আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অসংখ্য মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে একটি পানীয়, যার নাম ‘চা’। চা পান করা ছাড়া যেন আমাদের অনেকের একটি দিনও ভাবা যায় না। যেকোনো ঋতুতে সে হোক গ্রীষ্ম,বর্ষা, শরৎ কিংবা বসন্ত, চায়ের গুরুত্ব কখনো কমার নয়।
চা এমন এক ধরনের সুস্বাদু পানীয়, যা আমাদের শরীরের ক্লান্তি কমিয়ে একধরনের প্রশান্তি আনতে সাহায্য করে। কিন্তু শুধুমাত্র প্রশান্তিই নয়, চা আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চায়ে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
বিভিন্ন ধরনের চায়ের মধ্যে ‘সাদা চা’ একটি। বাংলাদেশে সাদা চায়ের তেমন প্রচলন না থাকলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাদা চায়ের কদর রয়েছে। চা গাছের নতুন পাতা সরাসরি শুকিয়ে সাদা চা তৈরি করা হয়। প্রথম চীন দেশে সাদা চায়ের প্রচলন ঘটে।
ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস নামের গাছের কুঁড়ি থেকেই মূলত সাদা চা তৈরি করা হয়। এই চায়ের পাতা সরাসরি সূর্যের আলো দিয়ে শুকানো হয়ে থাকে। এতে কোনো প্রকার রাসায়নিক পদার্থ যোগ করা হয় না। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরের জন্যে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে, ক্লান্তি দূর করতে, প্রাণোচ্ছলতা বজায় রাখতে এবং বিভিন্ন ভিটামিনের সম্পূরক হিসেবেও এটি কাজ করে।
কফির চাইতে কম ক্যাফেইন
অতিরিক্ত ক্যাফেইনের ক্ষতিকারক দিকগুলো সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই জানি। অতিরিক্ত কফিপানের অভ্যাস আমাদের শরীরের জন্যে অসম্ভব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে অনেক স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি বর্তমানে কফির অভ্যাস ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন। তাদের জন্যে চা হয়ে উঠতে পারে অন্যতম বিকল্প পানীয়। বিশেষ করে হারবাল চায়ে ক্যাফেইন নেই বললেই চলে। এছাড়াও সাধারণ চা’য়ে কফির মাত্র ৫০ শতাংশ ক্যাফেইন রয়েছে।
হৃদরোগ কমাতে চা
‘গ্রিন টি’ এবং বিভিন্ন ধরনের হারবাল চায়ের উপর অনেক ধরনের গবেষণায় দেখা গেছে, চা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে বেশ সহযোগী। লাল চা পান করার ফলে দেহে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কম হয় যা শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত রাখে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। ফলে নিয়মিত লাল চা বা গ্রিন টি পান করে হৃদরোগজনিত কঠিন সমস্যা হতে কিছুটা হলেও দূরে থাকা যায়।
ওজন কমাতে সাহায্য করে চা
বর্তমানে ‘গ্রিন টি’ বা হারবাল চায়ের ওজন কমানোর গুণ সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। ওজন কমাতে চায়ের ভূমিকা সম্পর্কে টেলিভিশনে অনেক ধরনের বিজ্ঞাপনেরও প্রচলন রয়েছে। তবে চিকিৎসকদের মতে চায়ের সাথে দারুচিনি ও মধু মিশিয়ে খেলে সেটি স্বাদের পাশাপাশি ওজন কমাতেও সাহায্য করবে। এছাড়াও পুদিনা চা, লেবু চা, জিরা চা বা সাদা চা খাওয়ার ফলে শরীরে মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায়, যা অতিরিক্ত মেদ কমাতেও সহায়ক।
হাড়ের যত্নে চা
চা’য়ে ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি আছে লোহা, ভিটামিন এ এবং কে। এছাড়াও এতে ম্যাঙ্গানিজ ও পটাশিয়াম রয়েছে। ফলে প্রতিদিন দুধ ছাড়া লাল বা লেবু চা খেতে পারলে তা শরীরের হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে।
বিষণ্ণতা দূর করতে চা
লেবু চা বা লেবুর তৈরি রং চা আমাদের অনেকের খুব পছন্দের একটি পানীয়। এই চা তৈরি করতেও যেমন সহজ তেমনি আবার বেশ সুস্বাদুও। লেবুতে আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি এবং পটাশিয়াম।
ভিটামিন সি মানুষের মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা দূর করতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। মানসিক বিষণ্ণতার কারণে শরীরে ভিটামিন সি’র ঘাটতি দেখা যায়। ফলে লেবু চা পান করে সে ঘাটতির কিছুটা হলেও পূরণ করে শরীর চাঙ্গা করে তোলা যায়।
দাঁতের যত্নে লেবু চা
লেবু চা দাঁতের যত্নেও বেশ উপকারী। দাঁতের ব্যথা উপশমে এক কাপ গরম চা বেশ প্রশান্তিদায়ক। অনেক সময় আমাদের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে। এই রক্ত বন্ধ করতেও অনেকসময় লেবুর চা বেশ কার্যকর। এছাড়াও বিভিন্ন খাবার ও পানীয় পান করার ফলেও দাঁতে একধরনের দাগ পড়ে। এই দাগ তুলতেও লেবু চা সাহায্য করে।
ত্বকের যত্নে চা
ত্বকের যত্নেও লেবু চা এবং গ্রিন টি বেশ কার্যকর। নিয়মিত লেবু চা পান করলে ত্বকে কোলাজেনের মাত্রা বাড়ে। কোলাজেন হলো একধরনের তন্তু জাতীয় প্রোটিন, যা আমাদের ত্বকের কোষগুলোকে সজীব রাখতে সাহায্য করে। পরিমিত কোলাজেনের ফলে ত্বক আরো উজ্জ্বল হয় এবং সহজে শুষ্ক হয়ে যায় না।
লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ
তবে চা পানের অনেক ভালো গুণের পাশাপাশি এর মাত্রারিক্ত পান শরীরের জন্যে বেশ ক্ষতিকরও হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত চা পানে কিছু সাধারণ বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা উচিত।
১। খালি পেটে চা খাওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে ‘বেড টি’ গ্রহণের অভ্যাস থেকে বিরত থাকা উচিত।
২। যতটা সম্ভব লাল চা বা লেবু চা পান করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুধ চা শরীরের জন্যে ক্ষতিকর।
৩। চিনি ছাড়াই চা পান করার অভ্যাস করা উচিত। অতিরিক্ত চিনি শরীরের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর।
৪। প্রোটিনযুক্ত খাওয়ার আগে এবং পরে চা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে দুপুরে এবং রাতের ভারি খাওয়ার পর অবশ্যই চা পান থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫। অতিরিক্ত সবকিছুই আমাদের শরীরের জন্যে খারাপ। তাই চা এমনভাবে পান করতে হবে, যা আমাদের শরীরের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।
৬। চা পান করার একটু পর দাঁত ভালোভাবে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। নয়তো দাঁতের জন্যে ক্ষতির কারণ হতে পারে।
৭। অতিরিক্ত চা পানে শরীরের ক্যাফেইনের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। ফলে রাতে নিদ্রাহীনতার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৮। চা এমনভাবে পান করতে হবে, যাতে এটি কোনোভাবেই নেশা বা আসক্তির পর্যায়ে চলে না যায়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চা একটি আবশ্যিক পানীয়। সকাল বা বিকালের নাস্তায়, বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, সময়ের অবসরে, গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে চা যেন একটি অপূরণীয় পানীয়। চায়ের যেমন অনেক ভালো গুণ রয়েছে, তেমনি অত্যধিক চা পান আবার দেহের জন্যে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে হতে পারে। তাই নিয়মের মধ্যে থেকে নিয়ন্ত্রিত চা পান শরীরের জন্যে বেশ উপাদেয়।
ফিচার ইমেজ- healthyliving.azcentral.com