জীববিজ্ঞানের গবেষণায় বয়োবৃদ্ধি একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ এবং রহস্যজনক বিষয়। বয়োবৃদ্ধির গবেষণা সাধারণত মানুষের কালানুক্রমিক বয়স, জৈবিক বয়স, বিভিন্ন অঙ্গ প্রতিস্থাপন, জেনেটিক্স, এপিজেনেটিক্স ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকে। বয়োবৃদ্ধি সম্পর্কিত গবেষণার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো মানুষের সময়ানুক্রমিক বয়স এবং তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বয়সের মাঝে বিদ্যমান তারতম্য।
যদি বলা হয়, একজন ব্যক্তির সময়ানুক্রমিক বয়স ৪৫ বছর, এর অর্থ হচ্ছে গণনার স্বাভাবিক ও প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তিনি আজ থেকে ৪৫ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অন্যদিকে জৈবিক বয়সের হিসেবটা ঠিক বছরের হিসেবে হয় না। দেহের কোনো একটি অঙ্গের বয়স সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টার প্রথা অনুযায়ী চলে না। অর্থাৎ জৈবিক বয়সের হিসেবের ক্ষেত্রে জন্মলগ্ন থেকে কতটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সেটিই একমাত্র ধর্তব্য নয়।
মানুষের দেহের গাঠনিক ও কার্যিক একককে বলা হয় কোষ। একই ধরনের কোষ যখন একটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে একই জায়গায় অবস্থান করে সম্মিলিতভাবে কাজ করে, তখন সেই কোষগুচ্ছকে কলা বা টিস্যু বলা হয়। এভাবে করে টিস্যু থেকে অঙ্গ এবং অঙ্গ থেকে তন্ত্র নির্মিত হয়।
মানবদেহে বিদ্যমান বিভিন্ন কোষের জীবনকাল কখনোই সমান নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, লোহিত রক্ত কণিকার কথা যার আয়ু ১২০ দিন। অর্থাৎ আপনার দেহে আজকে জন্ম নেওয়া লোহিত কণিকা আগামী চার মাস তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালন শেষে ফুরিয়ে যাবে। আবার আন্ত্রিক কোষগুলো কিন্তু অতটা লম্বা সময়ের জন্য বেঁচে থাকে না। সর্বোচ্চ তিন-চারদিন পর পর আপনার আন্ত্রিক কোষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে এবং আবার জন্ম নিচ্ছে নতুন কোষ। অর্থাৎ, যখন একজন মানুষ কিংবা নিজের বয়স নিয়েই আপনি মন্তব্য করছেন, তখন কেবল জন্ম থেকে অতিবাহিত সময়টুকুর কথা উল্লেখ করছেন। অথচ সেই মানুষটির দেহাভ্যন্তরেই ঘটে চলেছে অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন আয়ুষ্কালের কোষের জন্ম-মৃত্যু।
বয়োবৃদ্ধি সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা কাজে একটি রহস্যাবৃত বিষয় হলো মানুষের জৈবিক ও সময়ানুক্রমিক বয়সের মধ্যকার অপরিমেয় অসামঞ্জস্য। জন্মের পর থেকে একজন মানুষ যে ক’টি বছর পার করেছেন, সেটিই তার কালানুক্রমিক বয়স আর এই সময়ের পার হয়ে যাওয়ার প্রতি দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কীভাবে সাড়া দিচ্ছে, সেটিকে বলা হয় তার জৈবিক বয়স। একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, একজন মানুষের সত্যিকারের বয়স তার জৈবিক বয়সের সাথে সর্বদা সঙ্গতিপূর্ণ হবে, তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। একজন ৮০ বছরের প্রৌঢ়ের বাহ্যিক উপস্থিতিকে বর্ণনা করতে হলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই বলব যে কুঁচকানো চামড়া, পেকে যাওয়া চুল, কিছুটা কুঁজো হয়ে হাঁটা ইত্যাদি। তবে এসব বৈশিষ্ট্যের অর্থ এই না যে, তার শরীরের প্রতিটি কোষের বয়স ঠিক ৮০ বছরই। জৈবিক বয়সের উপর বেশ কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও দাতার বয়স
যকৃত প্রতিস্থাপনের বিষয়টি উন্নত দেশগুলোতে অহরহ ঘটে থাকলেও আমাদের দেশে বেশ নতুন একটি ধারণা এটি। অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দাতার বয়স একটি বিবেচ্য বিষয়। সাধারণত দাতার বয়স যদি অধিক হয় তাহলে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। তবে দাতার বয়সের প্রভাব এতটাও সোজাসাপ্টা নয়।
গবেষণা অনুযায়ী, একজন গ্রহীতার দেহে নতুন অঙ্গটির উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের সম্ভাবনা, দাতার একটি নির্দিষ্ট বয়স থেকে শুরু হয়। সাধারণত দাতার বয়স সেই নির্দিষ্টসীমার চেয়ে কম হলে আশা করা যায় যে, গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপিত অঙ্গটি কোনো ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে না। কিডনি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দাতার বয়স যদি ৪০ বছর কিংবা ততোধিক হয়, তাহলে তার দানকৃত অঙ্গটি গ্রহীতার জন্য সমূহ বিপদের উৎস হিসেবে কাজ করবে।
অন্যদিকে, যকৃত প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে বয়সের এই সীমাটি পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সের মাঝে। ফুসফুস প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দাতার বয়স যদি ৬৫ বছরের অধিক হয়, তাহলে শুধু সেসব ক্ষেত্রেই গ্রহীতার দেহে নেতিবাচক ফলাফল প্রত্যক্ষ করা গেছে। একটি আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, কর্নিয়াই দেহের একমাত্র অংশ, যেটি প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দাতার বয়স কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে না।
জৈবিক বয়সের নির্দেশক
সময়ানুক্রমিক বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ বিভিন্নভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যায় এবং দায়িত্ব শেষে নিঃশেষ হয়ে যায়। পুরোনো কোষের শেষ হওয়া এবং নতুন কোষের জন্ম নেওয়ার এই পালাবদলের রকমফের সব ধরনের কোষের ক্ষেত্রে হুবহু একই নয়। সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় কিছু চমকপ্রদ তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে। তারা সব মিলিয়ে মোট ৮৭টি ভিন্ন ভিন্ন অণু এবং অণুজীবের সন্ধান পেয়েছেন, যাদেরকে বলা হচ্ছে বয়োবৃদ্ধির প্রতীক বা বায়োমার্কার। ৮৭টি বায়োমার্কারকে তাদের সংশ্লিষ্ট অঙ্গের সাযুজ্যের উপর ভিত্তি করে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যেগুলোকে বলা হচ্ছে এজিওটাইপ। এই চারটি ভাগ হলো- কিডনি, লিভার, মেটাবোলিক এবং ইমিউনিটি। এই গবেষণালব্ধ ফলাফলানুযায়ী, মানবদেহ মূলত চারটি ভিন্ন ভিন্ন ধরন অনুসরণ করে জৈবিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই গবেষণার ফলাফল আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কী অবদান রাখতে সক্ষম?
আমাদের মাঝে খুব কম মানুষকেই খুঁজে পাওয়া যাবে যারা বুড়ো হওয়াতে আনন্দ লাভ করছেন। চিরকালীন যৌবন যেন মানুষের এক পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। অনন্তকাল ধরে তারুণ্য ধরে রাখতে মানুষের চেষ্টার কোনো শেষ নেই। জৈবিক বয়সকে কিছুটা মন্থর গতির করে দিতে তাই বিশেষ কিছু দিকে নজর দিতে হবে। একজন মানুষ যদি কার্ডিও এজার হন, তাহলে তাকে যেসব বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে- নিয়মিত ব্যায়াম, বাজে কোলেস্টেরল বর্জন, রুটিন মাফিক হার্ট চেকআপ।
মেটাবলিক এজার হিসেবে একজনকে তার খাদ্যাভ্যাস ঠিক করতে হবে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে যদি তিনি তার জৈবিক বয়সকে স্বাভাবিকের চেয়ে ধীর গতিতে এগোতে দিতে ইচ্ছুক হন। আবার একজন লিভার এজার তার সুস্থতার জন্য কখনোই মদ্যপান করতে পারবেন না। তাছাড়া সার্বিকভাবে সকলের জন্যই পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে কার্যকর।
ক্যান্সার ও এপিজেনেটিক্স
জৈবিক বয়স নির্ণয় করার ক্ষেত্রে এপিজেনেটিক্স একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেশ কিছু এপিজেনেটিক নির্দেশকের মাঝে ডিএনএ মিথাইলেশন অন্যতম। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনো নির্দিষ্ট কোষ বা টিস্যুর জৈবিক বয়সের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। ডিএনএ মিথাইলেশনকে বলা হয় মানুষের জেনেটিক নকশার একটি সেমি পার্মানেন্ট পরিবর্তন, যার মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন জিনে মিথাইল মূলকের সংযোজন ঘটে। ডিএনএ মিথাইলেশনের কারণে একটি জীন তার কার্যকারিতা হারাতেও পারে, আবার উল্টোটাও ঘটতে পারে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদেহের অন্যান্য কোষের তুলনায় স্তনকোষের বয়োবৃদ্ধি দ্রুত ঘটে। স্তন টিউমারের বিভিন্ন গ্রেডের মাঝে এপিজেনেটিক বয়োবৃদ্ধির দ্রুততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ক্যান্সার গবেষণায় এ এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল এই প্রশ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে যে, ক্যান্সারের পূর্বাভাস প্রদানের ক্ষেত্রে এপিজেনেটিক ক্লক বা জৈবিক বয়স কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কি না?