ভাবুন তো, কেমন হত যদি আপনার শরীরে কোন ব্যথাই না থাকতো? কেটে গেল, ছড়ে গেল, হাড় একটা ভেঙ্গে গেল- কিছুতেই যদি ব্যথা না করে? অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে শুনতে? পৃথিবীর প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ এমনই ব্যথাহীন বেঁচে আছে জন্ম থেকে। কে জানে, হয়তো আপনার পাশের মানুষটিও তেমনই একজন। না, এটা কোনো অতিমানবীয় শক্তি নয়। মানব শরীরের দুর্লভ একটি অবস্থা কেবল। যা ইচ্ছে করলেই যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি হাজার সমস্যা অনুভব করলেও জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। সুপার পাওয়ারের সাথে কিছু দায়িত্ব আসে- এই লাইনটি আপনার পরিচিত মনে হতেই পারে। তবে শরীরে ব্যথা না থাকার মতো সুপার পাওয়ারের সাথে আসে কিছু উটকো ঝামেলাও। এ ঝামেলা ছোটোখাটো কিছু নয়, বরং জীবন চলে যাওয়ার মতো ব্যাপারেও রূপ নিতে পারে।
বিস্তারিত জানার আগে চলুন দেখে আসি এই ব্যথা না পাওয়ার ব্যাপারটি আসলে কী। কনজেনিশাল ইনসেন্সিটিভিটি বা সহজাত অনুভুতিহীনতা; আপনি আমি যেমন আমাদের ত্বক কেটে গেলে ব্যথা অনুভব করি, এই মানুষগুলো তার একেবারে উল্টো। কেবল হালকা কেটে যাওয়াই যে তারা অনুভব করে না তা নয়, পুরো একটা হাড় ভেঙ্গে গেলেও সেই অনুভূতি তাদের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায় না। বিজ্ঞানীরা অদ্ভূত এই সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষকে আবিষ্কার করেছেন খুব বেশিদিন হয়নি। পুরনো আমলে পুরো বিষয়টিকে অনেকেই নিশ্চয় নিজেদের অতিমানবীয় ক্ষমতা হিসেবে দেখেছেন, কেউ আবার ভুগেছেন মৃত্যু অব্দি, চারপাশের মানুষের কাছে অদ্ভূত কেউ হয়ে পরিচিত হয়েছেন। তবে বর্তমানে এটি কেবলই একটি শারীরিক অবস্থা।
ভাবছেন, এমন অসম্ভব ভালো একটি ব্যাপাকে আমি বারবার সমস্যা আর ঝামেলা নামক শব্দগুলো দিয়ে কেন বোঝাচ্ছি? ধরুন, আপনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আপনার মাথায় রাস্তার পাশের নির্মাণাধীন দালান থেকে একটি ইট এসে পড়লো। স্বাভাবিক মানুষ হলে, আপনার অনুভূতি থাকলে কী করবেন আপনি? মাথা ফেটে গিয়েছে বুঝে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে চলে যাবেন। আর ব্যথাহীন মানুষগুলো আগের মতই হাঁটতে থাকবে। কারণ এমন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা বুঝতেই পারে না যে, খুব বাজে কিছু একটা ঘটেছে তাদের সাথে। ফলে দ্রুত কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় মৃত্যু হয় এ মানুষগুলোর খুব জলদি। বিশেষ করে, এই সমস্যায় আক্রান্ত শিশুরা বড় হওয়ার আগেই মারা যায়। নিজেদের বাড়তি খেয়াল রাখার মানসিকতা তৈরি হওয়ার আগেই। পিআরডিএম১২; খটমটে নামটি একটি জিনের। মানুষের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে এই জিনটিকে দায়ী করা হয় অনেক সময়। ইউরোপ ও এশিয়ায় ব্যথাহীনতায় আক্রান্ত মোট ১২টি পরিবারকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সম্ভাব্য দোষটা যে পিআরডিএম১২ এরই সেটা নিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন চিকিৎসকেরা। মা কিংবা বাবা, যেকোনো একটি দিক থেকেই এই জিন মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে আর জিনগত পরিবর্তন বা ত্রুটি তৈরি করে। আর এই পরিবর্তনের মধ্যে আমাদের বর্তমান আলোচ্য বিষয় কনজেনিশাল ইনসেন্সিটিভিটিও আছে।
কিশোরী এশলিন ব্লোকার। জর্জিয়াতে বাস করা এই কিশোরীকে নিয়ে সবখানে প্রচুর আগ্রহ। আর এর একমাত্র কারণ তার ব্যথা অনুভব না করা। “আমার ক্লাসের সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা কেমন, আমি বলি আমি চাপ অনুভব করি, তবে ব্যথা নয়”। নিজের অবস্থাকে বোঝাতে কথাগুলো বলেন এশলিন। ছোটবেলা থেকেই এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এশলিন ফুটন্ত পানিতে ঘন্টার পর ঘন্টা হাত ডুবিয়ে বসে থাকতে পারেন। হাত কেটে গেলে, ছড়ে গেলে, পোকা কামড়ালে- কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না তার। আর এজন্যই মেয়েকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই দুশ্চিন্তায় ভোগেন টারা এবং জন। ছোটবেলায় ব্যাপারটি ছিল আরো বেশি কঠিন। না বুঝেই এমন কোনো কিছু ছুঁয়ে দেওয়া, যেটা ক্ষতিকর, আর কোনো ব্যথা অনুভব না করা- এটা ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আপনিই বলুন, আমি কিংবা আপনি, কিংবা একটি ছোট্ট শিশু কেন গরম পানিতে হাত দেই না? কারণ আমরা জানি তাতে করে ব্যথা লাগবে। আমি কিংবা আপনি হয়তো উড়তে থাকা ধোঁয়াটাও খেয়াল করবো। কিন্তু বাচ্চা কোনো শিশু সেই ধোঁয়া খেয়াল না করে পানিতে তো হাত ডুবিয়ে রাখতেই পারে। তার চামড়া জ্বলে যেতেই পারে। অথচ, এতে করে কিছুই অনুভব করবে না সে!
টারা এবং জন এশলিনের এই সমস্যা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। ফলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে জিনগত পরীক্ষা চালানো হয় আর জানা যায় যে, এসসিএন৯এ জিনের দুটো ত্রুটিপূর্ণ কপি এশলিনের শরীরে আছে, যেগুলো কিনা আমাদের শরীরের অনুভূতিগুলো ব্যথা বুঝতে পারা স্নায়ুতে পাঠায়। এই অবস্থাটি এতটাই দুর্লভ যে, বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে এমন কেবল ২০ জনের উল্লেখ করা হয়েছে এখন পর্যন্ত। এর মধ্যে অনেকে আছেন যাদের ক্ষেত্রে অন্য জিনের সাথে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, এই যেমন- এসসিএন৯এ, যেটি আমাদের স্নায়ুতে বৈদ্যুতিক সংকেত পৌঁছে দেয়। তবে এসব ক্ষেত্রে পিআরডিএম১২ জিনের ভূমিকাটাও বেশ বড়।
ক্রোমাটিন নামক প্রোটিন মানুষের ক্রোমোজোমের ডিএনএর সাথে জড়িয়ে থাকে। এটি ক্রোমোজোমে অন্য জিন সচল কিংবা অচল করার ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই ক্রোমাটিনের পরিবর্তম, এটিকে বাড়িয়ে তোলা বা কমানো- এমন সবকিছু দেখে পিআরডিএম১২। ফলে জিনগত কোনো পরিবর্তনে পিআরডিএম১২ সরাসরি না হলেও, অনেকটা কলকাঠি নাড়ায়। মোট যে ১১টি পরিবারের উপরে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল, তাদের সবার ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, পিআরডিএম১২ মানুষের শরীরের অনেকগুলো জিনের রোধক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া ক্রোমাটিনের ভূমিকাও এক্ষেত্রে জোরালো ব্যাপার হিসেবে কাজ করে। গবেষকদের মতে, এই ব্যাপারটি সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে পারলে পরবর্তীতে ব্যথা কমানো বা বাড়ানোর ব্যাপারটি মানুষের হাতে থাকবে। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর ব্যবহার করা সম্ভব হবে তখন। বহুদিন ধরে প্রচন্ড ব্যথায় ভুগছেন এমন রোগীদেরকেও ব্যথা পাওয়ার হাত থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে কেবল এই একটি পদ্ধতি জানা এবং সেটা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে।
তবে বর্তমানে এটি কেবল একটি বাড়তি সমস্যার উৎস। বিশেষ করে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সিআইপি বা কনজেনিশাল ইনসেন্সিটিভিটি টু পেইনে আক্রান্তরা নিজেদের হাত, জিহ্বা নিজেরাই কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলে। অবশ্যই সেটা না বুঝে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়া-চুন চ্যান এ বিষয়ে নিজের মতামত দিতে গিয়ে জানান যে, নতুন রকম এই জিনের কাজ ও ব্যবহার নিয়ে সবাই বেশ আশাবাদী। বিশেষ করে, বর্তমানে ক্রোমাটিনকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে মানব শরীরে নানা রকম অসুখ দূর করার ক্ষেত্রে। তাই দুটো ক্ষেত্রেই এটি ভালো ফলাফল বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন চ্যান। একদিকে সেই মানুষগুলোকে, যারা ব্যথা অনুভব করেন না, তাদেরকে ব্যথার অনুভূতি ফিরিয়ে দিয়ে। অন্যদিকে সেই মানুষগুলোকেও সাহায্য করবে এই নতুন ওষুধ যারা প্রচন্ড ব্যথায় ভুগছেন। আশাবাদী চিকিৎসকেরা, তাঁদের মতো আমরাও আশা বাধতেই পারি ভবিষ্যতের জন্য।
ফিচার ইমেজ: Jaypee Journals | Show Contents