জলপথে বেষ্টিত আচাফালায়া সোয়াম্প ফরেস্ট লুইজিয়ানায় প্রাণের প্রতীক। এটি আমেরিকার সর্ববৃহৎ সোয়াম্প ফরেস্ট। আচাফালায়া শব্দের অর্থ ‘দীর্ঘ নদী’। আমেরিকার অনন্য সাধারণ বনভূমি আচাফালায়া সোয়াম্প ১.৪ মিলিয়ন একর অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত, যা আমেরিকার রোড আইল্যান্ড রাজ্যের চেয়েও বিশাল। আচাফালায়ার প্রাণী বৈচিত্র্যের ব্যাপ্তি এর আয়তনের মতোই ব্যাপক। এর উত্তরাংশে রয়েছে কাষ্ঠল গাছের বন, মধ্য আচাফালায়া গঠিত লুইজিয়ানার ঐতিহ্যবাহী সাইপ্রেস ও টুপেলো বৃক্ষের সোয়াম্প বন নিয়ে, আর দক্ষিণ আচাফালায়ায় মিঠাপানির সাথে কালো পানির সংমিশ্রণ ঘটেছে। মেক্সিকো উপসাগরের লোনাপানিও মিশেছে এখানে।

Source: Wikimedia Commons

আচাফালায়া বিচিত্র ও অগণিত বণ্যপ্রাণীর আবাস। আমেরিকার অর্ধেক অতিথি পাখিরই বিচরণ আচাফালায়ায়। উড স্টর্ক, স্পুনবিল, অসপ্রে সহ প্রায় ২৭০ প্রজাতির পাখির প্রজাতি রয়েছে এখানে। পালকহীন ঈগলদের সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় এ আচাফালায়ায়। এর জলভাগে রয়েছে ১০০ প্রজাতির মাছ, আমেরিকান এলিগেটর সহ ৬৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও উভচর।

Source: LA Office of Tourism

আচাফালায়ার সৌন্দর্য আসলে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। এর রোমাঞ্চকর সৌন্দর্যের স্বাদ পেতে হলে আপনাকে আচাফালায়ার জলে চড়ে বেড়াতে হবে, বন্য জন্তুদের স্বচক্ষে দেখতে হবে, আর এর প্রাচীন বৃক্ষের আশ্রয়ে রাত্রী যাপন করতে হবে।

ওকিফেনোকি সোয়াম্প (ফ্লোরিডা-জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র)

Source: georgiaencyclopedia.org

৪,৩৮,০০০ একর আয়তনের ওকিফেনোকি সোয়াম্প একটি অগভীর পীট সোয়াম্প ফরেস্ট। এটি আমেরিকার ফ্লোরিডা এবং জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত। এই পীট জলবনের বেশিরভাগই অবশ্য পড়েছে জর্জিয়ার ভাগে। এটি উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বিশাল কালোপানির বন। আটলান্টিক তীরের এক পুরনো সোপানের পাড়ে একটি অগভীর অববাহিকায় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর ধরে জলজ উদ্ভিদের কান্ড আর পাতা পচে এই বনের পীটের স্তর তৈরী করেছে। এতে রয়েছে লেক, নদী, জলজ বন, প্রেইরির বিস্তৃত বাস্ততন্ত্র। ওকিফোনোকির পাইন বন, ঘাস বন আর ফার্ন বনের ফাকে চড়ে বেড়ায় খরগোশ, র‍্যাকুন, হরিণ আর জলে এলিগেটর। এখানে অতিথি পাখির সমারোহও চোখে পড়ে।

Source: okeswamp.com

এ বনে রয়েছে দু্র্লভ পতঙ্গভুক উদ্ভিদ ব্লাডারওয়ার্ট। সুন্দর ফুলের মোহে ফেলে পোকামাকড়ের জীবনহরণই ব্লাডারওয়ার্টের নেশা। পিগমি সানফিশ ওকিফেনোকির একটি এন্ডেমিক প্রাণী।

বেংউইলু সোয়াম্প (জাম্বিয়া)

Source: zambezi.com

উত্তর জাম্বিয়ায় অবস্থিত বেংউইলু সোয়াম্প নীচু দ্বীপ, নলখাগড়ার বন, প্লাবন সমভূমি আর অগভীর লেগুন ঘিরে গড়ে উঠেছে। আফ্রিকার দুর্লভ প্রাণীকূলে ভর্তি এই সোয়াম্প বন। বনে চড়ে বেড়াতে দেখাতে যায় দুর্লভ প্রজাতির কৃষ্মমৃগ। কালেভদ্রে চিতাবাঘের দেখাও পাওয়া যায়। রাতের নীরবতা ভেঙে ভেসে আসে শেয়াল আর হায়েনার ডাক। জলে আছে কুমির আর জলহস্তি। বনের পানি চলে গেলে স্থলে ঘাসনির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হাতি আর মহিষ নলখাগড়ার বনে বেড়াতে চলে আসে। এখানে প্রচুর পাখি রয়েছে। আফ্রিকার অন্যতম দুর্লভ পাখি পেলিক্যানদের জাতভাই শ্যুবিল স্টর্ক পাওয়া এই বনে। আরও নানা প্রজাতির অদ্ভুতদর্শন পাখির সমারোহ রয়েছে চোখে পড়ার মতো।

Source: zambezi.com

কান্দাবা সোয়াম্প (ফিলিপাইন)

ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ৬০ কি.মি. গেলে পড়বে কান্দাবা, পাম্পাঞ্জা অঞ্চল। এখানেই অবস্থিত বৃহত্তর কান্দাবা সোয়াম্প ফরেস্ট। প্রায় ৩২,০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত মিঠাপানির এই জলবনটি মৌসুমী বন্যায় প্লাবিত তৃণভূমি দ্বারা বেষ্টিত। বর্ষার মৌসুমে বনটি  জলে ডুব দেয়। আর বর্ষা চলে গেলে বনভূমি হয়ে যায় কৃষিজভূমি। সাধারণত স্থানীয় লোকজন ধান আর তরমুজ চাষ করে তখন। পলল সমভূমির সাধারণ উদ্ভিদের সবগুলোই রয়েছে এখানে। সেই সাথে রয়েছে নিপা পাম এবং কিছু ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ।

Source: gmanetwork.com

কান্দাবা সোয়াম্প ফরেস্ট বর্ষাকালে প্রাকৃতিক বন্যা প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। বন জুড়ে বয়ে চলা পাঁচটি ছোট নদী- মাসিম, সান মিংগেল, গার্লেং, বুলু, প্যানারান্ডার অতিরিক্ত পানি বৃহৎ পাম্পাঞ্জা নদীতে ফেলে। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অতিথিপাখি অভয়ারণ্য।

পৃথিবীতে প্রকৃতির অপরুপ রুপের যে খেলা চলে, নিঃসন্দেহে সোয়াম্প ফরেস্ট তার একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই সোয়াম্প আর এর বাসিন্দারা টিকে থাকুক, ভাল থাকুক- এটাই কাম্য ।

ফিচার ইমেজ- National Geographic

Related Articles