এইচএসসি পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং করতে ২০১৩ সালে মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন সুমি (ছদ্মনাম)। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা, শিক্ষার্থী অবস্থায় টিউশনি, বেশ কিছু উন্নয়ন সংস্থায় স্বেচ্ছাসেবকের কাজ আর নিজের পড়াশোনা নিয়ে সাফল্যের সাথে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তারপর শুরু করেছেন একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি। ভালো মাইনে আর শহুরে সুযোগ-সুবিধার জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য হয়ে পড়ায় আর পুরনো জায়গায় ফেরা হয়নি তার। বাবা-মাকেও নিয়ে এসেছেন ঢাকাতেই। এখন সুমি ও তার পরিবার, পুরোদস্তুর ঢাকার নাগরিক।
সুমির মতো প্রতি মাস কিংবা প্রতি বছর ঢাকা কিংবা দেশের অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরে বাড়ছে নারীদের আগমন ও অর্থনৈতিক সাফল্যে অংশগ্রহণ। অন্তত বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) এর সর্বশেষ গবেষণা সেই তথ্যই দিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ অভিবাসন তথা ‘আরবান মাইগ্রেশনে’ গেল বছরে পুরুষের চেয়ে মোটাদাগে এগিয়ে ছিল মেয়েরা। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হিসেবটা ১০৯.০, নারীদের ক্ষেত্রে ১২১.৪, প্রতি হাজারে। শুধু তা-ই নয়, বিবিএসের গবেষণা পরিসংখ্যান বলছে ২০১৮ সালে পুরুষদের চেয়ে নারীরা শহর থেকে কম মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইংরেজিতে যেটাকে বলা হয় ‘আউট মাইগ্রেশন’। প্রতি বছরের মতো এবারও নারীপুরুষ সবচেয়ে বেশি শহরকেন্দ্রিক হয়েছে ঢাকার দিকেই।
বড় একটা অংশ ঢাকামুখী হলেও ঢাকায় শেষ বছরে অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে খানিকটা কমেছে। শেষ বছরে যেখানে ‘ইন-মাইগ্রেশন’ রেট ছিল ১২২.৩, সেখানে ‘আউট-মাইগ্রেশন’ ছিল ১২৫.১। অর্থাৎ প্রতি হাজারে ঢাকায় আসা কমেছে ২.৭। এর মূল কারণ রাজধানী ঢাকার বাইরেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক এলাকা, শিক্ষার উন্নয়ন, জীবন মান উন্নয়ন তথা কর্মক্ষেত্রের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়া।
সাধারণত একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের মূল কারণগুলো হয়ে থাকে, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক, ভৌগলিক ইত্যাদি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়গুলো নিয়ামক হিসেবে ধরা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বৈবাহিক অবস্থা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান করা, চাকরি সংক্রান্ত, বদলি সংক্রান্ত, নদীভাঙন, কৃষি, পারিবারিক, ব্যবসা, অবসর এবং অন্যান্য।
সাধারণভাবেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ করে উচ্চমাধ্যমিকের পর দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ শহরমুখী হয়। কেউ বা চাকরির কারণে পুরো পরিবারসহ শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হন। বিয়ের কারণে এবং কৃষিকাজে বিশাল একটি অংশ শহরমুখী হওয়া কিংবা শহর থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।
তবে দেশের ‘আরবান মাইগ্রেশনে’র রেখাচিত্রে প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে কৃষি, নদীভাঙন এবং নতুন কর্মসংস্থানের খোঁজ। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে দেশের ভৌগলিক চিত্র, ক্রমশ ঝুঁকির মুখে পড়ছে উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীকেন্দ্রিক জীবিকা। বাড়ছে নদীভাঙনের কারণে দেউলিয়া হওয়া মানুষের সংখ্যা। ২০১৮ সালে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে প্রতি ১০০ জনে ১.৬ জন পুরুষ ও ০.৯ জন নারী শহরমুখী হচ্ছে। যেহেতু নদীভাঙন বছরের একটা বড় একটা সময় ধরে থাকে, আবার শুকনো মৌসুমে সেইসব স্থানে নতুন চর কিংবা বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় পুনরায় সেখানে জনবসতি তৈরি হয়, তাই এক্ষেত্রে প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ পুরনো স্থানে ফিরে যায়। কিন্তু প্রতি বছরেই নদীভাঙন কিংবা বন্যায় শহরমুখী হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া এবং ফিরে যাওয়ার সংখ্যা হ্রাস পাওয়া দিয়েই দেশের জলবায়ুর প্রভাব টের পাওয়া যাচ্ছে খুব সহজে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে দেশের শিশুরা।
জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রতিরোধ বিষয়ে এ বছরের শুরুর দিকে মার্চে বাংলাদেশে সফর করেছিলেন ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েত্তা ফোর। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে ইউনিসেফের ‘ঝড়ের আভাস: জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ কালো মেঘে ঢেকে দিচ্ছে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
হেনরিয়েত্তা তার সফরকালে প্রতিবেদন পেশ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন,
‘বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলো পরিবেশগত যেসব হুমকি মোকাবেলা করছে তা আরও কষ্টকর হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। যে কারণে তারা তাদের সন্তানদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা এবং তাদের উন্নয়নে দেশেগুলোতে অনেক সফলতা কেবলমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ম্লান হতে চলেছে।’
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে যেসব ক্ষতিগ্রস্থ শিশুদের কথা বলা হয়েছে, তাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর বাস দেশের বড় নদীর তীর ঘেঁষে। দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বড় নদীগুলো বর্ষা মৌসুমে যেমন ভাঙনের কবলে পড়ে, তেমনই নিচু এলাকায় বন্যার পানি বাড়ে। আর ঠিক জলবায়ু পরিবর্তনের করাল আঘাতের কারণেই প্রতি বছর বন্যার পানি বাড়ে আরও বেশি। তাতে করে বাড়ে পানিবাহিত রোগ, খাবার পানির অভাব, বাসস্থানের অভাব।
সর্বোপরি শহুরে অভিবাসনের বিভিন্ন কারণ থাকলেও ক্রমশ এসব কারণকে পিছনে ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তন। যা এক কথায় আশঙ্কাজনক। বল রাখা ভালো, শহরমুখী হওয়া নিম্নবিত্ত কিংবা দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা প্রায় সবারই স্থান হচ্ছে ঢাকার মেট্রোপলিটনের ভিতরে কিংবা বাইরের বস্তিগুলোতে। এসব বস্তিতে নিরাপত্তার অভাব, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব রয়েছে।
শহর বলতে আমরা কেবলই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট কিংবা বিভাগীয় শহর বুঝি না। শিল্পায়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষার সুরক্ষিত মান, যোগাযোগের সুব্যবস্থা; ইত্যাদি থাকলেই তাকে শহর বললে ভুল হবে না। তবে বিভাগীয় শহর, কিংবা মেট্রোপলিটন শহর না হওয়ার পরও শহরকে হার মানিয়েছে সাতক্ষীরা জেলা শহর। দক্ষিণাঞ্চলের কোল ঘেঁষে থাকা এই শহর দেশের অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। এখানকার ৪৭টি বস্তিতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সবাই কোনো না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়েছেন। তাদের বড় একটি অংশ খুলনা কিংবা ঢাকামুখী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আইলা, সিডর পরবর্তী সময়ে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলের পানি ক্রমশ পানের অযোগ্য হয়ে উঠেছে, মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। সবকিছু মিলিয়েই স্থানীয় জনগোষ্ঠী পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস (বিবিএস) এর পরিসংখ্যান বলছে সপরিবারে শহরমুখী হওয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এর পরই রয়েছে কৃষিকাজ। অথচ ২০১৮ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপির ১৪.১০ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। কিন্তু প্রতিনিয়ত নগরায়ণ, কৃষিজমিতে শিল্পায়ন, উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ক্রমশ কমছে কৃষিকাজ। যে কারণে এই পেশার সাথে সম্পৃক্ত বিশাল একটি অংশ দ্রুত শহরমুখী হচ্ছে জীবিকার তাগিদে।
আরবান মাইগ্রেশনের অনেক সুফল রয়েছে তা সত্যি। কিন্তু এর পেছনের গল্পগুলো যেন প্রতিনয়ত দেশের ভবিষ্যৎকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বসে। আবার একই সাথে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সুযোগও করে দেয়। অন্ততপক্ষে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখানকার শহুরে অভিবাসন যে ভালো কিছু ডেকে আনছে না তা সহজেই টের পাওয়া যায়।