আমাদের চারপাশের প্রচুর মানুষকে আমরা ‘ভালো লাগছে না’, ‘একা একা লাগছে’ এই ধরনের কথা বলতে শুনি। আমরা যে কেবল শুনি সেটা কিন্তু না, আমরা নিজেরাও হরহামেশাই এই ধরনের কথা বলে থাকি। এমন অনেক সময় আমরা পার করি যে সময়টায় আমাদের কিছুই ভালো লাগে না, আবার ভালো না লাগার কারণটাও আমরা জানি না। এমন না যে কেবল একা থাকার সময়েই আমাদের মাঝে একাকিত্ব ভর করে, বরং চারপাশে জনারণ্যের মাঝেও আমরা একাকিত্বে আক্রান্ত হই। এই ‘একা একা লাগছে’ এরকম চিন্তার গোড়ার জায়গাটা হচ্ছে নিঃসঙ্গতাবোধ (Loneliness)। নিঃসঙ্গতাবোধের সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) থেকে। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতাবোধ একজন মানুষকে মারাত্মক ডিপ্রেশনে নিয়ে যেতে পারে। এই ডিপ্রেশনকে আমরা কেবল বিষণ্ণতা বলে চালিয়ে দিতে পারি না। এটি সাধারণ বিষণ্ণতার চেয়েও অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
নিঃসঙ্গতাবোধের উদ্ভব: বিচ্ছিন্নতাবোধ
বিচ্ছিন্নতা পুঁজিবাদী সমাজের একটি সামাজিক-মনস্তাত্বিক সমস্যা। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বিচ্ছিন্নতার সংজ্ঞা –
“Alienation is a social-psychological condition of the individual which involves his estrangement from certain aspects of his social existence.”
(সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবোধকে সামাজিক-মনস্তাত্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যাপারটি কার্ল মার্কস প্রভাবিত) আধুনিক সমাজে এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন জ্যাঁ জ্যাক রুশো। পরবর্তীতে দার্শনিকরা এই আলোচনাকে আরো প্রসারিত এবং গঠনমূলক করে তোলেন যার প্রবাহ এখনো চলছে ।
বিভিন্ন দার্শনিকের দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবোধ
বিচ্ছিন্নতাবোধ নিয়ে দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গিকে মোটা দাগে চার ভাগে ভাগ করা যায় ।
১) ধর্মতাত্ত্বিক মানদণ্ডে বিচ্ছিন্নতা মূল্যায়ন: দার্শনিক হেগেল মনে করতেন, মানুষ সৃষ্টিকর্তারই একটি বিচ্ছিন্ন অংশ এবং এই বিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে মানুষের মনে যে বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে সেটিই নিঃসঙ্গতাবোধের মূল কারণ। অন্যদিকে ফয়েরবাখ মনে করতেন, মানুষের নিজের সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে ঈশ্বরচিন্তা বা ধর্মচিন্তা সেটিই বিচ্ছিন্নতার আসল কারণ। অর্থাৎ ফয়েরবাখের ভাষায় মানুষের নিজের সত্ত্বা থেকে বের হয়ে নিজের সাথে সম্পর্কহীন অলৌকিক সত্ত্বাকে নিয়ে ভাবার কারণেই মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম হয়। আর হেগেল মনে করতেন সৃষ্টিকর্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাধ্যমে মানব সভ্যতার একেবারে প্রথম থেকেই মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের বসবাস। এই দুটি মত সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ।
২) আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমির আলোকে বিচ্ছিন্নতার বিশ্লেষণ: মার্ক্সের বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানতে পারি যে, শ্রমের ফসল থেকে বিচ্ছিন্নতাই ক্রমে মানুষকে অপর মানুষ থেকে এবং তার আপন সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকের শ্রমের ফলে উৎপন্ন ফসল শ্রমিকের কাছে থাকে না, সে ফসল চলে যায় মালিকের দখলে। এভাবে শ্রমের ফসল থেকে বিচ্ছিন্নতা মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেয়। মানুষের কোনো উৎপাদন বা সৃষ্টিই তার কাছে থাকে না, অন্য কারো মুনাফা লাভে তা ব্যবহৃত হয়। এর বাইরেও সমাজের সাথে ব্যক্তির যে দ্বন্দ্ব এবং এ থেকে ব্যক্তিমনে যে বিচ্ছিন্নতাবোধের উদ্ভব হয় সেটিও যে বিচ্ছিন্নতার একটি কারণ মার্কস তার সূত্রে তা উল্লেখ করেছেন।
৩) অস্তিত্ববাদী-মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বিচ্ছিন্নতা ব্যাখ্যা: সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, এডমণ্ড হুসের্লে, মার্টিন হাইডেগার, জ্যাঁ পল সার্ত্রের মতো অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা বলতে চেয়েছেন এই সমাজ ব্যবস্থার নানা ক্ষেত্রে মানুষের নিজের অস্তিত্বের যে সংকট সেটিই বিচ্ছিন্নতাবোধের কারণ। যন্ত্রসভ্যতার যুগে সমাজ এবং আশেপাশের বৈরী পরিবেশের চাপে মানুষকে তার স্বভাববিরুদ্ধ ও ইচ্ছাবিরুদ্ধ কাজ করতে হয়, এর ফলে মানুষ পরিণত হয় যন্ত্রে, মানুষের মনে তৈরি হয় অস্তিত্বের সংকট। এরই ফলে মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম হয়।
৪) আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মিথস্ক্রিয়ায় বিচ্ছিন্নতার সূত্র নির্মাণ: মনোবিজ্ঞানী সিগমুণ্ড ফ্রয়েড মনে করতেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের চাপের মুখে মানুষের লিবিডোর যে অবদমন সেটিই বিচ্ছিন্নতাবোধের মূল কারণ– যদিও পরবর্তীতে ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদরা গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে এরিক ফ্রম মনে করতেন, পুঁজিবাদের সংকটই হচ্ছে মানবজাতির প্রধান সংকট, যার অনিবার্য ফলাফল মানবমনে বিচ্ছিন্নতাবোধ। মার্কসের সাথে সংকটের ব্যাপারে একমত হলেও সমাধানের ক্ষেত্রে একমত হতে পারেননি এরিক ফ্রম । তিনি মনে করেন, সমাজে নয়, মানুষের মনের গভীরেই রয়েছে বিচ্ছিন্নতার সমাধান। আর. ডি. ল্যাঙ এর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব এরিক ফ্রমের মতোই। তিনিও মনে করেন, বিচ্ছিন্নতা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হলেও এর বীজ রোপিত রয়েছে সমাজের অভ্যন্তরে।
নিঃসঙ্গতাবোধের লক্ষণ ও ধরন
রোগ হলে তার কিছু লক্ষণ থাকা চাই যা দেখে আমরা বুঝতে পারবো রোগী কোন রোগে আক্রান্ত। সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে বিচ্ছিন্নতার কিছু লক্ষণ রয়েছে। মেলভিন সিম্যান তার ‘অন দ্য মিনিং অব এলিয়েনেশন’ বইয়ে বিচ্ছিন্নতার পাঁচটি প্রধান লক্ষণ দেখিয়েছেন–
১) কর্তৃত্বহীনতা (Powerlessness);
২) অর্থহীনতা (Meaninglessness);
৩) আদর্শহীনতা (Normlessness);
৪) সম্পর্কহীনতা (Isolation);
৫) আত্ম-সংযোগহীনতা (Estrangement);
সিম্যানের মতে, বিচ্ছিন্নতার মূল অর্থই হলো ‘to become a stranger to oneself’.
নিঃসঙ্গতাবোধের ধরন
প্রকৃতি ও মহাজাগতিক বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা: মানুষ প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিল্প-বিপ্লবের পরের সময়ে, নগর–মহানগর প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানুষ প্রকৃতির সাথে তার যে বন্ধন সেটি হারাতে শুরু করে। প্রাণ-প্রকৃতি যেখানে মানুষকে প্রশান্তি দেয়, সেখানে যন্ত্রসভ্যতায় মানুষ এক অনিবার্য মানসিক অশান্তিতে ভুগতে থাকে। প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ।
পরিবার ও পারিবারিক-বন্ধন বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা : পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ কেবলই দৌড়াচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারেও কেউ কাউকে সময় দিতে পারেন না। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একইসাথে বাস করছেন, তবুও কারো জন্য কারো সময় নেই। পরিবারের মাঝে থেকেও মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ হিসেবে আবিষ্কার করে।
প্রেম বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা: প্রেম আর ভালোবাসার উৎস হারিয়ে মানুষের মর্মলোক হতে থাকে আরো বিচ্ছিন্ন, আরো নিঃসঙ্গ।
সমাজ বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা: দার্শনিকদের আলাপে মানুষের সমাজ-বিচ্ছিন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কিন্তু এই জটিল এবং কুটিল সময়ে মানুষ সমাজের মাঝে থেকেও সমাজের অংশ নয়। এই সমাজের যেন মানুষকে দেবার কিছু নেই, আবার ব্যক্তি মানুষেরও এই সমাজকে দেবার কিছু নেই। এই সমাজ-বিচ্ছিন্নতা মানুষকে করে তুলেছে অনেক বেশি নিঃসঙ্গ।
ঈশ্বর বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা: ধর্মের উৎপত্তির পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আসার আগপর্যন্ত ধর্মের সাথে মানুষের একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। কালক্রমে মানুষের ঈশ্বরচিন্তায় বিবর্তন আসতে শুরু করে। ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কিত অবিশ্বাসকে নিঃসঙ্গতাবোধের একটি কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকে।
মূল্যবোধ বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা: সমাজবদ্ধ জীবনের প্রয়োজনে সমাজ ব্যক্তিমানুষের সমাজের প্রতি এবং সমাজের ব্যক্তিমানুষের প্রতি করণীয় কিছু আচার-আচরণের বিধান তৈরী করে। এই যন্ত্রসভ্যতায় শিকড়হীন মানুষ সেসব মূল্যবোধ হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছে।
সত্ত্বা বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা: উপর্যুক্ত নিঃসঙ্গতার ধরনগুলোর সাথে মুখোমুখি হতে হতে মানুষ নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নেয় তার চারপাশের পরিবেশ থেকে। একসময় সে তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে আর খুঁজে পায় না। জ্যাঁ পল সাঁর্ত্রের মতে, একসময় মানুষের নিজের সত্তাই বিরোধিতা করে বসে। এই সত্তা বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক নিঃসঙ্গতা।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, একটা সময়ে এসে মানুষ পরিবারপ্রথায় প্রবেশ করে, ব্যক্তিমানুষের সাথে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন ছিল বহু যুগ ধরে, বহু সহস্র বছর ধরে। কারো কারো মতে, মানব ইতিহাসের জন্ম থেকেই মানুষ বিচ্ছিন্ন এবং একা। কারো কারো মতে, শিল্পবিপ্লবোত্তর কালে এসে মানুষের এই বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম। কিন্তু যে মতবাদই থাকুক, মানুষ জন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হোক বা না হোক, এটা সত্যি যে শিল্পবিপ্লবের পরের সময়ে এসে মানুষের বিচ্ছিন্নতা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। মানুষ আরো বেশি নিঃসঙ্গতাবোধে আক্রান্ত। জীবনানন্দ দাশ বলেন–
“রূপ প্রেম : সবি অন্ধকার;
সবি দীর্ঘ নিস্তব্ধতা; কঙ্কাল হবার – শূণ্যে মিলিয়ে যাবার।” (‘১৯৩৬)
জীবনের প্রতি এই গভীর উদাসীনতা কেবলই নিঃসঙ্গতাপ্রসূত। জনপ্রিয় মার্কিন ব্যাণ্ড লিনকিন পার্ক যখন বলে ‘Waiting for the end’ তখন এই সময়ের, এই যুগের, এই বাস্তবতায় মানবমনের করুণ আর্তিই ধ্বনিত হয়। অবচেতনে জীবনের প্রতি এই বিরাগ যেন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে।
এই নিঃসঙ্গতাবোধ থেকে মুক্তি পাবার সর্বজনস্বীকৃত পথ এখনো নেই। পথই বা কী করে থাকবে, সর্বজনস্বীকৃত মতই তো নেই।
তবু মানুষের লড়াইটা চলুক। আর এ লড়াইটা একা ব্যক্তিমানুষের না। এই লড়াইটা সবার।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/