‘ক’ সাহেবের পেশায় একজন বীমা কর্মকর্তা, বয়স পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে কিছুদিন অাগেই। কয়েক দিন ধরে ঘাড়ে বেশ ব্যথা অনুভব করছেন তিনি। স্ত্রীকে জানালে তিনি বললেন, বালিশ রোদে গরম করলে ঘাড়ের ব্যথা সেরে যায়। স্ত্রীর কথামতো রোদে গরম করা বালিশে শুয়ে প্রথম দু-একদিন কিছুটা আরামবোধ করলেও কয়েকদিন পর ব্যথা তীব্র হয়ে উঠল। বালিশ রোদে গরম করেও আর কোনো লাভ হলো না। ঘাড়ের তীব্র ব্যথার সঙ্গে যুক্ত হলো হাতের আঙুলে ঝিনঝিন অনুভূতি। শেষমেশ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন তিনি। চিকিৎসক রোগের বর্ণনা শুনে এবং কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, ‘ক’ সাহেব সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসে ভুগছেন।
সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস কী?
সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসকে সাধারণ বাংলায় ঘাড়ের বাত বলে। মূলত গ্রীবাদেশীয় কশেরুকাগুলোর মধ্যকার তরুণাস্থিগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হলে এ ব্যাধিটি দেখা দেয়।
অামরা জানি, মানুষের মেরুদণ্ড ৩৩টি ছোট ছোট হাড় বা কশেরুকা (ভার্টিব্রা) দিয়ে তৈরি। গ্রীবা বা ঘাড়ের অংশে রয়েছে সাতটি কশেরুকা। এই কশেরুকাগুলো একটি অপরটির সঙ্গে ডিস্ক ও লিগামেন্ট দ্বারা সংযুক্ত। মেরুদন্ডের ঘাড়ের অংশ সামনের দিকে উত্তলভাবে বাঁকানো। সবচেয়ে বেশি বাঁকানো থাকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ কশেরুকার মধ্যকার ডিস্ক বরাবর। এই স্থানেই স্পনডাইলোসিস বেশি ঘটে, কারণ এখানে সবচেয়ে বেশি চাপ প্রযুক্ত হয়।
ক্ষয়প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় তরুণাস্থিতে ফ্লুইডের মাত্রা হ্রাস পায় এবং তা শুষ্ক হয়ে ওঠে। সুস্থ অবস্থায় ডিস্কগুলো নরম, স্থিতিস্থাপক এবং মজবুত থাকে। কিন্তু ডিস্কে যখন ক্ষয় শুরু হয়, তখন তার নমনীয় তন্তুগুলো শক্ত হয়ে ওঠে এবং চাপের ফলে ভেঙে যায়। ফলে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী ডিস্ক পাতলা হয়ে যায়। এর ফলে কশেরুকাগুলোর প্রান্তগুলো পরস্পরের সঙ্গে ঘষা খেতে থাকে এবং বিভিন্ন মাপের নতুন হাড়ের দানা দেখা দেয়। এই হাড়ের দানাগুলো সূঁচালো ও ধারালো। এক্সরে পরীক্ষায় এগুলো ধরা পড়ে। যদি এই তীক্ষ্ণ হাড়ের দানাগুলোর কোনোটি স্নায়ুমূলকে খোঁচা মারে, তাহলে হাতে তীব্র ব্যথার উদ্রেক হয়। হাড়ের দানাগুলো মাঝে মাঝে স্নাযুরজ্জুকেও চাপ দিতে পারে এবং পায়ে অসাড়তা আনতে পারে। ক্ষয়প্রাপ্ত ডিস্কের স্বাভাবিক অবস্থান থেকে স্থানচ্যুতিকে বলা হয় ‘স্লিপড ডিস্ক’। এক্ষেত্রে ডিস্ক স্নায়ুমূলের ওপর চাপ দিয়ে ব্যথা সৃষ্টি করে। সাধারণত দুর্ঘটনা, হঠাৎ পড়ে যাওয়া কিংবা ঘাড়ে আঘাতের কারণে স্লিপড ডিস্ক হতে পারে ।
সাধারণত চতুর্থ থেকে সপ্তম কশেরুকাতে স্পনডাইলোসিস ঘটে থাকে। ওপরের তিনটি কশেরুকাতে স্পনডাইলোসিস হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, কারণ ওখানটায় খুব একটা চাপ পড়ে না। সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের ব্যথা সর্বদা ঘাড়ের পেছন দিকে অনুভূত হয়, কখনোই ঘাড়ের সামনের দিকে অনুভূত হবে না। ব্যথা তীব্র হলে তা কাঁধে এবং বাহুর পেছনের দিকে কনুই পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। কখনো কখনো ব্যথা হাতে এবং আঙুলেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
লক্ষণীয় যে, অ্যানজাইনার ব্যথা বাহুর ভেতরের পাশে অনুভূত হয় এবং সচরাচর তা আঙুলে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সার্ভাইক্যাল স্পনডাইলোসিসের ক্ষেত্রে ঘাড় নড়াচড়া করলে ব্যথা বেড়ে যায়। এ ছাড়া অ্যানজাইনার ব্যথা সাধারণত বাঁ দিকে অনুভূত হয়।
কারণ
ঘাড়ে ব্যথার নানাবিধ কারণ রয়েছে। যেমন-
- যেকোনো ধরনের আঘাত
- পজিশনাল অর্থাৎ ঘাড়ের নড়াচড়ার কারণে ব্যথা
- হাড়ের ইনফেকশন
- অস্টিওপোরেসিস
- টিউমার
- অস্টিও ম্যালেসিয়া বা ভিটামিন ডি-এর অভাব
উপসর্গ
- ঘাড় ব্যথা এবং এ ব্যথা কাঁধ, বাহু, হাত ও আঙুল পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া।
- কাঁধ, বাহু, হাত ও আঙুলে অস্বাভাবিক অনুভূতি বা অবশভাবের উদ্রেক।
- বাহু, হাত ও আঙুল দুর্বল অনুভূত হওয়া।
- সব সময় ঘাড় ধরে বা জমে (স্টিফনেস) আছে এমন অনুভূতির সৃষ্টি হওয়া।
- ঘাড়ের মুভমেন্ট ও দাঁড়ানো অবস্থায় কোনো কাজ করলে ব্যথা অনুভূত হওয়া।
- ঘাড় নিচু করে ভারি কিছু তোলা বা অতিরিক্ত কাজের পর তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভূত হওয়া।
- ঘাড় উপরের পিঠ এবং বাহুতে চাপ দিলে ব্যাথা এবং ঘাড়ের স্বাভাবিক নড়াচড়া ব্যাহত হওয়া।
অন্যান্য উপসর্গ
- ৬ সপ্তাহের বেশি ব্যথা থাকা।
- হাত বা পায়ে অস্বাভাবিক দুর্বলতা
- জ্বর থাকা
- ওজন কমতে থাকা
- বিনা কারণে হঠাৎ পায়খানা প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা।
- অনান্য সমস্যা যেমন, কথা বলতে অসুবিধা, মাথা ঘোরা, চোখে দেখতে অসুবিধা
- রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হওয়া।
রোগ নির্ণয়
স্পনডাইলোসিস নির্ণয়ের জন্য এক্সরে পরীক্ষা করা হয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান অথবা এমআরআই করা হয়ে থাকে।
এক্সরেতে বিশেষ ধরনের কিছু পরিবর্তন দেখে স্পনডাইলোসিস নির্ণয় করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিস্কের ক্ষয়। কশেরুকাতে বিভিন্ন মাপের নতুন হাড়ের দানা লক্ষ করা যেতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী অংশের ফাঁক কমে যায়।
চিকিৎসা
১. ঘাড়ের নড়াচড়া বন্ধ রাখা
ঘাড়ের অসঙ্গত নড়াচড়া রোধ করতে সার্ভাইক্যাল কলার ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম কিছু দিন ঘুমের সময়ও সার্ভাইক্যাল কলার পরে থাকা ভালো- এতে ঘুমের মধ্যে অসাবধনতাবশত ঘাড়ের নড়াচড়া প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয়।
ঘুমানোর সময় ঘাড়টাকে চিৎ হয়ে কিংবা স্বাভাবিক অবস্থানের চেয়ে ১০-১৫ ডিগ্রী সামনের দিকে বাঁকিয়ে ঘুমানো উচিত। একটি স্বাভাবিক আকৃতির বালিশে ঘাড় সামনের দিকে এর চেয়েও বেশি বেঁকে থাকে। সুতরাং ঘুমানোর সময় এসব বালিশ পরিহার করতে হবে।
২. ব্যথানাশক ওষুধ
ব্যথা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তিলাভ ও ব্যথা নিবারণের জন্য ব্যথানাশক ওষুধ এবং কখনো কখনো ইনজেকশনের ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যথা কমানোর পর প্রকৃত চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
৩. গরম সেঁক
যখনই অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়, তখন চারপাশের মাংসপেশিগুলো শক্ত হয়ে ওঠে। মূলত পেশির সংকোচনের দ্বারা প্রাকৃতিকভাবে শরীর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু মাংসপেশির সংকোচন বা টান যখন বেশি হয় তখন ব্যথার উদ্রেক ঘটে।
মাংসপেশীকে শিথিল করতে গরম সেঁক সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ, ইলেকট্রিক্যাল হিটিং প্যাড কিংবা ইনফ্রারেড ল্যাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় গোসলের সময় ঘাড়ে গরম পানি ঢাললে। তবে ফিজিও থেরাপিস্টদের অধিক পছন্দনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা শর্ট ওয়েভ ডায়াথার্মি ও আল্ট্রাসাউন্ড হিট।
৪. ট্রাকশন
ডিস্ক সরে গিয়ে স্নায়ুমূলে চাপ সৃষ্টি করলে ট্রাকশন সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা। ট্রাকশনের ফলে দুই কশেরুকার মধ্যবর্তী স্থানসমূহ বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে স্নায়ুমূলের ওপর ডিস্কের চাপ শুরু হয়। ট্রাকশনের ওজন বাড়ানো কিংবা কমানো নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। বসে ট্রাকশন দেয়া যেতে পারে কিংবা শুয়েও দেয়া যেতে পারে। শোয়া অবস্থায় ট্রাকশন দিলে মাথার দিকের খাট ব্লক দিয়ে ৬-৯ ইঞ্চি উঁচু করে রাখতে হবে। ট্রাকশনের ফলে ব্যথা বেড়ে গেলে ট্রাকশন বন্ধ করে দিয়ে পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি আছে কিনা, তা পরীক্ষা করে সংশোধন করতে হবে।
৫. মালিশ বা ম্যাসাজ
ঘাড়ের টানটান পেশিগুলোকে শিথিল করতে মালিশ অত্যন্ত কার্যকর একটি ব্যবস্থা। তবে মালিশ করার সময় লক্ষ্য রাখা উচিত, যেন মাংসপেশি জোরে মুচড়ে না যায়, কেননা তাতে ক্ষতি হতে পারে।
৬. ঘাড়ের মাংসপেশি শক্তিশালী করতে ব্যায়াম
ঘাড়ের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে পড়লে মেরুদন্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পেশিগুলো যদি শক্তিশালী থাকে তাহলে মেরুদণ্ডের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে না। ফলে মেরুদণ্ডও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিছু কিছু ব্যায়াম রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে ঘাড়ের মাংসপেশিকে শক্তিশালী করা যায়। তবে প্রাথমিক ব্যথা কমে যাওয়ার পর এসব ব্যায়াম করা বাঞ্চনীয়।
- হাত দুটো একসঙ্গে করে মাথার সামনে ঠেকিয়ে মাথাটাকে সামনের দিকে চাপ দিতে হয়। হাতের ওপর মাথার চাপ বাড়বে, তবে হাত দুটোও মাথার ওপর সমান চাপ দেবে।
- হাত দুটো মাথার পেছনে নিয়ে মাথাটাকে পেছন দিকে চাপ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে হাত দুটো যেন মাথার সামনে চাপ দেয়।
- একইভাবে ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিকে ও বাম হাত দিয়ে মাথার দিকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। মাথাও সমানভাবে হাতের ওপর চাপ দেবে।
৭. শক্ত পেশি শিথিল করতে ব্যায়াম
- মাথাটা ডানে-বামে ঘোরানো।
- মাথাটা সামনে-পেছনে ঘোরানো। মাথাটাকে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘোরানো।
- কাঁধ দুটো ওপরের দিকে ওঠানামা করানো।
- হাত দু’টিকে নিজের দুই কাঁধের ওপর স্থাপন করে কনুই দুটো বৃত্তাকারে ঘোরানো।
ফিচার ইমেজ: pinterest.com