প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে আপনার। ব্যথায় অতিষ্ট হয়ে বাসার তন্নতন্ন করে খুঁজে চলেছেন অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রফেন জাতীয় ওষুধ। খুঁজতে খুঁজতে আপনার টেবিলের ড্রয়ারে পেয়ে গেলেন এক পাতা ট্যাবলেট। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধরা যাক সেটা প্যারাসিটামল গোত্রের নাপা নামক ওষুধ। আপনি বেশ সচেতন মানুষ। তাই খাওয়ায় আগে ওষুধের মেয়াদ দেখে নিতে গেলেন। কিন্তু সেখানেই বিপত্তি। ওষুধের মেয়াদের তারিখ পার হয়ে গেছে কয়েক মাস আগে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিশ্চয়ই খাবেন না আপনি। সাধারণত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়াই ঠিক না, সেখানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খাবার সাহস নিশ্চয়ই হবে না আপনার।
কিন্তু, যদি আপনি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেতেন, তবে কী হতো? আপনার জীবন্ন বিপন্ন হতে পারত? নাকি যে কারণে ওষুধ খেতে যাচ্ছেন, সেই মাথাব্যথাই দূর হয়ে যেত? নাকি আপনার দেহে ভালো-খারাপ কিছুই ঘটতো না? এসব প্রশ্ন তো রয়েছেই। কিন্তু কখনও ভেবেছেন ওষুধের মেয়াদ কীভাবে পার হয়ে যায়? অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ক্যাপসুল বা ট্যাবলেটে কী ঘটে যে সেটা আর খাওয়ার উপযোগী থাকে না?
চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের দেশে বেশ ব্যয়বহুল। শুধু আমাদের দেশ নয়। পুরো বিশ্ব, এবং বিশেষ করে আমাদের এশিয়ার দেশগুলো ছাড়াও আফ্রিকার দেশগুলোতে চিকিৎসা ও ওষুধের বেশ দাম। অনেক সময় জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়াও সম্ভব হয় না। কিন্তু এমন পরিস্থিতি থাকার পরও বিশ্বে প্রচুর ওষুধ নষ্ট হয় শুধুমাত্র সময়ের মাঝে ব্যবহার না করার কারণে। এ সমস্যার কথা মাথায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অনুরোধে দেশটির খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) একটি গবেষণা চালায়। সেনাবাহিনী তাদের কাছে দামি ওষুধের বিশাল এক চালান পাঠায়, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ছিল, যেগুলোকে মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে বাতিল করা হয়েছে।
আসলে সেনাবাহিনীকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ মেয়াদ শেষ হওয়া দামি দামি ওষুধ সংরক্ষণ করতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর কোটি কোটি টাকার সেসব ওষুধ ধ্বংস করে ফেলতে হয়। তাই এই গবেষণার মুখ্য বিষয় ছিল দুটো: সরকারের টাকা বাঁচানো এবং সেনাবাহিনীর কাছে জমা থাকা ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যায় কিনা সেটা খতিয়ে দেখা। এই গবেষণার অধীনে ৩০০ লট পরীক্ষা করা হয়, যেখানে ১২০ এর বেশি ওষুধ ছিল। গবেষণায় উঠে আসে, নষ্ট বলে চালিয়ে দেয়া শতাধিক ওষুধ তখনও ৯০% কার্যকর। এমনকি মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার ১৫ বছর পরও সেগুলো ব্যবহারযোগ্য!
এরপর, এমন ধরনের গবেষণা আরও হয়েছে, এবং সেসব গবেষণার ফলাফল এসেছে আগের মতোই। এজন্য, ১৯৮৬ সালে, মান ঠিক থাকা ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বাড়ানো যায় কিনা তা দেখার জন্য এফডিএ ‘সেলফ লাইফ এক্সটেনশন প্রোগ্রাম’ চালু করে। এবং এ প্রোগ্রামের ফলাফল অবিশ্বাস্য। অনেক ধরনের ওষুধের মেয়াদ আরও বাড়ানো যায় বলে তারা প্রমাণ পেয়েছেন, এবং এই ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ওষুধের মেয়াদও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তাই, এই গবেষণা যদি এমন ফলাফল সামনে আনে, তবে মেয়াদ উল্লেখ করার প্রয়োজন কোথায়? আসলে ওষুধের গায়ে মেয়াদ উল্লেখ করার পেছনে মূল যে কারণ, সেটাই আমাদের জানাশোনার বাইরে। ১৯৭৯ সালে পাস হওয়া একটি আইনে বলা হয়, ওষুধ বানানোর কোম্পানিগুলোকে তাদের ওষুধের গায়ে মেয়াদ শেষ হবার একটি তারিখ দিতে হবে। এই তারিখ পর্যন্ত কোম্পানিগুলো তাদের ওষুধের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার দায়ভার নেবে। উক্ত সময়ের পর ওষুধ গ্রহণ করলে কার্যকারিতা ও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা না-ও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই মেয়াদের অর্থ এমন নয় যে, গায়ে উল্লেখ করা দিনের পর ঐ ওষুধ একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে অথবা তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলবে।
তাই, ওষুধের প্যাকেটের গায়ে যে দিনক্ষণ লেখা থাকে, তার সাথে ওষুধ নষ্ট হয়ে যাবার সম্পর্ক কম। খেয়াল করে থাকবেন, প্যাকেটের গায়ে মেয়াদ ছাড়াও ওষুধের ব্যাচ নম্বর দেয়া থাকে। আর মেয়াদের কথা বলা থাকে, তৈরি করা দিন থেকে বড়জোর ১২-৬০ মাস। এক্ষেত্রে, গায়ে লেখা ঐ মেয়াদ পর্যন্ত ঐ ব্যাচে ওষুধের উপর কোম্পানি সকল প্রকার দায়ভার নেবে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। যেহেতু বানানো ওষুধ মেয়াদ পার হয়ে যাবার পরও ভালো থাকে বলে জানা গেছে, তাহলে কোম্পানিগুলো মেয়াদের মাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে দিলে ক্ষতি কী? এ প্রশ্নের উত্তর হতে পারে দু’রকম:
১. ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা; ওষুধের মেয়াদ যদি অল্পদিনের জন্য থাকে। তবে তাদের কাছে থাকা স্টক দ্রুত ফুরোবে। কারণ, এক ব্যাচের মেয়াদ শেষ হলে নতুন ওষুধের প্রয়োজন হবে। তাই, এ বিষয়টি চলে যাচ্ছে ওষুধের কাটতি ও মুনাফা বাড়নোর দিকে।
২. গবেষণা; ধরুন, কোনো কোম্পানি তাদের একটি ওষুধের মেয়াদ দিল ৫ বছরের জন্য। কিন্তু ১ বছর না ঘুরতেই তারা ঐ ওষুধকে আরও শক্তিশালী বানানোর জন্য নতুন একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করল। কিন্তু তাদের সর্বশেষ ব্যাচের মেয়াদ দীর্ঘ হবার জন্য নতুন ফর্মুলা প্রয়োগ করার সুযোগ নেই তাদের হাতে।
এজন্য, এফডিএ ওষুধ কোম্পানিগুলোকে একটি যথাযথ সময় মেয়াদ হিসেবে ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছে।
তবে, অন্য অনেক ধরনের ওষুধ রয়েছে যেগুলো আবার এমন নিয়মের সাথে যায় না। যেমন: বোতলজাত ওষুধ, চোখ বা নাকের ড্রপ, পাউডার এবং ত্বকে লাগানোর ওষুধ ইত্যাদি। এগুলোতে সাধারণত লেখা থাকে খোলার পর থেকে ১ মাস অথবা ৪ সপ্তাহ পর আর ব্যবহার না করতে। কারণ, কোনো ওষুধের বোতল বা ড্রপার খোলার পর সেটার উপর আর নির্মাতা কোম্পানির কোনো দায়ভার নেই। আর সাধারণত, এ সকল ওষুধের কার্যক্ষমতা আলো, তাপ, আর্দ্রতা এবং সংরক্ষণ পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল। তাই, খোলার ১ মাস পর ওষুধের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। এবং তখন সেবন করলে ফল না পাওয়াই যুক্তিসঙ্গত। আবার চোখ বা নাকের ড্রপ খোলার ২-৩ সপ্তাহ পরে তাতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। তাই এগুলো অনেকদিন পর ব্যবহার না করার ব্যাপারেই উৎসাহ দেয়া হয়ে থাকে।
তাহলে, আমরা মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ওষুধ ইচ্ছা করলেই খেতে পারব? এফডিএ বলছে, না। সেটা করা যাবে না। কারণ, আপনার হাতে আসা ওষুধ কীভাবে এসেছে সেটা আপনি জানেন না। সেটা কোথায় সংরক্ষণ করা হয়েছিল অথবা মেয়াদ পার হয়ে যাবার পর ওষুধে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা, খালি চোখে সেটা বোঝা আপনার জন্য সম্ভব নয়। এছাড়াও, সংবেদনশীল ওষুধ এবং অ্যান্টিবায়োটিকসহ আরও কিছু ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর গ্রহণ করলে, কার্যকারিতা না পাবার সম্ভবনা থেকে যায়। তখন আপনার রোগের চিকিৎসায় ওষুধ কাজে লাগবে না এবং আপনার রোগ বেড়ে জীবন বিপন্নও হতে পারে। এজন্য সাবধানতার খাতিরে হলেও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার পর জটিল রোগের ওষুধ গ্রহণ না করাই পরামর্শ দিচ্ছে এফডিএ।
আমাদের দেশে সবার বাড়িতে প্যারাসিটামল, অ্যান্টিহিস্টামিন, ইসেমিপ্রাজল অথবা আইবুপ্রফেন জাতীয় ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়। সাবধানতা অবলম্বন করে আমরা সেসব ওষুধ নষ্ট করি বা ফেলে দেই। আমাদের দেশের ওষুধের দোকানে মাঝে মাঝেই অসাধু ব্যবসায়ীরা ধরা পড়েন মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির জন্য। সেসব ওষুধ জব্দ করে নষ্ট করে ফেলা হয়। একই কাজ হয় হাসপাতালেও; পর্যাপ্ত চিকিৎসার নিশ্চয়তার জন্য সেখানে মজুদ থাকে অসংখ্য ওষুধ। এবং মেয়াদ শেষ হবার পর সেগুলো নষ্টও করে ফেলা হচ্ছে। এসব দিক চিন্তা করে মার্শাল অ্যালেন ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই প্রোপাবলিকা পত্রিকায় একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেন। সেখানে তিনি লিখেছেন,
এফডিএ জানে মেয়াদ শেষ হয়ে যাবার পরও বেশিরভাগ ওষুধের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা ঠিক থাকে। কিন্তু এসব তথ্য জানা সত্ত্বেও হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোকে প্রতিবছর মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করে ফেলতে হয়। কিন্তু তারা বিবেচনা না করে যে, এসব ওষুধ কত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল।
এই প্রবন্ধে চোখ কপালে তোলার মতো একটি ঘটনার কথাও বলেছেন তিনি।
১৯৬৯ সালের দিকে একটি কালো আলমারিতে একটি বাক্স ফেলে রাখা হয়েছিল। তাতে ছিল বেশ কয়েক ধরনের ওষুধ। ৩০ বছর পর সেটা খুঁজে পাওয়া যায়। সবাই ভেবেছিল বাক্সে থাকা ওষুধ নষ্ট বা বিষাক্ত হয়ে গেছে। ‘ক্যালিফোর্নিয়া পয়জন কন্ট্রোল সিস্টেম’ এর কর্মী লী কানট্রেল এই ওষুধগুলো পরীক্ষা করে দেখার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি ডাকলেন রয় গেরনাকে, তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল নিয়ে গবেষণা করেন। রয় গেরনা বড় হয়েছেন ফিলিপাইনে। ছোটবেলায় তিনি দেখেছেন, সেখানকার মানুষ মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। দুজন মিলে পরীক্ষা করে ফলাফল দেখে অবাক হয়ে যান। ৩০ বছর পরও প্রত্যেকটা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ তখনও চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত ছিল। এবং ওষুধের উপাদান তখনও যথাযথ রয়েছে!
এমন গবেষণা ও ফলাফল দেখে তাই সবাই এখন চেয়ে রয়েছে এফডিএ-র দিকে। তারাই হয়তো পারবে তাদের ‘সেলফ লাইফ এক্সটেনশন প্রোগ্রাম’ এর মাধ্যমে ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বর্ধিত করার কথা বিবেচনায় আনতে। এর ফলে যেমন প্রত্যেক দেশের মূল্যবান অর্থ বেঁচে যাবে, তেমনই এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ওষুধ সংকটের জন্য চিকিৎসা থেমে থাকবে না।