যারা বর্তমান বিশ্ব সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তারাও এ কথা স্বীকার করবেন যে, আজকালকার সময়ে মানুষের মাঝে স্মার্টফোন আসক্তি যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে স্মার্টফোনকে হিরোইন কিংবা ইয়াবার সাথে তুলনা করা হলেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না।
বিশেষ করে স্মার্টফোনের বহুমুখী ব্যবহারের কারণে অনেকে এর ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন যে, এটি ছাড়া তাদের একটি দিনও চলতে চায় না। তাই সময়ের পরিক্রমায় স্মার্টফোন হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের সঙ্গী এবং পথপ্রদর্শক।
কিন্তু স্মার্টফোন দিনশেষে কেবলই একটি যন্ত্র। এর রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। সঙ্গত কারণেই এটি সবসময় ব্যবহারহারীকে সঙ্গ দিতে পারে না। এই নিঃসঙ্গতা ব্যবহারকারীর মনে সৃষ্টি করে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা এবং নিরাপত্তাহীনতা, যার নাম নমোফোবিয়া।
নমোফোবিয়া কী?
নমোফোবিয়া এসেছে ‘নো মোবাইল-ফোন ফোবিয়া’ পরিভাষা থেকে। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের অনুপস্থিতিতে ব্যক্তি যে ভীতিতে আক্রান্ত হন, সেটিই নমোফোবিয়া। কেউ নমোফোবিয়ায় অাক্রান্ত হলে তিনি মোবাইল ফোন ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারেন না। কোনো কারণে সাধের মোবাইলটি চোখের আড়াল হলেই মোবাইল ফোনের কী হলো, সেটি কী অবস্থায় আচ্ছে- সেটি নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তা শুরু দেন।
একজন নমোফোবিক যে শুধু মোবাইল ফোনের উপস্থিতি নিয়েই দুশ্চিন্তা করেন তা নয়। মোবাইলটির চার্জ ঠিকঠাক আছে কি না কিংবা মোবাইলে রাখা ফাইলগুলো মুছে গেলো কি না, সেটি নিয়েও তার উদ্বেগের অন্ত থাকে না।
নমোফোবিয়ার ইতিহাস
নমোফোবিয়ার ইতিহাসটা খুব পুরনো নয়। ২০১০ সালে শব্দটি প্রথম মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। ইউগভ নামক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি জরিপ এই অদ্ভুতুড়ে ব্যধিকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে। জরিপটি পরিচালিত হয় ইউকে পোস্ট অফিসের অধীনে।
এই জরিপে অংশ নেয়া ২১৬৯ জনের মতামত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদের মধ্যে শতকরা ৫৩ ভাগ নিজেদের ফোনটিকে হাতের কাছে না পেলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এ থেকে প্রতিষ্ঠানটি এই সিদ্ধান্তে আসে যে, সমগ্র বিট্রেনের প্রায় ৫৫ শতাংশ সেলফোন ব্যবহারকারীই নিজেদের এই প্রিয় যন্ত্রটির সান্নিধ্যের অভাবে বিভিন্ন উপসর্গে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। আর একেই নমোফোবিয়া নামে উল্লেখ করা হয়।
২০১৮ সালে শব্দটি সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে gender gap, ecocide ও no-platforming শব্দগুলোকে পেছনে ফেলে বছরের পিপল’স ওয়ার্ড হিসেবে কেমব্রিজ অভিধানে জায়গা করে নেয়।
নমোফোবিয়া শনাক্তকরণ
নমোফোবিয়া শনাক্ত করা সম্ভব কি না, সেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক গবেষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আইওয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত নমোফোবিয়া কোশ্চেনিয়ারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এটি মূলত বিশটি মন্তব্য সম্বলিত একটি প্রশ্নমালা, যেগুলো সর্মথন বা অসমর্থন করার মাধ্যমে কেউ এই ব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছেন কি না, সেটি শনাক্ত করা যায়। মন্তব্যগুলো বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন- ফোন ব্যবহার করতে না পারলে নিজেকে বন্দি মনে হয় / ফোনের ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার আতঙ্কে ভুগি / ইন্টারনেট ডেটা লিমিট পেরিয়ে গেলে ভীত হয়ে পড়ি / ডেটা সিগন্যাল না পেলে ওয়াইফাই খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠি ইত্যাদি।
নমোফোবিয়া পরিমাপ
জরিপে অংশগ্রহণকারীরা প্রশ্নে উল্লিখিত মন্তব্যগুলোকে বিভিন্ন মাত্রায় সমর্থন কিংবা অসমর্থন করতে পারেন। যেখানে পুরোপুরি সহমত পোষণের জন্য ১ এবং পুরোপুরি একমত না হওয়ার জন্য ৭ পয়েন্ট দেয়া হয় । এরপর প্রশ্নোত্তর জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের প্রাপ্ত পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে তাদেরকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।
১. মৃদু মনোফোবিক: যাদের পয়েন্ট ২১ থেকে ৫৯ এর মধ্যে।
২. মাঝারি মনোফোবিক: যাদের পয়েন্ট ৬০ থেকে ৯৯ এর মধ্যে।
৩. তীব্র মনোফোবিক: যাদের পয়েন্ট ১০০ এর বেশি।
এভাবেই ব্যক্তি নমোফোবিয়ায় কতটুকু আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, সেটি নির্ণয় করা যায়।
নমোফোবিয়ার উপসর্গ
- মোবাইল ফোনের অনুপস্থিতিতে সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তা করা।
- একটু পরপর মোবাইল ফোন ঠিক অাছে কি না সেটি পরীক্ষা করা।
- অন্য কারো হাতে মোবাইল ফোন গেলে, সেটি ফিরে পাবার জন্য অহেতু্ক ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠা।
- ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে আতঙ্কিত হয়ে পড়া।
- মোবাইলে সংরক্ষিত ফাইল মুছে গেলে আতঙ্কিত হয়ে পড়া।
এছাড়া অন্যান্য শারীরিক-মানসিক লক্ষণগুলো হলো:
- মাথা ভন ভন করা
- শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসা
- বমি বমি ভাব
- দেহে ঘামের উদ্রেক ঘটা
- মনোযোগে বিচ্যুতি ঘটা
- হৃদকম্পনের গতি বেড়ে যাওয়া
- বিষন্নতা ও একাকিত্ববোধ
- গায়ে কাঁপুনি দিয়ে ওঠা
- বুকে ব্যথা হওয়া
নমোফোবিয়ার প্রকোপ
ইউগভ পরিচালিত জরিপে থেকে জানা যায় গেছে, প্রায় ৫৮ শতাংশ ব্রিটিশ পুরুষ নমোফোবিয়ায় ভুগছেন, যেখানে নারীদের ক্ষেত্রে অনুপাতটা হলো ৪৭ শতাংশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ চিত্রটা আরো ভয়াবহ। দেখা গেছে, প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষই নিজেদের সেলফোনটিকে কাছে রেখে ঘুমাতে যান। আর কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ স্বীকার করেছেন, তারা সঙ্গীর সাথে অন্তরঙ্গ হবার সময়ও সেলফোনের কল রিসিভ করে থাকেন। সিকিউর ইনভয়ের তথ্য বলছে, দেশটিতে বসবাসকারী আঠারো থেকে চব্বিশ বছর বয়সী তরুণদের শতকরা ৭৭ ভাগই নমোফোবিয়ায় ভুগছে। অন্যদিকে জনপ্রিয় টাইম ট্র্যাকিং অ্যাপ মোমেন্ট এর মতে, একজন সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী প্রতিদিন গড়ে চার ঘন্টার মতো সময় নিজের ফোনের পেছনে খরচ করে থাকেন।
নমোফোবিয়া এড়াতে যা করবেন
- ফোন সম্পর্কে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলুন। প্রতিদিন ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে যে সময়টি নষ্ট করছেন, তা কত ভালো ভালো কাজে ব্যবহার করা যেতে পারেন, সেটি নিয়ে ভাবুন।
- পরিবার, বন্ধু-বান্ধবকে সময় দিন। সিদ্ধান্ত নিন, রোজ যতক্ষণ মোবাইল ব্যবহার করবেন, ঠিক ততক্ষণ সময় কোনো মানুষের সাথে মুখোমুখি গল্প করে কাটাবেন।
- “ফোন কম চালাবো” এই মানসিকতা থেকে ফোন পরিহার করার পরিবর্তে “আশেপাশের মানুষদের সাথে সময়টা উপভোগ করবে” এই মানসিকতায় ব্রত হোন।
- সপ্তাহে কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে টেকনোলজি ফাস্ট পালন করতে পারেন। যেদিন আপনি একটি নির্দিষ্ট যন্ত্র বা অ্যাপ থেকে দূরে থাকবেন। যেমন- প্রতি সপ্তাহের সোমবার ফেসবুক না চালানো।
- প্রতিদিন অল্প সময় করে ফোন থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে দৃঢ় অভ্যাস গড়ে তুলুন। ঘুমাতে যাবার আগে নিজের ফোনটিকে বিছানা থেকে কমপক্ষে ফুট দূরে রাখুন।
- বর্তমানে অনেক টাইম ট্র্যাকিং অ্যাপ রয়েছে যেগুলো দেখায়, আপনি রোজ কতটা সময় মোবাইলের পেছনে কাটাচ্ছেন। এতে করে দিন দিন আপনার কতটুকু অগ্রগতি হচ্ছে, সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাবেন।
- অন্যদের সেলফোন আসক্তিকে নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করুন। লিফটে কাউকে সেলফোন ব্যবহার করতে দেখলেই চট করে ফোন বের করে ফেলার পরিবর্তে ভাবুন, আপনি তার থেকে ভালোভাবে সময় ব্যবহার করছেন।
- বিভিন্ন শারীরিক কসরতের সহায়তা নিন। এক্ষেত্রে ইয়োগা, মেডিটেশন, প্রাণায়াম আপনার জন্য উপকারী হতে পারে।
নমোফোবিয়া কে যেভাবে সামলাবেন
একজন নমোফোবিকের সবচেয়ে বড় ভয় দুটি। এক, তার মোবাইলটি অক্ষত আছে কি না; দুই, তার মোবাইলের ব্যাটারীর চার্জ যথেষ্ট রয়েছে কি না। এই দুটি ভয়কে মন থেকে দূর করতে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া যেতে পারে, সেগুলো হলো:
- সবসময় ফোন বহন করার জন্য একটি ছোট ব্যাগ ব্যবহার করবেন।
- প্রতিনিয়ত নিজের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি (ছবি, ভিডিও, কন্টাক্ট নম্বর, ইমেইল) এর ব্যাকআপ সংরক্ষণ করবেন।
- ঘর থেকে বেরোনোর পূর্বে মোবাইল ঠিকমতো চার্জ হয়েছে কি না সেটি নিশ্চিত করে তবেই ঘর থেকে বেরোবেন।
- পোর্টেবল ব্যাটারি কিংবা পাওয়ার ব্যাঙ্ক ব্যবহার করবেন।