নারীর সুস্বাস্থ্য ও মাতৃত্বের নিশ্চয়তার জন্য ঋতুস্রাব বা মাসিকের গুরুত্ব কতটা, তা আমাদের সকলেরই কম-বেশি জানা। তবে ব্যাপারটা এখনও কোথাও কোথাও ট্যাবু আকারে রয়ে গেছে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশ এখনও এই স্বাভাবিক ব্যাপারটি সহজভাবে নিতে পারেনি। এগুলোর মাঝে আফ্রিকা, নেপাল, ভারতসহ কিছু দেশের কথা না বললেই নয়। তবে শুধুমাত্র মাসিকই এসব অঞ্চলের মেয়েদের ভীতির কারণ নয়, আরও ভয়াবহ কিছু ট্যাবু এখনও রয়েছে আফ্রিকাতে।
ভীতির কারণ মাসিক
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আফ্রিকার কিছু অঞ্চলের মেয়েদের কাছে মাসিক মানে এক ভয়াবহ অসুখ। অধিকাংশ মেয়েরা যখন জীবনে প্রথমবারের মতো মাসিক এর মুখোমুখি হয়, তখন তারা একে অসুখ বা অভিশাপ মনে করে। আফ্রিকার অনেক জায়গায় মাসিককে এখনও অপবিত্র মনে করা হয় এবং এ বিষয়ে কথা বলতে তারা লজ্জা ও চরম সংকোচ বোধ করে। বিশেষত পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা এবং উপ-সাহারান আফ্রিকা অংশের নারীরা মাসিকের সময় বেশি ভোগান্তিতে পড়েন। এর মূল কারণ স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড বা টেম্পুনের অভাব। এসব অঞ্চলের মানুষজন এতটাই দরিদ্র যে প্যাড বা টেম্পুন কেনার সামর্থ্যও তাদের নেই।
বেশিরভাগ নারী খড়, পুরোনো মোজা, গাছের পাতা, খবরের কাগজ, ন্যাকড়া বা ছেঁড়া কাপড় ব্যবহার করে। যারা হতদরিদ্র ও গ্রাম্য অঞ্চলের, সেসব নারী কিছুই ব্যবহার করে না। এবং উপ-সাহারান আফ্রিকা অংশের প্রতি ১০ জন কিশোরীর মধ্যে একজন স্কুলে যায় না মাসিকের জন্যে। এমনকি মাসিকের দিনগুলোতে কমবয়সী মেয়েদেরকে স্কুলে যেতে বাধা দেওয়া হয়, যেন স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার খরচ বাঁচানো যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কেনিয়ার ৬৫ শতাংশ নারী স্যানিটারি পণ্য ব্যবহার করতে পারেন না দামের জন্য। তাদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারগুলোর উপার্জন দিনে ২ ডলার এবং এই ২ ডলার দিয়ে তারা খাবার কিনবে নাকি স্যানিটারি পণ্য, সেই প্রশ্ন বাহুল্যমাত্র। ২০১৫ সালে কেনিয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩,০০০ কিশোরীর মধ্যে ১৫ বছর বয়সী প্রতি ১০ জন কিশোরীর ১ জন যৌনকর্মে লিপ্ত হয় শুধুমাত্র স্যানিটারি পণ্য কেনার খরচ জোগানোর জন্য। এতে করে এইচআইভির ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, কেনিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকার আরো বেশ কিছু দেশের মাত্র ৩২ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের স্যানিটারি পণ্য পরিবর্তনের জন্য আলাদা স্থান রয়েছে। যদিও কেনিয়ার সরকার ইউনিসেফের সাথে একত্র হয়ে প্রতিটি স্কুলে মাসিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য গাইডলাইন দিচ্ছে, তবে অনেকেই একে গুরুত্বের সাথে নিচ্ছে না। অনেক স্কুলে শিক্ষকরা প্রজনন শিক্ষার ব্যাপারটি এড়িয়ে যান। এতে করে ছেলে-মেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালে তাদের শারীরিক পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারে না।
মাসিক মানেই ঘর থেকে বিতাড়িত
নেপালে মাসিকের দিনগুলোতে নারীদের কাটাতে হয় বাড়ির বাইরে। এই হিন্দু প্রথাকে ‘ছাউপাদি’ বা ‘ছৌপদী’ বলে, যা প্রধানত নেপাল ও ভারতের কিছু অংশে প্রচলিত আছে। কিছু কিছু পরিবার তাদের মেয়ে বা বৌদের জন্য আলাদা ছাউনি বা কুটির তৈরি করে। তবে অনেক পরিবারে নারীদেরকে পশুদের গোয়ালঘরে থাকতে হয় এই দিনগুলোতে। ঘরগুলো মাটি ও খড়ের তৈরি এবং ঘরগুলো এতটাই ছোট থাকে যে সেখানে একজনের সমপরিমাণ জায়গা থাকে। এতে করে হিমালয়ের প্রচণ্ড শীত সহ্য করে তাদের থাকতে হয়। অনেক পরিবারে নারীদেরকে এ সময় রান্নাঘরে যেতে দেওয়া হয় না, এমনকি তাদেরকে বিশুদ্ধ পানিও ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না।
যদিও নেপালের সুপ্রিম কোর্ট ২০০৫ সালে এই প্রথাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে, তবুও মধ্য ও পশ্চিম নেপালসহ কয়েকটি জায়গায় এখনও কম-বেশি এ প্রথা চালু রয়েছে। প্রথা ভঙ্গ করলে এর পরিণাম কী হবে, কোনো অভিশাপ পড়বে কি না- এসব ভয়ভীতির কারণেই অনেক পরিবার এখনও এই প্রথা মানছে। এমনকি শহরের পরিবারগুলোও আলাদা ঘর ভাড়া করে পরিবারের নারী সদস্যদের মাসিকের দিনগুলোর জন্য। কিছু কিছু গোত্রে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত এসব ঘরে থাকতে হয়, যাকে বাংলা পরিভাষায় ‘আঁতুড়ঘর’ বলা হয়। এতে করে নবজাতক ও মা দুজনেরই স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। নেপালের সংসদে আগস্ট ২০১৭ সালে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়া একটি আইনে ছৌপদীকে গর্হিত অপরাধ হিসেবে বলা হয়েছে। আইনটিতে উল্লেখ রয়েছে,
একজন নারীকে তার মাসিক বা প্রসবোত্তর অবস্থায় ছৌপদীতে রাখা উচিত নয়, বা কোনো ধরনের বৈষম্যজনক বা অস্পৃশ্য এবং অমানবিক আচরণ করা উচিত নয়।
মাসিক মানেই হাজার রকম বিধিনিষেধ
ভারতের কিছু রাজ্যে মাসিকের সাথে সম্পর্কিত কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে এখনও এবং সেগুলোর অনেকটাই নেপালের সাথে মিলে যায়। এসব রাজ্যের মানুষদের কাছে মাসিক মানেই নারী অপবিত্র; সুতরাং ধর্মগ্রন্থ বা পবিত্র গ্রন্থগুলো এ সময় ছোঁয়া নিষেধ। এমনকি রান্নাঘরেও প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিছু রাজ্যে খাবারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন- আচার, টক দই, তেঁতুল ইত্যাদি টকজাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। তাদের ধারণা, এসব খাবার মাসিকের প্রবাহ কমিয়ে বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারে।
আবার অনেক গ্রামাঞ্চলে পরিবারের ধারণা, মাসিকের সময় শরীর থেকে যে আঁশটে গন্ধ আসে সেটার জন্য এসব টকজাতীয় খাবার দায়ী এবং শরীরের এই আঁশটে গন্ধ নাকি সংরক্ষিত বা রান্না করা খাবার নষ্ট করে ফেলতে পারে। তবে আজ পর্যন্ত কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এই ধারণার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মাসিকের দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা। কিন্তু ভারতের কিছু রাজ্যে মাসিকের দিনগুলোতে গোসল করা সম্পূর্ণ নিষেধ, এমনকি ব্যবহারের পানিও ছোঁয়া নিষিদ্ধ।
এসব বিধিনিষেধ ভারতের নারীদের শুধুমাত্র শারীরিকভাবেই প্রভাব ফেলে না, বরং মানসিকভাবেও বিষণ্ণ করে তোলে। মাসিক নিয়ে সঠিক ধারণা ও পর্যাপ্ত স্যানিটারি পণ্য না থাকার ফলে দরিদ্র পরিবারের মেয়েগুলো স্কুল থেকে ঝরে পড়ে, যা গোটা ভারতের মেয়েদের প্রায় ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতের প্রায় ৭৭ শতাংশ কিশোরী ও নারী মাসিকের সময় পুরোনো নোংরা কাপড় ব্যবহার করে এবং ৮৮ শতাংশ নারী প্রায়ই ছাই, কাগজ অথবা খড় ব্যবহার করে।
তবে শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই নয়, অন্যান্য কিছু দেশেও মাসিক নিয়ে সঠিক ধারণার অভাব রয়েছে। মাসিক নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে সঠিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাব প্রবলভাবে লক্ষণীয়। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্যাড, টেম্পুন বা কাপ তৈরি করা হলেও সঠিকভাবে হাত ধোয়া কর্মসূচি সম্পর্কে ভুলে যায় অনেকেই। যেমন- জিম্বাবুয়েতে মাসিক নিয়ে এক কর্মসূচিতে এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি কর্মসূচির বাইরে চলে যায়, অনেক পুরুষ শিক্ষক এই সমস্যা সমাধান করতে ব্যর্থ হন। আসলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যখন শিক্ষকদের বিশাল অংশ পুরুষ হয়। তাই নারী শিক্ষকদের পাশাপাশি পুরুষ শিক্ষকদেরও মাসিক নিয়ে সঠিক ধারণা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
স্যানিটারি পণ্যের অতিরিক্ত দাম উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীদের জন্য প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা দূরীকরণে প্যাডের পরিবর্তে মাসিক কাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি কাপ একবার ব্যবহারের পর ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে সেটি প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তবে প্রতিবার ব্যবহারের পর অবশ্যই ভালোভাবে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।