বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান মিঠু (ছদ্মনাম)। কিছুদিন অাগেই ৬ বছরে পা দিয়েছে। সাধারণত এই বয়সে অন্যান্য বাচ্চারা হাঁটতে শিখে গেলেও ছোট্ট মিঠু এখনো একা একা হাঁটতে পারে না। অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয় তার। এছাড়াও নিজের খেলার সাথী ও পরিবারের লোকজনদের চিনতে পারলেও নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিনে উঠতে পারছে না সে।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। অর্থবহ এবং সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেও তার খুব অসুবিধা হয়। কেবল ক্ষুধা লাগলে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ-গো শব্দ করে, যা শুনে অভিভাবকরা বুঝতে পারেন তার ক্ষুধা লেগেছে। অাদরের সোনামানিকের এমন অাচরণ “ঠিক হয়ে যাবে” এই অাশ্বাসবাণীতে উড়িয়ে দিতেন তার বাবা-মা। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে বাড়তে লাগলো অস্বাভাবিকতার প্রকোপ। সেই সাথে বাবা-মায়ের কপালে পড়তে লাগলো দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
অনেক বাদানুবাদের পর মিঠুকে নিয়ে বাবা-মা পরিচিত এক শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। শিশু বিশেষজ্ঞ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মিঠুর বাবা-মাকে জানালেন, তাদের সন্তান বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা নামক এক বিশেষ সমস্যায় আক্রান্ত এবং তার মস্তিষ্ক একজন এক বছর বয়সী শিশুর সমান বুদ্ধির অধিকারী।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কী?
জন্মের পর আমাদের প্রত্যেকের প্রায় ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে। যেমন- দেড় বছর বয়সের মধ্যেই শিশু অল্প কিছু শব্দ বলা শিখে ফেলে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা না ঘটলে বুঝতে হবে যে শিশুর মানসিক বৃদ্ধিতে ঘাটতি রয়ে গেছে অথবা তার আইকিউ ৮৫ এরও নিচে। এসকল শিশু বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার শিকার বলে অভিহিত করা যায়।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশনকে অনেকেই পাগলামি বলে অভিহিত করে থাকেন। যদিও প্রথাগত পাগল এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শব্দ দুটি কোনোভাবেই একে অপরের সমার্থক নয়। বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তির মানসিক বৃদ্ধির গতি খুব ধীর হয়। বিশেষত মোটর স্কিল (অঙ্গ সঞ্চালনা), কগনিটিভ অ্যাবিলিটি (পরিস্থিতি অনুযায়ী চিন্তা করার ক্ষমতা), সোশ্যাল স্কিল (মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা) এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ফাংশনিং (কথা বুঝতে বা বলতে পারা) ক্ষেত্রগুলোতে অনেক সমস্যা দেখা যায়। বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কোনো মানসিক রোগ নয়, মূলত মানসিক অক্ষমতা মাত্র। বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা অনেক কারণে হতে পারে।
জিনগত কারণ
ডাউন সিন্ড্রোম, ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোম, প্রাডোর উইলি সিন্ড্রোম, রুবিস্টেইন টাবি সিন্ড্রোম, ডি ল্যাঞ্জ সিন্ড্রোম বা সিঙ্গেল জিন ডিজঅর্ডারের মতো জিনগত ব্যাধি থাকলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
পরিবেশগত কারণ
খাদ্যে আয়োডিন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব, গর্ভাবস্থায় অপুষ্টি, গর্ভাবস্থায় মাদকাসক্তি, নিকোটিন ও কোকেন সেবন, গর্ভাবস্থায় রুবেলা, সিফিলিস বা এইচআইভি’র মতো সমস্যা থাকলে।
জন্মগত কারণ
প্ল্যাসেন্টাল ডিজফাংশন, মায়ের হৃদপিণ্ড বা কিডনিতে সমস্যার ফলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে। এছাড়াও যেসব শিশু নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করে, জন্মের সময় ওজন ২ কেজিরও কম থাকে বা জন্মের সময় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগে তাদের বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত কারণ
বিভিন্ন রোগ, যেমন- শ্বাসকষ্ট, জন্ডিস, হাইপোগ্লাইসেমিয়া, সেপ্টিসেমিয়া, টিবি, মেনিনজাইটিসের মতো রোগ; বিষাক্ত রাসায়নিক ধাতু (যেমন সীসা) এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
উপসর্গ
মূলত জন্মের পরই এই রোগের কয়েকটি উপসর্গ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৬-১২ মাস বয়সের মধ্যে উপসর্গগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবার অনেক সময় ২ বছর বয়সের আগে কিছু না-ও বোঝা যেতে পারে। অধিকাংশ শিশুরই জন্মগতভাবে এই রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে অনেকের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো দেরিতে প্রকাশ পেতে পারে। এই রোগের খুব সাধারণ উপসর্গগুলো হলো–
- শিশুর হাঁটা শিখতে, হামাগুড়ি দিতে বা কথা বলা শিখতে অনেক বেশি সময় নেওয়া।
- ৪-৫ বছর বয়সেও নিজে নিজে গোসল করতে, খেতে বা টয়লেটে যেতে না পারা।
- সময়ের সাথে সাথে শিশুর মানসিক পরিবর্তন না আসা।
- ভাষা শিখতে এবং গণনা করতে অসুবিধা হওয়া।
- দুর্বল স্মৃতিশক্তি এবং সামাজিক নিয়মকানুন মনে রাখতে অসুবিধা হওয়া।
- নিজের যত্ন নেওয়া শিখতেও সময় নেওয়া।
- ঠিকমত শুনতে বা দেখতে না পাওয়া।
- গোটা শরীর জুড়ে, কিংবা বিশেষ কোনো অংশে খিঁচুনি ধরা।
- সামান্য ঝাঁকুনিতেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়া।
জটিলতা
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার রোগীদের অন্তত ১০% ঠিকমতো শুনতে বা দেখতে পান না। হিয়ারিং এইড, চশমা এবং কারেক্টিভ আই সার্জারির সাহায্যে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এছাড়াও কথা বলতে অসুবিধা, সেরিব্রাল পলসি এবং অটিজমের মতো সমস্যা থাকতে পারে।
চিকিৎসা
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার সম্পূর্ণ নিরাময় অসম্ভব। কিন্তু পর্যাপ্ত সাহায্য ও যত্ন পেলে শিশু তুলনামূলক সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। কারণ চিকিৎসকদের মতে, অযত্ন ও অবহেলার ফলেই বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার রোগীরা অস্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে অাক্রান্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে অানতে সহায়ক কিছু থেরাপি হলো-
অকুপেশনাল থেরাপি
- নিজে নিজে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ কাজ করতে শেখে।
- নিজের যত্ন নিজে নিতে শেখে।
- গৃহস্থালীর কাজ (যেমন রান্না করা, কাপড় ধোয়া) করতে সক্ষম হয়।
- বিনোদনমূলক কাজে উৎসাহী হয়।
স্পিচ থেরাপি
- যোগাযোগ দক্ষতার উন্নতি ঘটে।
- ভাষাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়।
- শব্দভান্ডার বৃদ্ধি পায়।
ফিজিক্যাল থেরাপি
- নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
- হাঁটাচলা এবং নড়াচড়ায় অসুবিধা দূর হয়।
- ইন্দ্রিয়ের সচেতনতা (যেমন: দৃষ্টি, শ্রবণ ও স্পর্শক্ষমতা) বৃদ্ধি পায়।
করণীয়
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কোনো ব্যাধি নয়, প্রতিবন্ধকতা মাত্র। বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের প্রতি অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজের কিছু করণীয় রয়েছে, যা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। এগুলো হলো-
- চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে শিশুর পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত হওয়া।
- অন্যান্য রোগীদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা।
- শিশুর সমস্যাগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করা।
- বিশেষ পদ্ধতিতে শিশুকে লালন-পালনের নিয়ম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেয়া।
- শিশুকে অযথা বকাঝকা, তাচ্ছিল্য কিংবা বিদ্রূপ না করা।
- শিশুকে বেশি আগলে না রাখা।
- অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি পরিহার করে চলা।
প্রতিরোধ
কিছু পরামর্শ মেনে চললে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতায় অাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
- গর্ভাবস্থায় মায়ের যথাযথ পুষ্টিকর (আয়রন ও ক্যালরিযুক্ত) খাদ্য গ্রহণ।
- খাবারের সঙ্গে আয়োডিন যুক্ত লবণ এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গ্রহণ।
- নিউরাল টিউব ডিফেক্ট এড়াতে ফলিক অ্যাসিড ও ট্যাবলেট সম্পর্কে সতর্ক থাকা।
- ২১ বছর বয়সের আগে বা ৩৫ বছর বয়সের পরে গর্ভবতী হওয়া এড়িয়ে চলা।
- গর্ভাবস্থায় মদ, নিকোটিন বা কোকেনের মতো ক্ষতিকর পদার্থ এড়িয়ে চলা।
- সিফিলিসের মতো যৌনবাহিত রোগের সংক্রমণ এড়াতে নিয়মিত পরীক্ষা এবং যত্ন গ্রহণ।
- মায়ের রক্তের গ্রুপ Rh -ve হলে Rh ISO টিকা নেয়া থেকে বিরত থাকা।
- প্রথম গর্ভাবস্থায় অ্যান্টি ডি ইমিউনোগ্লোবিন সম্বন্ধে সতর্কতা অবলম্বন।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এই রোগীর যত্ন নেওয়াও রীতিমতো কঠিন একটি কাজ। তবে মনে রাখা উচিত, বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধী শিশুরা লজ্জার কারণ নয়। পর্যাপ্ত সহযোগিতা এবং যত্ন পেলে তারাও সমাজে মাথা উঁচু করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।