উনিশ শতকের শেষ দিকের কথা। তখন চলছে উপনিবেশবাদের যুগ। উপনিবেশিক দেশগুলোর প্রতিটিরই শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। নৌবাহিনীর অন্তর্গত বিশাল বিশাল যুদ্ধজাহাজে যে কামানগুলো ছিল, সেগুলো থেকে নিক্ষিপ্ত গোলা লক্ষ্যে নিখুঁতভাবে আঘাত হানার হার ছিল অনেক কম। দেখা যাচ্ছিল, একশোটি গোলা নিক্ষেপ করা হলে তার মধ্যে সঠিক লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারছিল সর্বোচ্চ তিন-পাঁচটি। ব্রিটিশরা এই সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করে, উপায় অনুসন্ধান করে কীভাবে আরও বেশি পরিমাণ গোলা নিখুঁতভাবে লক্ষ্যে পাঠানো যায়। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থানরত ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল পার্সি স্কট তার স্কোয়াড্রনের প্রশিক্ষণের সময় দেখতে পান, ‘প্রোটোটাইপ গান-সাইট’ এবং একটি বিশেষ কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে তুলনামূলক অধিক সফলতার সাথে লক্ষ্যে আক্রমণ চালানো যাচ্ছে। এরপর তিনি তার ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের এই বিষয়ে অবহিত করেন, পর্যায়ক্রমে পুরো ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে তার আবিষ্কৃত কৌশল ব্যবহার করা হয়।
একই ধরনের সমস্যায় ভুগছিল মার্কিন নৌবাহিনীও। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধের সময় এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এক হাজার গোলার মধ্যে মাত্র ত্রিশটি গোলা সফলভাবে লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। এটা ছিল বেশ হতাশাজনক। মার্কিন সামরিক বাহিনীর তরুণ লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম সিমস্ এর সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। দেখতে পেলেন, চাইলে ব্রিটিশদের এই কৌশল অবলম্বন করেই সফলতা অর্জন সম্ভব। কিন্তু তিনি যখন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সামনে এই প্রস্তাব পেশ করলেন যে ব্রিটিশদের গোলা নিক্ষেপের কৌশল মার্কিন নৌবাহিনীর ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হোক, তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে যুক্তি দেখালেন, ব্রিটিশদের কৌশল কোনোভাবেই অবলম্বন করা যাবে না। ওয়াশিংটনের কর্মকর্তাদের মাঝে এটা নিয়ে এত বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল যে, শেষপর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল, যাতে এই কৌশল মার্কিন নৌবাহিনীতেও প্রয়োগ করা হয়!
টেলিফোনের আবিষ্কারক নিয়ে বিতর্ক থাকলেও কাগজে-কলমে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী হলেন আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল। আবিষ্কারের পর যখন তিনি দেখলেন এটা নিয়ে ব্যবসা করতে কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসছে না, তখন তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসলেন, সুবিশাল রেললাইনের পাশ দিয়ে শত শত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তার লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু এটা তার একার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না, তিনি অংশীদার খুঁজছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে না আসায় তিনি প্রভাবশালী মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের দ্বারস্থ হন। তার মুখ থেকে সবকিছু শোনার পর ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম অর্টন (যিনি একইসাথে আমেরিকার শীর্ষ তড়িৎ বিশেষজ্ঞদের একজন ছিলেন) এমন মন্তব্য করেন, যা ছিল গ্রাহাম বেলের জন্য অত্যন্ত অসম্মানজনক। তিনি টেলিফোনকে আখ্যায়িত করেন ‘বাচ্চাদের খেলনা’ হিসেবে।
উপরের দুটি ঘটনা লক্ষ্য করা যাক। প্রথম ঘটনায় মার্কিন নৌবাহিনীতে ব্রিটিশদের সামরিক কৌশল প্রয়োগের প্রস্তাব কোনো যথাযথ কারণ প্রদর্শন ছাড়াই ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছিল। মার্কিন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও নীতিপ্রণেতারা ভেবেছিলেন হয়তো একটু চেষ্টা করলে তারাই এমন কোনো কৌশল আবিষ্কার করবেন, যেটি ব্রিটিশদের চেয়ে আরও বেশি সফলতা এনে দেবে। দ্বিতীয় ঘটনায় মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের আবিষ্কারকে নিয়ে তাচ্ছিল্যের পাশাপাশি একইসাথে অপমানমূলক মন্তব্য করেছিলেন। এই দুটো ঘটনা হচ্ছে এনআইএইচ সিনড্রোমের দারুণ দুটি উদাহরণ। ‘এনআইএইচ’ সিনড্রোমের পূর্ণরূপ হচ্ছে ‘নট ইনভেন্টেড হেয়ার’ (Not Invented Here) সিনড্রোম। এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা একধরনের আত্মগরিমা প্রদর্শন করতে ভালোবাসেন এবং বাইরের কোনো সংগঠনের দ্বারা উদ্ভাবিত কৌশল, ধারণার প্রতি উপযুক্ত কারণ ছাড়াই নিজেদের ঘৃণা কিংবা অবজ্ঞা প্রকাশ করেন।
সাধারণত কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এইধরনের সিনড্রোম বেশি দেখা যায়। অসংখ্য কর্পোরেট কোম্পানি ‘কর্পোরেট ইমিউন সিস্টেম’ নামের একটি গতানুগতিক ধারণার উপর নির্ভর করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিখ্যাত প্রযুক্তিনির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপলের কথাই ধরুন। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কর্ণধার স্টিভ জবসকে তারই প্রতিষ্ঠান থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল একটা সময়ে। এরপর তাদের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময় আসে। দশ বছরে মুনাফা অর্জন তো দূরে থাক, উল্টো প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের মতো লোকসান গুণতে হয়েছিল তাদের। এর মূল কারণ ছিল যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া উচিত ছিল, তারা সেগুলো নেয়নি। নিজেদের কোম্পানির বাইরের যেকোনো ধারণা কিংবা কৌশলকে তারা গ্রহণ করতে অপরাগতা প্রদর্শন করছিল, কর্পোরেট ইমিউন সিস্টেম অনুসরণ করছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালে স্টিভ জবসের প্রত্যাবর্তনের পর তিনি নতুন ধারণাগুলোকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান। এরপরের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। অ্যাপল হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ডগুলোর একটি।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘নট ইনভেন্টেড হেয়ার’ সিনড্রোমের মূল কারণ থাকে আত্মগরিমা। প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের সম্পর্কে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করেন। এই আত্মবিশ্বাস থেকে তারা নিজেদেরকে একসময় অন্যদের তুলনায় ”উচ্চ পর্যায়ের মানুষ’ ভাবতে শুরু করেন। তাদের মনে হতে থাকে, বাকিরা যেসব তত্ত্ব, ধারণা কিংবা উদ্ভাবন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, একটু চেষ্টা করলে হয়তো তার চেয়ে উন্নত বা উচ্চতর পর্যায়ের তত্ত্ব, ধারণা কিংবা উদ্ভাবন সম্ভব। অনেক সময় আবার তারা এটা মনে করেন, হয়তো অন্যদের উদ্ভাবিত ধারণা বা কৌশল হয়তো তাদের ব্যবসায়িক মডেলের জন্য মানানসই হবে না। অন্যদের উদ্ভাবিত বিষয়ের ক্ষেত্রে তাদের একধরনের অবিশ্বাস দেখা দেয়। শুধু তা-ই নয়, অনেক সময় স্রেফ জেনোফোবিয়া থেকে তারা বাইরের দেশের অনেক কিছু তারা ফিরিয়ে দেন, অবজ্ঞা করেন।
‘নট ইনভেন্টেড হেয়ার সিনড্রোম’ বা এনআইএইচ সিনড্রোমের যেমন খারাপ দিক রয়েছে, তেমনই এর একটি ভালো দিকও রয়েছে। অনেক সময় দেখা গিয়েছে, বাইরের কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব, কৌশল কিংবা ধারণা ফিরিয়ে দেয়ার পর পরবর্তীতে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন হয়তো এমন কৌশল বা তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছে, যেটি আসলেই ফিরিয়ে দেয়া তত্ত্ব বা কৌশলের চেয়ে উন্নত ছিল। এভাবে পৃথিবীতে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্র আবিষ্কার হতে দেখেছি আমরা। এছাড়া বিভিন্ন যন্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা উন্নয়নের অনেকগুলো পর্ব দেখতে পেয়েছি আমরা, যেটি দিনশেষে যন্ত্রকে আরও বেশি ব্যবহারবান্ধব ও উন্নত করেছে। যেমন- কম্পিউটার কিংবা সেলফোনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রজন্ম রয়েছে। প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার বা সেলফোনে সুবিধা ছিল অনেক সীমিত। এরপরে কোনো প্রতিষ্ঠান হয়তো ভেবেছে এর চেয়ে আরও উন্নতমানের, ও অধিক সুবিধাযুক্ত সেলফোন বা কম্পিউটার উদ্ভাবন সম্ভব। এভাবে একসময় গবেষণার কারণে দ্বিতীয় প্রজন্মের সেলফোন বা কম্পিউটার পেয়েছি আমরা।
সাধারণত আমরা দেখে থাকি, রোগ বাসা বাধে ব্যক্তির শরীরে। কিন্তু ‘নট ইনভেন্টেড হেয়ার সিনড্রোম’ হচ্ছে এমন একটি রোগ, যা বাসা বাধে পুরো সংগঠন বা কোম্পানির শরীরে। এটি এমন একটি প্রবণতা তৈরি করে, যার কারণে অনেক সময় বর্ণবাদ কিংবা জেনোফোবিয়ার মতোও ঘটনা ঘটে থাকে। পুঁজিবাদের এই পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন থাকার আর সুযোগ নেই, প্রতিটি সংগঠন কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান একে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকে। তাই কর্পোরেট জগত কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রবণতা কমে আসছে।