X এর অবাধ্যতা যেন দিনদিন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে সমান পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা। কিছুদিন অাগেই পনেরোতম জন্মদিন পালন করেছে সে। এলাকায় দুষ্টের শিরোমণি খেতাব পাওয়া X-কে সামলাতে সবার একেবারে কালঘাম ছোটার জোগাড়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নালিশ অাসছে তার নামে। অাজ অমুকের গাছের অাম চুরি করেছে, কাল তমুকের ছেলের সাথে মারপিট বাধিয়েছে- এমন নালিশ পেতে পেতে বাবা-মায়ের কান নষ্ট হবার দশা।
প্রথম প্রথম এগুলো নিতান্তই দুষ্টুমি বলে ধরে নিয়েছিলেন তারা। তবে তাদের সমস্ত ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো, যখন X সামান্য ঝগড়ার জের ধরে পাশের বাসার ছেলেটির পা ভেঙে দিলো!
বাবা-মা বুঝতে পারলেন, ছেলের এমন অাচরণ সাধারণ দুষ্টুমি বলে উড়িয়ে দেয়ার অার কোনো সুযোগ নেই। তারা পড়িমরি ছুটলেন এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে৷ খুলে বললেন সব কথা। ছেলের সঙ্গে আলাদা করে বেশ খানিকক্ষণ কথা বলার পরে বিশেষজ্ঞ তার বাবা-মাকে সহজ, সরল ভাষায় জানিয়ে দিলেন, তাদের ছেলে একটি মানসিক বৈকল্যে ভুগছে, যার নাম কনডাক্ট ডিজঅর্ডার৷
কনডাক্ট ডিজঅর্ডার কী?
শিশু অথবা বয়ঃসন্ধিকালের কিশোর-কিশোরীর মধ্যে যখন মারাত্মক রকমের আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়, তখনই তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বলে৷ তবে এর মানে এই নয় যে, সন্তান দুরন্ত হলেই অথবা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মারপিট করলেই তার কনডাক্ট ডিজঅর্ডার আছে বলে ধরে নিতে হবে৷ একটি বাচ্চার দুরন্ত স্বভাব বা অবাধ্যতাকে তখনই কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বলে মনে করা হয়, যখন তা দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
এটি কৈশোরের একটি মানসিক রোগ। সাধারণত ১৫ বৎসর বা তার চেয়ে কম বয়সের কিশোর-কিশোরীরা এতে আক্রান্ত হয়। জনগোষ্ঠীর প্রায় শতকরা ১ ভাগ এই মানসিক রোগে আক্রান্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মা, অভিভাবকরা একে মানসিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন না, পারলেও স্বীকার করতে চান না। তাই অনেকক্ষেত্রেই চিকিৎসা হয় না বা বিলম্ব হয়। সাধারণত কিশোরদের মধ্যে দেখা গেলেও কিশোরীদেরও হতে পারে।
কারণ
এ রোগের আসল কারণ এখনো অজানা। তবে গবেষকদের মতে, কিছু কিছু নিয়ামকের কারণে শিশু-কিশোররা কনডাক্ট ডিজঅর্ডারে অাক্রান্ত হতে পারে।
শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন: শিশু-কিশোরের ওপর বাবা-মায়ের বা অন্য অভিভাবকের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কনডাক্ট ডিজঅর্ডার সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও মেয়ে শিশু বা কিশোরীদের ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী বা অন্য কারো দ্বারা যৌন নির্যাতন এ রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা: বাড়িতে অথবা স্কুলে ক্রমাগত শাস্তি (বকাবকি, মারধোর) পেতে পেতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে একগুঁয়ে ভাব তৈরি হয়। তারা ধরে নেয় এটিই স্বাভাবিক এবং তাদের মধ্যে পাল্টা ব্যবহার ফিরিয়ে দেবার অাকাঙ্ক্ষা জাগে। একে ট্রান্সজেনারেশনাল ট্রান্সমিশন অফ ভায়োলেন্স বলে। এভাবে তারা নৃশংস হয়ে পড়ে।
মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ: অনেক অভিভাবকই অত্যধিক আদরের কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস সন্তান চাওয়ামাত্র তাদের হাতে তুলে দেন। ফলে কোনো জিনিসের মূল্য দিতে এরা শেখে না। তাই যখন এদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইচ্ছে পূরণ করতেও অভিভাবক অসমর্থ হন, তখন কনডাক্ট ডিজঅর্ডার দেখা দেয়।
উগ্র আচরণ প্রত্যক্ষণ: শিশু-কিশোররা অনুকরণপ্রিয়, তারা যা দেখে তা শিখে। এটাকে বলে পর্যবেক্ষণমূলক শিক্ষা। তাই টেলিভিশন বা ইন্টারনেটে কার্টুনের আক্রমণাত্মক দৃশ্য বারবার দেখলে এটি তার মনোজগতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব ফেলে, যা থেকে কনডাক্ট ডিজঅর্ডার হতে পারে।
প্রতিশোধপরায়ণতা: অনেক সময় বন্ধু-বান্ধবদের কাছে ক্রমাগত নির্যাতিত হতে হতে, শিশু-কিশোরদের মধ্যে একধরনের প্রতিশোধপরায়ণতা তৈরি হয়। ফলে তারা নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে আস্তে আস্তে কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের দিকে এগিয়ে যায়৷
রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া: নানা ধরনের মানসিক বৈকল্যের কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভ ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি), নানা রকম লার্নিং ডিজঅর্ডার (ডিসলেক্সিয়া), ডিপ্রেশন।
জিনগত কারণ: বংশগত মানসিক রোগের প্রভাব কিছু ক্ষেত্রে ঘটে।
পরিবেশগত কারণ: অস্বাভাবিক পারিবারিক পরিবেশ এবং দাম্পত্য কলহ এ রোগ হওয়ার জন্য দায়ী।
উপসর্গ
সাধারণত চারটি বিশেষ উপসর্গ যদি শিশু-কিশোরের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দেখা যায় এবং ক্রমাগত তা আরও খারাপের দিকে এগোতে থাকে, তাহলে তাকে কনডাক্ট ডিজঅর্ডার বলে চিহ্নিত করা হয়৷
১. আক্রমণাত্মক আচরণ (Aggressive Conduct)
• অাশপাশের মানুষকে শারীরিকভাবে আঘাত করা।
• অকারণেই ঝগড়া বা মারামারিতে জড়িয়ে পড়া।
• সমবয়সী সহপাঠী কিংবা নিজের চেয়ে বয়সে ছোট বাচ্চাদের ‘বুলিং’ করা।
• যৌন নির্যাতন, যেমন ইভ টিজিং, শ্লীলতাহানি এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা।
• পশুপাখির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ প্রদর্শন করা।
২. ধ্বংসাত্মক আচরণ (Destructive Conduct)
• অন্যের সম্পত্তির ক্ষতি করা।
• জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা।
• জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়া।
• কথার মাধ্যমে অন্যদের উত্যক্ত করা।
• কোনো অপরাধবোধ কাজ না করা।
৩. নিয়ম ভাঙা (Violation of rules)
• কোনোরকম নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকা।
• নিয়ম ভাঙাটাই অভ্যাসের মধ্যে পড়ে যাওয়া।
• অবাধ্যতা এবং অনমনীয় মনোভাব।
• স্কুল অথবা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া।
• অভিভাবককে না জানিয়ে রাতে বাড়ির বাইরে অবস্থান করা।
• মাদকদ্রব্যের প্রতি অাসক্ত হয়ে পড়া।
• খুব কমবয়সেই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা।
৪. মিথ্যাচারিতা (Deceitfulness)
• কথায় কথায় অবলীলায় মিথ্যে বলা।
• দোকানপাট থেকে জিনিস চুরি করা (Shoplifting)।
• প্রতারণা করে কারো কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নেয়া।
জটিলতা
যেসকল শিশু-কিশোর কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের সমস্যায় ভোগে, তারা প্রতিদিনের জীবনে নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকে, যা তাদের আরও বেশি করে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে থাকে। এগুলো হলো-
• অ্যাটেনশন ডেফিসিটের সমস্যায় ভোগার ফলে তারা পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়।
• কোনো বন্ধুবান্ধব তৈরি করতে পারে না।
• ক্রমাগত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতে তাদের আত্মসম্মান প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ফলে হয় তারা নিজেদের একেবারে গুটিয়ে ফেলে, নয় তো মারমুখী হয়ে ওঠে।
• কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের চিকিৎসা না করালে অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব বৈকল্য (Anti-Social Personalities Disorder), বিষণ্নতা বা অন্য কোনো মানসিক রোগ দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা
কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি: বিশ্বব্যাপী এ রোগের চিকিৎসায় রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের কাউন্সেলিং করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত। এর মূল লক্ষ্য হলো-
* মনোযোগের ঘাটতি দূর করা।
* অতিরিক্ত চঞ্চলতা হ্রাস করা।
* লেখাপড়া তথা একাডেমিক পারফর্মেন্স বৃদ্ধিতে সহায়তা করা।
* বলা ও লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি।
* রাগ ও আক্রমণাত্মক আচরণ নিয়ন্ত্রণ।
* নিজের কাজ নিজে করার সক্ষমতা বৃদ্ধি।
ফ্যামিলি থেরাপি: বাচ্চা কথা শুনলে তাকে পুরস্কৃত করুন, কথা না শুনলে তাকে বঞ্চিত করুন, সুবিধা কমিয়ে দিন, শারীরিক নির্যাতন না করে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ইতিবাচক মানসিক চাপ অব্যাহত রাখুন।
আবাসিক সুবিধা: অাক্রান্ত বাচ্চাকে আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেয়া যেতে পারে, যেখানে পড়াশোনায় কড়াকড়ি বা চাপ বেশি থাকবে। সেই সাথে কিশোর-কিশোরীদের একটা সুশৃঙ্খল জীবনের মধ্যে অানবার চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
ঔষধ: উগ্র অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ নিয়ন্ত্রণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঔষধ লাগে। তবে এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া অাবশ্যক।
করণীয়
এই সমস্যার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হলো সহমর্মিতা। বিশেষ করে অভিভাবকদের এটি বুঝতে হবে যে, সব বাচ্চা একরকম হয় না। সেই সাথে শাস্তি দিয়ে, মারধোর করে কোনোভাবেই সন্তানকে মানুষ করা যায় না, তা-ও তাদের উপলব্ধি করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা যেমনটা দেখে, তেমনটাই শেখে। তাই তারা অাশপাশ থেকে যে ব্যবহার পাবে, পরিবর্তেও ঠিক তেমন ব্যবহারই ফিরিয়ে দেবে।
সেই সাথে অকারণে দুশ্চিন্তা করাটাও অনুচিত। অনেক সময় ছেলে-মেয়ের দুরন্ত স্বভাব সামাল দিতে দিতে প্রায়ই বাবা-মায়েরা তিলকে তাল করে ফেলেন। তাই আগেই বলে রাখা ভালো, বাচ্চা দুরন্ত বা দুষ্ট হলেই ভাববেন না যে, তার কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের কোনো সমস্যা আছে। সাধারণত ১০০ জন প্রচণ্ড দুরন্ত বা দুষ্ট বাচ্চাদের মধ্যে মাত্র ২-৩ জন বাচ্চার কনডাক্ট ডিজঅর্ডারের সমস্যা থাকে।
ফিচার ইমেজ- sozcu.com.tr