কোভিড-১৯ প্রতিরোধের জন্য ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে বহু অর্থ এবং জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। ঠিক সেই আকারে না হলেও রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতিষেধক তৈরিতেও অনেক শ্রম দেয়া হচ্ছে। যদিও কোনো প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত খুব কার্যকরী প্রমাণিত হয়নি, তবে বেশ কিছু ওষুধ এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এরকম একটি ওষুধ হলো রেমডিসিভির, যা এরই মধ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় ব্যবহার করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন এফডিএ এবং ব্রিটিশ এমএইচআরএ অনুমতি দিয়েছে। ডেক্সামেথাসন নামে একটি স্টেরয়েড, ম্যালেরিয়ার ঔষধ ক্লোরোকুইন ও হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, এমনকি অ্যান্টিবায়োটিক অ্যাজিথ্রোমাইসিনও কোভিড রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বা হচ্ছে।
এসব ওষুধ ব্যবহার করার উদ্দেশ্য রোগের প্রকোপ কমিয়ে রাখা, যাতে হাসপাতালে অবস্থানের দৈর্ঘ্য কমে যায় এবং রোগীর নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন না হয়। খুব সম্প্রতি ব্রিটিশ একটি কোম্পানি করোনা রোগীদের জন্য বেটা ইন্টারফেরন ব্যবহার করে আশাপ্রদ ফলাফল পেয়েছে।
ইন্টারফেরন বেটা
ইন্টারফেরন বেটা (IFN-β) আসলে কী? আমরা জানি, আমাদের শরীর যেকোনো অণুজীবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমের রয়েছে দুটি অংশ। একটি হলো জন্মগত প্রতিরোধ ব্যবস্থা (Innate immune system), যা ভিন্ন ভিন্ন অণুজীবের বিরুদ্ধে সবসময় একইভাবে কাজ করে। অপরটি পরিবর্তনশীল প্রতিরোধ (Adaptive immune system), যা ভিন্ন ভিন্ন অণুজীবের বিপক্ষে ভিন্ন ভিন্নভাবে কাজ করে।
ইন্টারফেরন বেটা একটি প্রোটিন যা ভাইরাল আক্রমণ হলে আমাদের শরীরে সক্রিয় হয়। এর প্রধান কাজ বিভিন্ন উপাদান তৈরি করা যা শরীরে প্রবেশ করা বিপদজনক ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করে আমাদের রক্ষা করতে পারবে। করোনাভাইরাস ইনফেকশন হলে স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারফেরন বেটা তৈরি হয়, তবে এই ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হলো তা এই ইন্টারফেরন বেটা উৎপাদন হ্রাস করে দেয়। ফলে আমাদের শরীর পর্যাপ্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
পূর্ববর্তী গবেষণা
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ১০ থেকে মার্চের ২০ তারিখ পর্যন্ত হংকং শহরে ১২৭ জন রোগীর উপর গবেষণা চালানো হয়। এখানে ব্যবহার করা হয়েছিল ভাইরাস নিস্ক্রিয়কারী ওষুধ রিটোনাভির এবং লোপেনাভির, যার সাথে চামড়ার নিচে প্রয়োগ করা হয় ইন্টারফেরন বেটা। দেখা যায়, যেসব রোগী এই তিন ওষুধের সমন্বয়ে চিকিৎসা পেয়েছেন, তাদের আরোগ্যলাভের গতি আর সম্ভাবনা দুটোই বেড়ে যায়। কিন্তু তিন ধরনের ওষুধ একসাথে করে চিকিৎসা সহজ নয়, তদুপরি ইঞ্জেকশন নিতে হয় বলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া রক্তস্রোতে মিশে যায় বলে ইন্টারফেরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম নয়।
নতুন গবেষণা
ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন শহরভিত্তিক ওষুধ প্রতিষ্ঠান সিনার্জেন(Synairgen) ইন্টারফেরন বেটা নিয়ে গবেষণা শুরু করে। তারা একে পরিণত করলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্যাসীয় কণায়, যা নেবুলাইজার মেশিনের মাধ্যমে শ্বাসের সাথে শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব। অ্যাজমা রোগীরা প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হলে যেমন নেবুলাইজারে গ্যাস নেয়, ঠিক সেভাবে। এতে করে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। প্রথমত, ইঞ্জেকশন দেয়া লাগে না বলে রোগীর অস্বস্তি বা কষ্ট কম হয়। দ্বিতীয়ত, করোনাভাইরাস রোগীর শ্বাসনালীতে বাসা বাধে, তাই সেখানে সরাসরি ওষুধ প্রয়োগ করার মাধ্যমে দ্রুত এবং কার্যকর ফলাফল পাওয়া যায়। তৃতীয়ত, সরাসরি শ্বাসনালীতে ওষুধ যাবার ফলে রক্তস্রোতে তা মিশে যাবার সম্ভাবনা কম থাকে, ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হয়।
সুতরাং সিনার্জেন SNG001 সাংকেতিক নাম দিয়ে তাদের ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আরম্ভ করে। এই ট্রায়ালের জন্য ১০১ জন করোনা রোগীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যারা ইংল্যান্ডের নয়টি বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। অর্ধেক রোগী ওষুধ পান এবং বাকি অর্ধেক ওষুধ না পাওয়া রোগীর অবস্থার প্রেক্ষিতে এর কার্যকারিতা বিচার করা হয়। মার্চের ৩০ তারিখ থেকে মে মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত তাদের শরীরে ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীদের নেতৃত্ব দেন ডক্টর টম উইলকিনসন, যিনি সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্বাসতন্ত্রের রোগের অধ্যাপক।
ফলাফল
সিনার্জেন তাদের গবেষণার একটি প্রাথমিক ফলাফল বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে। তবে মনে রাখা প্রয়োজন- তারা এখন পর্যন্ত ঔষধ প্রশাসনে তা দাখিল করেনি এবং কোনো জার্নালে গবেষণাপত্র ছাপার জন্যও দেয়নি। এটি একেবারেই ছোট একটি সারাংশ। তবে এতে বেশ কিছু আশাব্যঞ্জক ফলাফল তারা দাবি করেছে।
- হাসপাতালে ভর্তি থাকা কোভিড রোগীদের স্বয়ংক্রিয় শ্বাসপ্রশ্বাসের (ভেন্টিলেশন) ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা শতকরা ৭৯ ভাগ কমে গেছে।
- রোগীদের আরোগ্য হবার সম্ভাবনাও এই ওষুধ প্রয়োগে দুই থেকে তিনগুন বেড়ে যায়।
- যেসব রোগী এই ওষুধ পেয়েছেন তাদের হাসপাতালে থাকার দৈর্ঘ্য ছিল গড়ে ছিল ছয় দিন, যা ওষুধ যারা পাননি তাদের থেকে গড়ে তিন দিন কম। তার মানে এই ওষুধ হাসপাতালে অবস্থানের দৈর্ঘ্য এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
- ইন্টারফেরন বেটা কোভিড রোগীদের ভয়াবহ শ্বাসকষ্টের সম্ভাবনা এবং প্রকোপ দুই-ই কমিয়ে দেয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ
সিনার্জেন জানিয়েছে, গবেষণার বিষয়ে সমস্ত কাগজপত্র তারা অবিলম্বে ঔষধ প্রশাসনে জমা দেবে। এখান থেকে দুই রকম ঘটনা ঘটতে পারে। এক, ঔষধ প্রশাসন তাদের বড় আকারে অধিক সংখ্যক রোগীর উপরে গবেষণা চালাতে বলতে পারে। অথবা রেমডেসিভিরের মতো বিশেষ ব্যবস্থায় করোনা রোগীর জন্য সরাসরি ইন্টারফেরন বেটা ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে। যদি সেরকম হয় তাহলে সিনার্জেনকে খুব দ্রুতই বাজারজাতকরণে যেতে হবে। তবে তারা বলছে, সেই প্রস্তুতি তাদের আছে। আসছে শীতের মধ্যেই তারা এক লাখের মতো ওষুধ তৈরি করতে পারবে।
সতর্কতা
সিনার্জেনের ফলাফল যদিও খুশির খবর, তবে বিজ্ঞানীরা এখনই খুব উদ্বেলিত হতে চাইছেন না। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, মাত্র অল্প সংখ্যক রোগীর উপর চালানো গবেষণা আসলে খুব বেশি কিছু প্রমাণ করেনা। এছাড়া সিনার্জেন তাদের গবেষণার মূল যে তথ্যভাণ্ডার, তা এখনো প্রকাশ করেনি। ফলে নিরপেক্ষভাবে তাদের দাবি যাচাইয়ের সুযোগ নেই। আরেকটি বিষয় হলো এফডিএ’র কাছে সিনার্জেনে যে পরিমাণ রোগী গবেষণাতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় বলে জানিয়েছিল নানা কারণে তারা সেটা করতে পারেনি। এছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই এখন পর্যন্ত গ্যাস আকারে ইন্টারফেরন বেটার কোনো ওষুধ অনুমোদন কর হয়নি। ফলে প্রশাসনিক অনেক প্রতিবন্ধকতা এই ব্যাপারে আছে।
অন্যান্য গবেষণা
চীনে ইন্টারফেরন বেটার ড্রপ নিয়ে কাজ চলছে, যা সরাসরি নাকের ভেতরে দেয়া যাবে। এখন পর্যন্ত গবেষকরা যা দেখতে পেয়েছেন তাতে তারা আশাবাদী যে এভাবে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা করা সম্ভব। এছাড়া ইংল্যান্ড এবং আমেরিকাতেও অনেকে ইন্টারফেরন নিয়ে গবেষণা আরম্ভ করতে চলেছেন। সুতরাং আমরা ভবিষ্যতে ভ্যাক্সিনের পাশাপাশি কার্যকরী একটি ওষুধের আশা করতেই পারি।