সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আলোচিত বিষয় হল মোবাইল ফোন রেডিয়েশন বা বিকিরণ। মোবাইলের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার সত্যিই কি আমাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গবেষণাকাজ অব্যাহত রাখলেও এখন পর্যন্ত একক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত এসব সমীক্ষায় বরং উঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল। আজকের আলোচনায় থাকছে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করার প্রয়াস।
বিকিরণ কী?
সহজ কথায়, বিকিরণ বা রেডিয়েশন হচ্ছে শূন্যে (আমাদের চারপাশে) শক্তির একধরনের অবাধ প্রবাহ, যা মূলত তরঙ্গ বা কণিকা আকারে অবিরাম প্রবাহিত হচ্ছে।
সংজ্ঞাটি থেকে বোঝা যাচ্ছে, বিকিরণ হচ্ছে শক্তির একটি রূপ, যা আমাদেরই চারপাশে সবসময়ই যাতায়াত করছে কিন্তু আমরা বিষয়টি দেখতে পাচ্ছি না। এই প্রবাহ পুরোপুরি একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া। পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে শুরু করে মহাশূন্যে, এমনকি আমাদের শরীরের মধ্যেও রয়েছে শক্তির এই অবাধ বা স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ। শক্তির এই নিরন্তর প্রবাহ বা যাতায়াত সেই সুদূর অতীত থেকে বর্তমানে চলছে, এমনকি ভবিষ্যতেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। বিকিরণ বা রেডিয়েশনের উদাহরণ হিসেবে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের তরঙ্গ প্রবাহের কথা বলতে পারি।
বিকিরণ এবং মোবাইল ফোন
এফএম রেডিও তরঙ্গ, মাইক্রোওয়েভ, দৃশ্যমান আলো এবং তাপের মতোই রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি হল একধরনের তরঙ্গ। এই রেডিও তরঙ্গ অন্যান্য নানা তরঙ্গ যেমন এক্স-রে, গামা রে এবং অতিবেগুনি রশ্মি থেকে অনেক বেশি কম ঝুঁকিপূর্ণ।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বর্ণালীর বিচ্ছুরণের উপর ভিত্তি করে বিকিরণকে মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
- আয়নীয় বিকিরণ
- অ- আয়নীয় বিকিরণ
আয়নীয় বিকিরণ
অতিবেগুনি রশ্মি (UV), এক্স- রে, গামা রশ্মি এগুলো আয়নীয় বিকিরণের উদাহরণ। এই ধরনের রশ্মিগুলোর প্রতিটি ফোটন কণাতে প্রচুর পরিমাণে শক্তি থাকে, যা আমাদের শরীরের ডিএনএ কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে ক্যান্সার তৈরি করতে পারে। এ কারণেই আমরা বিভিন্ন অবস্থায় এই ধরনের রশ্মি থেকে সবসময় বেঁচে চলতে চেষ্টা করি।
অ-আয়নীয় বিকিরণ
কিন্তু অ-আয়নীয় বিকিরণের ফোটন কণাগুলো খুব একটা শক্তিশালী না হবার কারণে আমাদের শরীরের ডিএনএ কোষে সরাসরি কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এই ধরনের বিকিরণের উদাহরণ হচ্ছে- বিভিন্ন ধরনের আলোর স্বাভাবিক বিচ্ছুরণ যেমন- দৃশ্যমান আলো, ওভেনের ইনফ্রারেড আলো, ওয়াই-ফাই এবং আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু মোবাইল ফোন।
মোবাইল ফোন কীভাবে কাজ করে?
আমরা যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করি তা মূলত সংযোগ টাওয়ার এবং মোবাইলের অভ্যন্তরস্থ নেটওয়ার্ক অ্যান্টেনার মধ্যে তরঙ্গ আদান-প্রদানের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত তরঙ্গ হচ্ছে এফএম রেডিও তরঙ্গ এবং মাইক্রোওয়েভের মধ্যবর্তী একধরনের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ। এই তরঙ্গ অ-আয়নীয় হবার কারণে সাধারণভাবে আমাদের শরীরের উপরে খুবই কম প্রভাব বিস্তার করে। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। এই তরঙ্গ যে কখনোই আমাদের কোনো ক্ষতি করে না, বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। এই তরঙ্গের সংস্পর্শে আমরা যদি খুব বেশি সময়ের জন্য থাকি এবং বিকিরণের মাত্রা যদি স্বাভাবিকের থেকে বেশি হয়, তবে এই তরঙ্গ দ্বারা আমাদের বিভিন্নভাবে প্রভাবিত বা ক্ষতি হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
মোবাইল ফোন থেকে সৃষ্ট বিকিরণ আমাদের ঠিক কী পরিমাণে ক্ষতি করতে পারে, বিষয়টি ঠিকভাবে বোঝার জন্য আমাদের কয়েকটি বিষয় জানা প্রয়োজন।
- মোবাইল ফোন তথ্য আদান-প্রদানের জন্য কোন মাত্রার রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে?
- ফোনটি থেকে সৃষ্ট বিকিরণের মাত্রাটি ঠিক কত?
- মাত্রার পরিমাণটি আমাদের শরীরে ঠিক কী পর্যায়ের ক্ষতি করতে পারে?
মোবাইল ফোনে সাধারণত ৪৫০ থেকে ২০০০ মেগাহার্টজের মধ্যবর্তী তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। তবে, ৮০০ অথবা ৯০০ মেগাহার্টজের ব্যবহার সবথেকে বেশি দেখা যায়। একটি কল সংযোগে সাধারণত দুই ওয়াট শক্তি উৎপন্ন হয় যা পরবর্তীতে ০.২ ওয়াট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই বিকিরণ মাইক্রোওয়েভের মতো শক্তিশালী নয়। ফলে আমাদের ক্ষতি করতে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন, মোবাইল ফোনের সাধারণ ব্যবহারে সেই পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় না।
মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আসলেই কি ক্যান্সারের কারণ
বর্তমান সময়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। ২০১৪ সালের হিসাবমতে, শুধুমাত্র আমেরিকাতেই প্রায় ৩২৮ মিলিয়ন মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ছিল। এই সংখ্যা বর্তমানে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের হিসাবমতে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৫ বিলিয়ন সক্রিয় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী রয়েছে। এই মোবাইল ফোনগুলো থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণে রেডিও তরঙ্গ উৎপন্ন হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলে তা সত্যিই চিন্তার কারণ।
মোবাইল ফোন কি সত্যিই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হয়েছে অসংখ্য সমীক্ষা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ’এর ভাষ্যমতে-
বর্তমান সময়ের মোবাইল ফোনগুলো সাধারণত স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
আরেক সমীক্ষার তথ্যমতে-
মোবাইল ফোনের ব্যবহারের সাথে ক্যান্সার জাতীয় বিভিন্ন ব্রেইন টিউমার এবং সাধারণ বিভিন্ন টিউমারের সম্পর্ক পাওয়া যায়। তবে এই সম্পর্ক পরোক্ষ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনআইএস (National Institutes of Health) পরিচালিত ২০১৬ সালের এক গবেষণায় বিস্ময়কর তথ্য উঠে আসে। ইঁদুরের উপরে পরিচালিত এই গবেষণার তথ্যানুসারে–
মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত তরঙ্গ মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। মানুষের সাথে মোবাইলের সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে মানুষের জায়গায় ইঁদুর দিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়। বিভিন্ন নমুনা প্রতিদিন ৯ ঘণ্টা করে একসাথে রেখে নির্দিষ্ট সময়কাল শেষে দেখা যায়, ইঁদুরের মস্তিস্কে বিকিরণের প্রভাব সুস্পষ্ট।
এ জাতীয় বিভিন্ন দেশে পরিচালিত সমীক্ষাগুলোর ফলাফল সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রদান করে। অনেক সমীক্ষা মোবাইল ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মারাত্মক ব্রেইন টিউমারসহ অন্যান্য বিভিন্ন ক্যান্সারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। আবার অনেক সমীক্ষা এই জাতীয় ধারণাকে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে। ফলে গবেষকরা এই সম্পর্কে কোনো অবিসংবাদিত সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। তবে, বিজ্ঞানীরা বরাবরই মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তাদের অনেকের মতে, মোবাইল ফোন আমাদের শরীরের জন্য খুব বড় কোনো হুমকিস্বরূপ না হলেও এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের শরীর এবং মনের উপর অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করে।
মোবাইল ফোন রেডিয়েশন থেকে বাঁচার উপায়
মোবাইল ফোন এখন আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোবাইল ফোন ছাড়া বর্তমান সময়ে একটি দিন কাটানোর কথা চিন্তাই করা যায় না। কাজেই এই অত্যাবশ্যকীয় মোবাইল ফোন থেকে যাতে আমাদের কোনো ক্ষতি না হয়, তাই এর ব্যবহারে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
- মোবাইল ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা না বলা। এক্ষেত্রে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার প্রয়োজন হলে মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্রাম নেয়া। কেননা, দীর্ঘসময় মোবাইল ফোনে কথা বললে কান ব্যথা, মাথা ব্যথাসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
- দীর্ঘসময় মোবাইল ফোনে গান না শোনা। এক্ষেত্রে হেডফোনে গান শোনার জন্য কম ভলিউম ব্যবহার করা।
- দীর্ঘসময় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে না থাকা। দীর্ঘসময় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ ব্যথাসহ মাথাব্যথা হতে পারে।
- মোবাইল ফোন ক্রয়ের সময়ে মোবাইলটি কতটা পরিবেশবান্ধব সেদিকে নজর রাখা। এখনকার মোবাইলগুলোতে সাধারণত সার (SAR) ভ্যালু প্যাকেটেই লেখা থাকে। এক্ষেত্রে একটু সতর্ক হলেই আমরা কম রেডিয়েশনের মোবাইল ফোন পেতে পারি।
ফিচার ইমেজ- undergroundhealthreporter.com