প্রায় সব ওষুধের গায়েই লেখা থাকে “শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ব্যবহার্য“। আপাতদৃষ্টিতে এই নির্দেশনাটি মেনে চলা খুবই কঠিন কাজ। কারো জ্বর হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ‘প্যারাসিটামল‘ খাবার ব্যাপারটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রীতিমত অবাস্তব শোনায়। কিন্তু শুধু প্যারাসিটামলের মতো সাধারণ ওষুধে ব্যাপারটা থেমে নেই। বিভিন্ন গবেষণা আর জরিপ বলছে, উন্নয়নশীল দেশে প্যারাসিটামলের মতো সাধারণ ওষুধ তো বটেই, এন্টিবায়োটিকেরও একটি বড় অংশ বিক্রি হয় ব্যবস্থাপত্র বা কোনো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই!
আর তাই বিভিন্ন রোগের প্রতিকার হিসেবেই হোক আর যেভাবেই হোক, ‘এন্টিবায়োটিক’ শব্দটির সাথে পরিচিতি নেই, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। তবে বিশ্বজুড়ে মানুষের স্বাস্থ্যের হাল হকিকত নিয়ে কাজ করেন যারা, অর্থাৎ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নয়নশীল দেশ এমনকি উন্নত দেশের সিংহভাগ মানুষের ধারণা নেই কোন ওষুধটি আসলে এন্টিবায়োটিক! এর কাজ কী, কেমন করে রোগ ভালো করে এই এন্টিবায়োটিক। তবে এ সমস্ত জিনিসের ধার না ধারলেও বিশ্বজুড়ে মানুষ ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র তো বটেই, নিজেদের খেয়ালখুশি অনুযায়ীও এন্টিবায়োটিক সেবন করে যাচ্ছেন। সাধারণ জ্বর, ঠান্ডা কিংবা মাথাব্যথা সারানোর জন্য এন্টিবায়োটিকের যে কোনো দরকার নেই সেটি বুঝে না ওঠার কারণেই মোড়ের দোকান থেকে অনেকেই কিনে খাচ্ছেন এন্টিবায়োটিক। শুধু তা-ই নয়, পশুখাদ্যে দেওয়া এন্টিবায়োটিক কিংবা হাসপাতালের রোগীর উপর প্রয়োগকৃত এন্টিবায়োটিকের একটি বড় অংশ এসে মিশছে পরিবেশে, ঢুকে পড়ছে মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যশৃঙ্খলে। ধেয়ে আসছে ‘এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ নামের এক দুর্যোগ, যার ফলাফল হতে পারে মানুষের উপর কোনো এন্টিবায়োটিক কাজ না করা। সাধারণ যে সমস্ত রোগব্যাধিকে আগে এন্টিবায়োটিক দিয়ে মোকাবেলা করা যেত, তা আর সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। কিন্তু তার আগে জেনে নেওয়া দরকার এন্টিবায়োটিক আসলে কী আর এর কাজগুলো কী কী।
‘এন্টিবায়োটিক’ শব্দের অর্থ কী?
গ্রীক ‘Bios‘ শব্দের অর্থ জীবন, যেটি থেকে ‘biōtikos‘ শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় ‘জীবনের জন্য উপযুক্ত’। কিন্তু সামনে ইংরেজি উপসর্গ ‘Anti‘ যুক্ত হয়ে পুরো শব্দটিকে করে দিয়েছে নেতিবাচক। অর্থাৎ এন্টিবায়োটিক পুরো শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘জীবন নস্যাৎকারী বস্তু’! কিন্তু কীসের নেশায় তাহলে মানুষ এই জীবন নস্যাৎকারী বস্তু সেবন করে যাচ্ছে?
‘এন্টিবায়োটিক’ কাদের ধ্বংস করে?
মানুষের পাশাপাশি এই পৃথিবীতে বসবাস করে অনেক জীব। এদের কেউ কেউ এতটাই ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা মুশকিল। এমন প্রাণীদের এককথায় বলা হয় ‘অণুজীব’। এই অণুজীবদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ দখল করে আছে ব্যাক্টেরিয়া। তবে এখানে জেনে রাখা ভালো যে, ভাইরাস পোষকদেহ অর্থাৎ মানুষ কিংবা অন্য কোনো প্রাণীর দেহের বাইরে প্রাণহীন। তাই একে জীব বলা যাচ্ছে না। তবে যেহেতু পোষকদেহের ভিতরে এটি প্রাণীর মতোই আচরণ করে, তাই এটিকে জীব আর জড়ের মাঝের একটি ধূসর স্থানেই রেখে দেওয়া হয়েছে। আরো আছে আণুবীক্ষণিক ছত্রাক, প্রোটোজোয়াসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্রপ্রাণ। তবে এন্টিবায়োটিকের মূল কার্যক্রম সংক্রমণ প্রতিরোধ করা।
‘ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে?
ধরে নেওয়া যাক, রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়ার দল কোনো পোষকদেহে প্রবেশ করলো, এরপর সে উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ামাত্র একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি এভাবে বংশবৃদ্ধি করতে করতে থাকে। গণিতের ভাষায় এ ধরনের বৃদ্ধিকে ‘Exponential Growth’ বলা হয়ে থাকে। এভাবে ব্যাক্টেরিয়া সংখ্যায় বাড়তে থাকে।
আর পোষকদেহে কী ধরনের ব্যাক্টেরিয়া ঢুকেছে তার উপর নির্ভর করে সংক্রমণের ধরণটি। ধরে নেওয়া যাক, একটি সুস্থ মানব পোষকদেহে একদল Strepococcus pneumoniae ঢুকে পড়লো। শরীরে থাকা নানা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে পৌঁছে গেল তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য ফুসফুসে। এখানে পৌঁছেও নানাধরনের বাধাবিপত্তি পাড়ি দিয়ে সুযোগ পাওয়ামাত্রই এরা শুরু করে বংশবৃদ্ধি। সুযোগ কীভাবে পায় এর একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
কারো শরীরে হয়তো Strepococcus pneumoniae ঢুকে বসে আছে। ব্যাক্টেরিয়া আর ব্যক্তি দুজনই সুস্থভাবে জীবনযাপন করছে। একদিন হয়তো হঠাৎ করে সেই ব্যক্তি একটু বৃষ্টিবিলাস করে নিলেন অথবা ঠান্ডা আবহাওয়ায় সময় কাটিয়ে নিলেন। আর ব্যাক্টেরিয়ার দল সুযোগ পেয়ে গেল ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটানোর। শুধু নিউমোনিয়া নয়, টিটেনাস, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়া, সিফিলিস, গনোরিয়া, কুষ্ঠ সহ পৃথিবীর মারাত্মক আর ভয়ংকর অনেক রোগের পেছনে কলকাঠি নাড়ে এই ব্যাক্টেরিয়া।
সংক্রমণ রোধের হাতিয়ার কী?
কোনো পোষক যখন এই ব্যাক্টেরিয়াল সংক্রমণের ফলে অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে যান, তখন ডাক্তার তার লক্ষণগুলোর দিকে খেয়াল করে তাকে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করার উপদেশ দেন। পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে নিশ্চিত হওয়া যায় আসলে কোনো ব্যাক্টেরিয়া, অণুজীব কিংবা ভাইরাসের দ্বারা রোগটি সংগঠিত হয়েছে কিনা। সেই নিউমোনিয়া রোগীর উদাহরণে ফিরে আসা যাক। ডাক্তার তার লক্ষণ শুনেই নিউমোনিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এন্টিবায়োটিক দিয়ে দিতে পারেন না। কারণ নিউমোনিয়া যে শুধু Strepococcus pneumoniae নামক ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে সংগঠিত হয় ব্যাপারটি কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। Haemophilus influenzae, Chlamydophila pneumoniae, Mycoplasma pneumoniae, Legionella pneumophila সহ আরো বেশ কয়েক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া দ্বারাও নিউমোনিয়া হতে পারে। তবে ভাইরাসও পিছিয়ে নেই। Rhinovirus, Coronavirus, Influenza virus, Respiratory syncytial virus (RSV) এরাও নিউমোনিয়া ঘটাতে ওস্তাদ। তাই একজন ডাক্তার নিউমোনিয়া শোনার পরেই যদি আপনাকে এন্টিবায়োটিক ধরিয়ে দেন আর আপনার নিউমোনিয়া যদি ভাইরাসঘটিত হয় তাহলে তা মোটেও কাজ করবে না। কিন্তু কেন?
ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে এন্টিবায়োটিক অক্ষম কেন?
ব্যাক্টেরিয়া একধরনের আণুবীক্ষণিক জীব। আর মোটাদাগে এন্টিবায়োটিক ব্যাক্টেরিয়াকে মারে। এটি ব্যাক্টেরিয়ার নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে। যেমন, পৃথিবীর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকের একটি হলো পেনিসিলিন। এই পেনিসিলিন ব্যাক্টেরিয়ার কোষপ্রাচীর ধ্বংস করে। ফলে ব্যাক্টেরিয়াটি আর পোষকদেহে টিকে থাকতে পারে না।
কিন্তু ভাইরাসের তো আর ব্যাক্টেরিয়ার মতো কোনো কোষপ্রাচীর নেই। তাই এন্টিবায়োটিক খেয়ে ভাইরাসজনিত রোগ থেকে সেরে ওঠার স্বপ্নের গুড়ে বালি। তাই আপনার রোগটি যদি স্পষ্টত কোনো ভাইরাসজনিত হয়ে থাকে, তবে মূল্যবান এন্টিবায়োটিকের অপচয় করে মোটেও লাভ নেই।
তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, পৃথিবীর শত শত ব্যাক্টেরিয়ার সবাইকে কিন্তু একটি এন্টিবায়োটিক দিয়ে মারা সম্ভব না। একটু আগে যে পেনিসিলিনের কথা বলা হয়েছিলো তা দিয়ে কিন্তু যক্ষ্মার জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়া Mycobacterium tuberculosis-কে নস্যাৎ করা সম্ভব নয়। কারণ পেনিসিলিন কোষপ্রাচীরের যে উপাদানকে ধ্বংস করে সেই উপাদানটি যক্ষ্মার জীবাণুতে নেই। এজন্য দরকার হলো নতুন এন্টিবায়োটিকের। এভাবে পৃথিবীতে আলাদা আলাদা ব্যাক্টেরিয়াঘটিত রোগের জন্য আলাদা আলাদা এন্টিবায়োটিকের দরকার পড়লো। তাই ডাক্তার যতই অভিজ্ঞ হয়ে থাকুন না কেন, পরীক্ষানিরীক্ষা করা ছাড়া তার পক্ষে এন্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপত্রে দেওয়া বেশ কঠিন কাজ।
কঠিন কাজ কী সহজ হয়ে যাচ্ছে?
লেখার শুরুটা ওষুধের গায়ে যে সতর্কবাণী দিয়ে শুরু হয়েছিলো অর্থাৎ ‘শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ব্যবহার্য‘, এই আপাত কঠিন কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাচ্ছে অনেক দেশে। ওষুধ বিক্রেতাদের উপর নিয়ন্ত্রণের কার্যকর কোনো উপায় না থাকায় খেয়াল খুশিমতো এন্টিবায়োটিক মানুষের হাতে হাতে পৌছে যাচ্ছে। ব্যাপারটি আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে যখন ডাক্তাররা রোগীর রোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কোনো পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে বললেন, কিন্তু রোগী সেটি না করিয়েই এন্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ চেয়ে বসলেন। আর তাই পরীক্ষানিরীক্ষা না করে এবং আপনার রোগের ব্যাপারে ঠিকভাবে না জেনে এরপর থেকে এন্টিবায়োটিক সেবন থেকে বিরত থাকুন।
ফিচার ইমেজ সোর্স- emed.com.au