সুস্বাস্থ্যে এবং মসলা হিসেবে জাফরানের বাহারি ব্যবহার

বহুল জনপ্রিয় ও নানান গুণাগুণ সমৃদ্ধ একটি মসলা হলো জাফরান। জাফরান পারস্যের কাছাকাছি উৎপত্তি লাভ করেছে বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে এটি ইউরেশিয়ায় হয়ে উত্তর আমেরিকা, উত্তর আফ্রিকা ও ওশেনিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়ে। জাফরান গাছ ভূমধ্যসাগরীয় ম্যাকুইসে (ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে যেখানে ঘন গুল্ম জন্মায়) জন্মায়। অর্থাৎ এটি এমন জায়গায় জন্মে যেখানে অর্ধ আর্দ্র জমির উপর দিয়ে গ্রীষ্মের উষ্ণ ও ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যায়। এর ফুল রক্তবেগুনী রঙের হয়ে থাকে এবং এর সুবাস অনেকটা মধুর মতো। এর ডাঁটাগুলো ২০-৩০ সেন্টিমিটার উচ্চতার হয়। আর এর ডাঁটা, শেকড় এবং ফুল অক্টোবর এবং ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বিকশিত হয়। আর আজকের লেখায় কথা হবে এই জাফরান নিয়ে।

জাফরান কী?

ক্রোকেস সেটিভাস (জাফরানের বৈজ্ঞানিক নাম) ফুল থেকে পাওয়া যায় জাফরান। এই ফুলের আঁশ বা সুতার মতো অংশটিই মূলত জাফরান যা খাবার রান্না করার পর পরিবেশনের কাজে এবং খাবারের রং মোহনীয় করতে ব্যবহার করা হয়। ব্যবহার ছাড়াও বেশ মূল্যবান হওয়ার কারণেই এই মসলাটি অধিক পরিচিত। জাফরানকে কেসরও বলা হয়ে থাকে। জাফরানের বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। নিচে জাফরানের জনপ্রিয় কিছু প্রকারভেদ দেওয়া হলো।

  • পদ্মাগদি- কাশ্মীরে জন্মানো এই জাফরানটিকে সর্বোত্তম প্রকারের জাফরান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একে মংরা বা লাছা জাফরানও বলা হয়।
  • পারসিকা কুমকুমা- এর আঁশ বা সুতাগুলো অপেক্ষাকৃত বড় হয়ে থাকে।
  • মধুগন্ধি- এর আঁশ বা সুতাগুলো ঘন ও পুরু হয়ে থাকে। এছাড়াও এগুলো রুক্ষ এবং কিছুটা সাদা হয়।
  • বাহিলকা- এর আঁশ বা সুতাগুলো ছোট ও সাদা হয়।
  • এছাড়াও অন্যান্য জনপ্রিয় প্রকারভেদগুলোর মধ্যে রয়েছে সারগোল (ইরানে জন্মায়), আকিলা (ইতালিতে জন্মায়) এবং ক্রিম (স্পেনে জন্মায়)।

জাফরানের ইতিহাস

জাফরানের চাষ ও ব্যবহার ৩,৫০০ বছর ধরে হয়ে আসছে। মহাদেশগুলোতে এর বাণিজ্য ও ব্যবহার ছিলো বিস্তৃত। এছাড়া ৯০ এরও বেশি রকমের রোগব্যাধির জন্য জাফরান ব্যবহার করা হতো। অঙ্গরাগ বৈশিষ্ট্যের জন্য ক্লিওপেট্রা গোসলের সময়ে জাফরান ব্যবহার করতেন। রোমের অধিবাসীরা একে দুর্গন্ধনাশক পদার্থ হিসেবে ব্যবহার করতো।

সবচাইতে মূল্যবান মসলার ইতিহাস; Source: Crocussativus

জাফরান আপনার জন্য কেন উপকারী?

হিপোক্রেটিসের (যাকে ঔষধের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হতো) মতে, জাফরান কফ, কাশি, ঠাণ্ডা, পাকস্থলীর সমস্যা, অনিদ্রা, গর্ভাশয়ে রক্তপাত, পেট-ফাঁপা ও হৃদরোগের সমস্যা সমাধানে বেশ ভালো কাজ করে। জাফরানে আছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাঙ্গানিজ যা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে এবং হাড় ও টিস্যু গঠনে সাহায্য করে। এছাড়াও এতে রয়েছে ভিটামিন সি যা যেকোনো ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং আয়রন শোষণে সাহায্য করে। জাফরান দুধেরও রয়েছে অনেক গুণাগুণ। দুধের সাথে জাফরান মিশিয়ে খেলে হজমশক্তি ও রুচি বাড়ে। শুধু তাই নয় জাফরান দুধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বককে রাখে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে জাফরান দুধ খেলে খুব ভালো ঘুম  হয়। জাফরানের তেল ত্বককে করে উজ্জ্বল। এমনকি জাফরানের পানিতেও রয়েছে অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য।

জাফরানে যেসব পুষ্টিগুণ রয়েছে

প্রায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ জাফরানে ৩১০ কিলোক্যালরি, ৬৫.৩৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১১.৪৩ গ্রাম প্রোটিন ও ৫.৮৫ গ্রাম ফ্যাট রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ৩.৯ গ্রাম ফাইবার, ১১১ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৩২৮ মিলিগ্রাম কপার, ১১.১০ মিলিগ্রাম আয়রন, ২৬৪ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম এবং ২৮ মিলিগ্রাম ম্যাঙ্গানিজ।

সুস্বাস্থ্যে জাফরানের ভূমিকা

জাফরানের রয়েছে আশ্চর্যজনক নিরাময় এবং ঔষধি বৈশিষ্ট্য। জাফরান ক্যান্সার, শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ, হজমশক্তি জনিত সমস্যা প্রতিরোধে এবং ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে। সুস্বাস্থ্যে জাফরানের কিছু গুণাগুণ নিচে দেওয়া হলো।

সাস্থ্য রক্ষায় জাফরানের গুণ অতুলনীয়; Image Source: BBC Good Food

  • দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে

জাফরানে যে প্রাকৃতিক যৌগ আছে তা দৃষ্টিশক্তির অবক্ষয় এবং রেটিনার যেকোনো সমস্যা প্রতিরোধ করে। দ্য ইউনিভার্সিটি অব সিডনির একটি প্রতিবেদন মতে, জাফরান প্রবীণদের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে সাহায্য করে। সেই পরীক্ষায়, জাফরানের বড়ি খাওয়ার পর রোগীদের দৃষ্টিশক্তি উন্নত হয়।

  • অনিদ্রার সমস্যাটি প্রতিরোধ করে

কিছু কিছু গবেষণা মতে, জাফরান অনিদ্রা এবং বিষণ্ণতা প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। আধা কাপ পানিতে ৬ থেকে ৮টি জাফরান ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে সেই পানিটি খেলে অনিদ্রার সমস্যা দূর হবে। এছাড়াও প্রতি রাতে দুধের সাথে জাফরান মিশিয়ে খেলে ভালো ঘুম হয়।

  • মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য বজায় রাখে

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, জাফরান স্মৃতিশক্তির ইন্দ্রিয়গুলোকে কার্যকরী করতে সাহায্য করে। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম জাফরান খেলে আলঝেইমারস (স্মৃতিশক্তি জনিত সমস্যা) রোগের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যায়।

জাফরান মস্তিষ্ক ও দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে; Source: onlymyhealth.com

  • অ্যাজমা রোগের ঔষধ হিসেবে কাজ করে

প্রাচীনকাল থেকেই জাফরান অ্যাজমা রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে এই বিষয়ে তেমন কোনো গবেষণার নজির পাওয়া যায় না। তাই অ্যাজমার সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই জাফরান ব্যবহার করা ভালো।

  • হজমশক্তি বাড়ায়

জাফরানে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে তা হজম জনিত সমস্যার সমাধান করে। এছাড়াও এটি শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে এবং জ্বালাপোড়াভাব কমাতে সাহায্য করে। পেপটিক আলসার প্রতিরোধও জাফরান সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

  • এছাড়াও জাফরান হৃদপিণ্ড ও যকৃত সুস্থ রাখতে, ক্যান্সার প্রতিরোধে এবং জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে।

রুপচর্চায় জাফরানের গুণাগুণ

বিভিন্ন ধরনের ফেস প্যাকে জাফরান ব্যবহার করলে ত্বকে যে তফাৎটা আসবে তা নিজেই লক্ষ করতে পারবেন। এখন জানাবো ত্বকের যত্নে জাফরানের গুণাগুণ নিয়ে।

জাফরান ত্বককে রাখে কোমল ও উজ্জ্বল; Source: Health Library

  • ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে

কোমল ও উজ্জ্বল ত্বক পেতে নিচের ফেস প্যাকটি ব্যবহার করতে পারেন-

  • ১ চা চামচ চন্দন গুঁড়া, ২-৩টি জাফরান ও ২ চামচ দুধ নিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নিন।
  • এই প্যাকটি লাগানোর আগে একটি পরিষ্কার ভেজা কাপড় দিয়ে ভালো করে মুখ মুছে নিন।
  • ত্বক ভেজা থাকতে থাকতে এই প্যাকটি লাগিয়ে নিন।
  • আঙুলের ডগা দিয়ে হালকাভাবে পুরো মুখে ম্যাসাজ কর নিন।
  • এরপর শুকানোর জন্য ২০ মিনিট রেখে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
  • কার্যকরী ফল পাওয়ার জন্য সপ্তাহে অন্তত একদিন অবশ্যই ব্যবহার করুন।
  • ব্রণের সমস্যা দূর করে

জাফরানে রয়েছে অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান যা ব্ল্যাকহেডস, ব্রণ ও ক্ষত প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে সাহায্য করে।

  • ৫-৬টি পুদিনা পাতার সাথে ১০-১২টি জাফরান মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন।
  • এই পেস্টটি ১০-১৫ মিনিটের জন্য মুখে লাগিয়ে রাখুন।

এই প্যাকটি সহজে ব্যবহারে আপনার ত্বকে ব্রণ বা ফুসকুড়ি হবে না। পুদিনা পাতা ব্রণ বা ফুসকুড়ির ব্যাকটেরিয়া দূর করে। এছাড়াও ব্রণ থেকে মুক্তি পেতে দুধে জাফরান মিশিয়ে সেই মিশ্রণটি দিনে দুইবার ব্যবহার করুন।

এই ফুল থেকেই পাওয়া যায় জাফরান; Image Source: munchies.vice.com

  • নীরস ত্বকে প্রাণ ফিরিয়ে আনে

ধুলোবালি আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ত্বক নিস্তেজ হয়ে যায়। কিন্তু চিন্তা কিসের? জাফরান তো আছেই!

  • ২-৩টি জাফরান ১ চা চামচ পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন।
  • পরের দিন সকালে সেই পানিটি রং বদলে হলদেভাব হয়ে যাবে।
  • ১ চা চামচ দুধ, ২-৩ ফোঁটা অলিভ অয়েল বা নারিকেল তেল এবং এক চিমটি চিনি সেই জাফরানের পানিতে মিশিয়ে নিন।
  • এই মিশ্রণে কটন বল ডুবিয়ে সারা মুখে আলতো করে লাগিয়ে নিন।
  • শুকানোর জন্য ১৫ মিনিট অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলুন।
  • এই প্যাকটি নিস্তেজ ত্বককে প্রাণবন্ত করে তুলবে এবং চোখের নিচের কালিও দূর করতে সাহায্য করবে।
  • এছাড়াও এটি রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে আপনার ত্বক এক্সফোলিয়েট করে এবং ত্বককে কোমল ও উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে।

ফিচার ইমেজ: Rumi Spice

Related Articles

Exit mobile version