১৮৯৯ সালে ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস’ গ্রন্থে সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই তত্ত্বের অবতারণা করেন। তবে ১৯১০ সালেই প্রথম এটিকে ‘ইডিপাস কমপ্লেক্স’ বলা হয়। এটিকে বলা হয় তার সবচাইতে বিতর্কিত তত্ত্ব। কারণ এ তত্ত্বে সবচেয়ে শুদ্ধতম সম্পর্কের সাথে যৌনতাকে সম্পর্কিত করা হয়েছে, এবং কেউই সচেতনভাবে এ তত্ত্ব মেনে নিয়ে নিজেকে ও নিজের আকাঙ্ক্ষাকে বিতর্কিত করে তুলতে চাইবেন না। তাই এই তত্ত্বটি বিতর্কিত।
এই তত্ত্বানুসারে, ছেলেসন্তানের প্রথম আকাঙ্খিত নারী তার মা এবং মেয়েসন্তানের প্রথম আকাঙ্ক্ষিত পুরুষ তার পিতা। বাস্তবে এর একটি প্রভাব সবসময়ই দেখা যায়। ছেলেরা প্রেমিকার মধ্যে মায়ের বৈশিষ্ট্য খোঁজে এবং মেয়েরাও চেয়ে থাকে তার স্বপ্নের পুরুষটি তার বাবার মতোই হোক। ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে, এখানে শুধু সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ফ্রয়েড বলছেন, প্রথম যৌন আকর্ষণও পিতা-মাতার প্রতিই আসে এবং সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিতে এর অবৈধতা ও অগ্রহণযোগ্যতার কারণে সন্তান এটি লুকিয়ে রাখে। এই লুকিয়ে রাখাই হচ্ছে কামনার অবদমন এবং অবদমিত কামনা, যা তাকে পরবর্তী জীবনে পিতা কিংবা মাতার মতোই কাউকে পাবার একটি সূক্ষ্ম ইচ্ছার প্রতি ঝুঁকতে সাহায্য করে।
প্রতিটি মানসিক জটিলতার পেছনে দায়ী থাকে অতীতে গেড়ে থাকা কিছু দেখা-অদেখা শেকড়। ইডিপাস কমপ্লেক্সেরও কিছু নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। পাঁচ বছর বয়সের আশেপাশেই ছেলেসন্তানেরা ইডিপাস কমপ্লেক্সের মুখোমুখি হয়ে থাকে। এ থেকে তার মায়ের প্রতি ভালোবাসা এবং বাবার প্রতি একধরনের ঈর্ষাবোধ জন্ম দেয়। কারণ তখন সে তার বাবাকে মায়ের প্রেমিক এবং নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে বসে। মায়ের সবটুকু ভালোবাসা পাবার জন্য তার মনে একপ্রকার প্রতিযোগিতাও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই জটিলতার সাথে আরেকটি নামও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স। মেয়েসন্তানের ক্ষেত্রে যখন এই বিষয়টি ঘটে (বাবার প্রতি), তখন ফ্রয়েড একে বলেন ‘ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্স’। ফ্রয়েডের মতে, এটিই স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব। তিনি শৈশবে তার বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্কের বিভিন্ন অনুসন্ধান চালিয়ে এই তত্ত্বটি দাঁড় করান, তাই এটি একপেশে মনে হতেই পারে। কিন্তু পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা যায় না, কারণ তিনি এর বেশ কিছু যুক্তিযুক্ত ভিত্তিও প্রকাশ করেছেন।
৩-৬ বছর বয়সের মধ্যে অবচেতনভাবে এই ব্যাপারটি ঘটে থাকে এবং এই ধাপটিকে ফ্রয়েডের মনোজগতে যৌনতা বিকাশের ধারণা অনুযায়ী ‘ফ্যালিক স্টেজ’ বলা হয়। এ সময় শিশু বুঝতে শেখে যে সে একজন ছেলে বা মেয়ে। নারী-পুরুষের মধ্যে শারীরিক পার্থক্য বুঝতে পারার পর তারা সবচেয়ে কাছে যে নারী-পুরুষকে দেখে, তা হচ্ছে তাদের পিতা-মাতা। এবং সে কারণেই এই আকর্ষণের উদ্ভব ঘটে। এক্ষেত্রে যদি কেউ যদি পিতা-মাতা ছাড়া অন্য কারো সাথে বসবাস করে, তবে কী হতে পারে, সে সম্পর্কে ফ্রয়েডের তত্ত্বে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।
সাধারণত এই ধাপের সমাপ্তি ঘটে, যখন শিশু যৌনাচার সম্পর্কে সুষ্ঠু জ্ঞান লাভ করে এবং তার বাবা-মায়ের মধ্যকার যৌন সম্পর্কের কথা বুঝতে পারে এবং মেনে নিতে পারে। এটি শিশু অবস্থা কেটে গিয়ে কৈশোরে গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু সবসময় এর সমাপ্তি ঘটবে, এমন নয়। কখনো কখনো সময়ের সাথেও এই জটিলতার ইতি হয় না, এবং ব্যক্তি এ বিষয়ের সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করে নেন। অর্থাৎ এ ধরনের যৌন আকর্ষণ বোধ এবং তা অবদমন- দুটোই তার কাছে নিত্যদিনের বিষয় হয়ে ওঠে। জটিলতার চূড়ান্ত রূপে এমন হয় এবং এ থেকে বাবা-মায়ের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা জোরালো হয়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জটিলতা রয়ে যায়। এছাড়া এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে পরবর্তীতে ছেলে সন্তানটি খুব বেশি উগ্র স্বভাবের এবং মেয়েটি অতিরিক্ত মাত্রায় আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়ে। এই আচরণ অপ্রাপ্তির অনুভূতি থেকে প্রসূত।
ফ্রয়েড এই জটিলতার লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সন্তানের বিভিন্ন সময় বাবা-মাকে কাছে এতে দেখলে রেগে যাওয়া এবং মনোযোগের বিষয়টি নিজের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাকে। মেয়েদের ক্ষেত্রে এমনও বলতে দেখা যায় যে তারা বড় হয়ে বাবাকে বিয়ে করবে। এক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়ে সবসময় তার মায়ের চালচলন অনুসরণ করছে এবং ছেলে বাবার মতো আচরণ করতে চাইছে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ এখানে সন্তানকে সমলিঙ্গের প্রতিদ্বন্দ্বী বানানোর সাথে সাথে অনুকরণীয়ও করে তোলে।
ফ্রয়েড এই জটিলতা থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়িত্বপ্রাপ্ত মনে করেন পিতা-মাতাকেই। তার মতে, সন্তানের ইডিপাস কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রথমে পিতা-মাতার ইডিপাস কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে আসাটা জরুরি।
নামকরণে গ্রিক পুরাণের প্রভাব
এই জটিলতার নামকরণ করা হয়েছে গ্রিক পুরাণের একটি কাহিনী থেকে। থিবেস রাজ্যের রাজা ছিলেন ইডিপাস। তার পিতা লাইয়াস ও মাতা জোকাস্টা। ইডিপাসের জন্মের আগে তার পিতা-মাতা ডেলফি পীঠস্থানে গিয়েছিলেন জানতে যে তাদের আদৌ কোনো সন্তান হবে কিনা। তখন সেখানে ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যায় যে তাদের মিলনের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানই তাদের মৃত্যুর কারণ হবে।
এরপর জন্ম নেন ইডিপাস। কিন্তু মৃত্যুভয়ে তার পিতা চাকরদের নির্দেশ দেন যেন শিশুটির পা বিদ্ধ করে ফেলা হয় এবং সেখান থেকেই তার নাম হয় ‘ইডিপাস’। এর অর্থ ‘স্ফীতপদ’। তারপর জোকাস্টা রাখালদের কাছে ইডিপাসকে দিয়ে দেন এবং বলে দেন তাকে যেন পাহাড়ে নিয়ে রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু রাখালদের মায়া হলো বাচ্চাটির জন্য। তারা রানীর নির্দেশ মানলো না এবং এভাবে একজনের কাছ থেকে অপরজনের কাছে যেতে যেতে ইডিপাস গিয়ে পৌঁছালো কোরিন্থ রাজ্যের রাজা পলিবাস ও রানী মেরোপের কাছে। তারাও ছিলেন নিঃসন্তান এবং শিশুটিকে পেয়ে তাদের আনন্দের শেষ রইলো না। তারা তাকে নিজের সন্তান ভেবেই বড় করতে লাগলেন।
এভাবে কেটে গেলো বছরের পর বছর। বড় হবার পর ইডিপাস জানতে পারলেন যে তারা তার আসল বাবা-মা নন। এ বিষয়ে আরো জানতে ইডিপাস গেলেন সেই ডেলফিতেই। সেখানে দৈববাণীর মাধ্যমে তাকে বলা হলো যে তিনি তার পিতাকে হত্যা করে মাকে বিয়ে করবেন। ইডিপাস ভুল বুঝলেন। তিনি এখানে পিতা-মাতা বলতে রাজা পলিবাস ও রানী মেরোপকে বুঝলেন। দৈববাণী এড়াতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আর ফিরে যাবেনই না কোরিন্থে। এর বদলে তিনি যাত্রা করলেন থিবেসের পথে। পথে তার সাথে দেখা হলো তার আসল পিতা রাজা লাইয়াসের সাথে। লাইয়াস রথযাত্রা করছিলেন। তার সারথির সাথে ইডিপাসের ঝগড়া বাঁধলো। সে ঝগড়ার সমাপ্তি হলো রথের সারথি ও লাইয়াসকে হত্যার মাধ্যমে। এবং নিজের অজান্তেই এভাবে ইডিপাস দৈববাণীর অর্ধেক পূর্ণ করলো।
কাহিনীর এ পর্যায়ে আবির্ভূত হয় স্ফিংক্স। এটি গ্রিক পুরাণের অতি পরিচিত এক দৈত্য। তার দেহের অর্ধেক মানবীর এবং বাকি অর্ধেক সিংহের। শুধু তা-ই নয়, তার ছিল ইগলের ডানা এবং সাপের লেজ। অর্থাৎ দেখতে প্রচণ্ড অদ্ভুত এই দৈত্যের মুখোমুখি হলো ইডিপাস। স্ফিংক্স সবাইকে একটি প্রশ্ন করতো এবং বেশিরভাগই তার উত্তর দিতে পারতো না, ফলে তাদেরকে শিকার হতে হতো স্ফিংক্সের উদরপূর্তির।
সেই একই প্রশ্ন সে ইডিপাসকেও করলো- কোন সে প্রাণী যে সকালে চারপায়ে, মধ্যাহ্নে দু’পায়ে এবং দিনের শেষভাগে তিনপায়ে হাঁটে? ইডিপাস অনেক ভেবে সঠিক উত্তরই দিলো। উত্তরটি ছিল- মানুষ।
শিশু অবস্থায় মানুষ হামাগুড়ি দেয়, যা কিনা চারপায়ে হাঁটার শামিল; বড় হবার পর মানুষ দুপায়ে হাঁটে এবং বার্ধক্য ভর করলে লাঠি নিয়ে হাঁটতে হয়, যা কিনা তিনপায়ে হাঁটার শামিল!
নিজের ব্যর্থতার ভার সইতে না পেরে স্ফিংক্সটি তৎক্ষণাৎ পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। তারপর ইডিপাস পৌঁছান থিবেসের রাজদরবারে। সেখানে জোকাস্টার ভাইয়েরা তাকে বেশ সাদরেই আমন্ত্রণ জানায় এবং বলে যে স্ফিংক্সের হত্যাকারীই থিবেসের রাজা হবে ও জোকাস্টাকে বিয়ে করবে। ইডিপাসও সে কথা মেনে নেন এবং ডেলফির সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়। নিজের মাকে চিনতে না পেরে তিনি বিয়ে করে ফেলেন এবং তাদের চারটি সন্তানও জন্ম নেয়।
এর কয়েক বছর পর থিবেসে মহামারী নেমে আসে এবং রাজা ইডিপাস জোকাস্টার ভাই ক্রেওনকে ডেলফিতে পাঠান সমাধান নিয়ে আসতে। সেখানে গিয়ে ক্রেওন জানতে পারেন যে রাজা লাইয়াসের হত্যাকারীকে শাস্তি না দেবার কারণেই এই মহামারীর উদ্ভব হয়েছে। এ কথা জানতে পেরে ইডিপাস লাইয়াসের হত্যাকারীকে অভিশাপ দিতে লাগলেন। ডেলফির ভবিষ্যদ্বক্তা টিরেসিয়াসের কাছে বারবার জানতে চাইলেন লাইয়াসের হত্যাকারীর নাম। তখন টিরেসিয়াস বলতে বাধ্য হলেন যে ইডিপাসই সেই হত্যাকারী। এবং তিনি সেই সাথে এটাও বললেন যে ইডিপাস জানেন না কে তার প্রকৃত পিতামাতা। এতে করে ক্রেওন ও ইডিপাসের মধ্যে উত্তপ্ত তর্কাতর্কির সৃষ্টি হয় এবং জোকাস্টা এসে তার পুত্র বিসর্জনের কাহিনী বলেন।
এদিকে কোরিন্থ থেকে সংবাদ আসে যে রাজা পলিবাসের মৃত্যু হয়েছে। সে কথা জেনে ইডিপাস যেন কিছুটা স্বস্তি পান, কারণ তিনি ভাবেন যে তার পিতার মৃত্যু অন্তত তার হাতে হয়নি! ভবিষ্যদ্বাণীর অর্ধেকটাও মিথ্যে করতে তিনি আর কোরিন্থে যেতে চাইলেন না, যাতে করে তিনি রানী মেরোপকে এড়িয়ে যেতে পারেন। কিন্তু বার্তাবহনকারী ইডিপাসকে এটাও জানালো যে তিনি পলিবাস ও মেরোপের প্রকৃত সন্তান নন।
এতে করে সবাই সবকিছু বুঝতে পারে এবং রানী জোকাস্টা বিধির এই পরিহাস সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। ইডিপাসও রানীর গাউনের ব্রুচের পিন দিয়ে নিজের চোখ গেলে ফেলেন এবং তার মেয়ে অ্যান্টিগোনের সাথে থিবেস ছেড়ে চলে যান।
ইডিপাস ও তার পিতামাতার নিয়তির এই পরিহাস নিয়ে ৪৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সফোক্লিস লিখেছেন তার বিখ্যাত নাটক ‘ইডিপাস রেক্স’। ইডিপাস কমপ্লেক্সের নামও গ্রিক পুরাণের এই নাটক থেকেই ধার করা। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রয়েড যখন তার এই তত্ত্বটি নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন ইউরোপ জুড়ে মঞ্চ কাঁপাচ্ছিলো এই নাটকটি। অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই যেন এই জটিলতাটির নামকরণ হয়েছিল। ২৫টিরও বেশি দেশ জুড়ে নাটকটির জনপ্রিয়তা ফ্রয়েডকে ভাবতে বাধ্য করে যে পশ্চিমা নাগরিকদের অবদমিত ইডিপাস কমপ্লেক্সই এর কারণ। তিনি মনে করতেন যে, বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কই নাটকটি দেখার সময় এ বিষয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতার কথা ভেবেছেন।
ইডিপাস কমপ্লেক্স অযাচার এবং যৌনতার আদিম প্রবৃত্তিকে সমর্থন করে এবং ফ্রয়েডের মতে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। যদিও সাধারণ সমাজে ইডিপাস কমপ্লেক্সের বিষয়টি একটি ট্যাবু এবং ফ্রয়েডের এ তত্ত্বের ব্যাপারে বহু বিতর্ক রয়েছে।
ফিচার ইমেজ: josephncolosi.com