২০১৭ সালের নভেম্বর। বৈরুতের এক চক্ষু হাসপাতালে একজন কর্মী কোনো কারণ ছাড়াই চোখে কম দেখতে শুরু করেন। একই বছরে আরও কয়েকবার তিনি একই সমস্যার মুখোমুখি হন। আর প্রতিবার কাজে অসম্ভব মানসিক চাপে থাকার পরই এমনটি ঘটে তার সাথে। সেন্ট্রাল সেরাস কোরিওরেটিনোপ্যাথি (সিএসসিআর) নামক একটি সমস্যায় ভুগছিলেন সেই সার্জন। তার রেটিনার চারপাশের ছোট্ট একটি অংশে কিছু তরল জমে গিয়েছিল। চিকিৎসা নেওয়া শুরু করেন তিনি। এই চিকিৎসার মধ্যে অন্তর্গত ছিল মানসিক চাপ কমিয়ে আনার পদ্ধতিও।
বৈরুতের এই চিকিৎসক কিন্তু সিএসসিআরের প্রথম রোগী ছিলেন না। এর আগে ১৮৬৬ সালে প্রথম সিএসসিআর-কে পরিচয় করানো হয় মানুষের সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে মানসিক চাপের ফলে এই সমস্যা দেখা যাচ্ছিলো। যেক্ষেত্রে মানসিক চাপ ছাড়া আর কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না।
অপারেশনের সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈরুতের উক্ত চিকিৎসকের মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তা জানার চেষ্টা করা হয় এরপর এবং সেই অনুযায়ী সমাধানও বের করা হয়। কিন্তু, বাকিদের কী অবস্থা? এমন কোনো একটি সমস্যা ভবিষ্যতে আসতে পারে, তা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন পিটার ড্রাকার। ১৯৫৯ সালে তিনি ৫০ বছর পর মানুষের কাজের ধরন এভাবে বদলে যাবে বলে মন্তব্য করেন এবং এ সম্পর্কে লেখেনও। সেখানে তিনি জানান, মানুষের কাজের চাপ এ সময় হাতের দক্ষতার চেয়ে মস্তিষ্কের উপরে বেশি পড়বে। তার কথাগুলোকে ভুল বলা যায় না।
বিশেষ করে চক্ষু সার্জনের উদাহরণ থেকে বলাই যায় যে, চোখের অপারেশন যেখানে হাতের উপরে অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিল, তা এখন মানসিক দক্ষতার উপরে বেশি নির্ভর করে। সময়ের সাথে সাথে শরীরের চাইতে মানুষ মস্তিষ্ককে বেশি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। ফলে, পেশার কারণে হওয়া শারীরিক নানা সমস্যার পেছনেও মস্তিষ্ক বড় রকমের প্রভাব রাখছে।
যুক্তরাজ্যের হেলথ অ্যান্ড সেফটি এক্সিকিউটিভের মতে, বর্তমান সময়ে (২০১৭ ও ২০১৮ সালে) কর্মীদের অসুস্থতার পেছনে ৫৭ শতাংশ সময় দায়ী করা হয়েছে মানসিক চাপ, উদ্বিগ্নতা এবং হতাশাকে। মানসিক চাপের কারণেই অসুস্থতা এবং সেখান থেকে কম কাজ করা ও উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো তৈরি হয়।
মানসিক চাপের কারণ ও প্রভাব
মানসিক চাপ কী, সেটা নিয়ে বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। আমরা সাধারণত সবাই মানসিক চাপের মুখোমুখি হই। কানাডিয়ান-হাঙ্গেরিয়ান একজন চিকিৎসক হানোস হুগো ব্রুনো ‘হ্যান্স’ সেইলি প্রথম ১৯৩০ সালে ‘মানসিক চাপ’কে সংজ্ঞায়িত করেন। ১৭ শতকের ইংরেজ চিকিৎসক রবার্ট হুকের কাছ থেকে এই ধারণা নেন তিনি। সেখানে মানসিক চাপকেই মানসিক চাপের কারণ এবং ফলাফল হিসেবে দেখানো হয়। এই যেমন, আপনি যদি ২০০ জন শিক্ষার্থীর সামনে কথা বলেন, সেক্ষেত্রে আপনার শারীরিক প্রদাহের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর সেখান থেকে তৈরি হবে আরও নানাবিধ সমস্যা।
ব্যাপারটি অনেকটা চক্রের মতো। তবে অনেকেই আবার ইঁদুরের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, মানসিক চাপ একবার কমে গেলে তারপর এর প্রভাবে ইতিবাচক ফলাফলও আসতে পারে। ইঁদুরের উপরে ফেলা চাপ তাকে নতুন এবং আরও উন্নত কোষ তৈরিতে সাহায্য করে। তবে একটি ব্যাপারে সবাই একমত যে, একটানা এবং কিছুদিন পরপর তৈরি হওয়া চাপ দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখে।
আমাদের শরীরের নার্ভাস সিস্টেম হিসেবে কাজ করে সিম্প্যাথেটিক এবং প্যারাসিম্প্যাথেটিক আর্ম। কোনো বিপদের সময় স্বল্প সময়ের জন্য সিম্প্যাথেটিক আর্ম কাজ শুরু করে এবং অন্যটি কাজ কমিয়ে দেয়। কিন্তু যদি আপনার সিম্প্যাথেটিক আর্ম সবসময় কাজ করতে থাকে সেক্ষেত্রে শরীরের উপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের মস্তিষ্ক নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতাকে ধারণ করতে সক্ষম। অতিরিক্ত চাপের প্রভাবে মস্তিষ্কের সম্মুখভাগের কর্টেক্স তাই পরিবর্তিত হলে, সেটাকেও আমাদের মস্তিষ্ক ধারণ করে নেয়। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।
আপনি যদি ভেবে থাকেন যে, মানসিক চাপ প্রদান করছে, এমন কাজ কমিয়ে আনলে সুস্থ থাকা যাবে, ব্যাপারটি কিন্তু এতটাও সহজ নয়। পরীক্ষায় দেখা যায় যে, মানসিক চাপে থাকলে বা কোন কাজের দ্বারা মানসিক চাপ তৈরি হলে একজন মানুষের মস্তিষ্কে যে অবস্থা তৈরি হয়, সেই ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে ভাবলেও মস্তিষ্কে একই প্রভাব পড়ে। যেক্ষেত্রে মানসিক চাপ সমাপ্ত হওয়ার পর রক্তচাপ যেখানে কমে যায়, মানসিক চাপের ব্যাপারে ভাবার কারণে সেটি হাইপারটেনশনে পরিণত হয়।
চাপ থেকে দূরে থাকবেন কীভাবে?
মানসিক চাপ থেকে খানিকটা মুক্তি দিতে যোগব্যায়াম, নিঃশ্বাস নেওয়ার কিছু পদ্ধতি বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের আবেগীয় অবস্থা, মানসিক চাপ কমিয়ে নেওয়া এবং মানসিক চাপের পর দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসাকে নিশ্চিত করে। তবে এটি মানুষভেদে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব রাখে। মানুষের মস্তিষ্ক একইভাবে চাপ নেয় না। আপনি হয়তো কোনো একটি নেতিবাচক ব্যাপারে বারবার ভাবছেন। অন্যদিকে, আপনার পাশেরজন তুলনামূলকভাবে মানসিক চাপ প্রদায়ক কোনো ব্যাপার নিয়ে কম ভাবছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ, অবস্থান, অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য- এর সবকিছুই বড় ভূমিকা রাখে।
আমাদের মস্তিষ্ক যে চাপ এবং চাপ পাওয়ার অভিজ্ঞতার কারণেই আরও বেশি মানসিক চাপে ভোগে, তা নয়। অনেক সময় নিজেদের মতো কোনো ঘটনাকে আগে থেকেই ভেবে নিয়েও মস্তিষ্ক মানসিক চাপে ভুগে থাকে। সামাজিক অবস্থান মানসিক ও শারীরিক চাপ প্রদানে বড় ভূমিকা রাখে। আপনি নিজের অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার চিন্তায় এবং পরবর্তী সময়ে কী হবে, সেটা নিয়ে সবসময় ভাবতে থাকলে এর প্রভাব আপনার উপরে নেতিবাচকভাবে পড়বেই। কর্মক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরও কার্যকর। মনে করুন, আপনি অনেক ভালো কাজ করলেন এবং এরপর ভালো কোনো ফলাফল পেলেন না। সেক্ষেত্রে আপনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করবেন এবং চাপ তৈরি হবে। কর্মক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা কম নয়।
সামাজিক মেলামেশা এবং অবস্থানই যে চাপের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, তা নয়। নাগরিকায়নের সাথে সাথেও এই সমস্যা বেড়ে যায়। আপনি যদি সন্ধ্যাবেলায়ও এলইডি স্ক্রিনে উজ্জ্বল লাল বা নীল আলো দেখেন, সেক্ষেত্রে আপনার শরীরে উদ্বিগ্নতা ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্যকারী হরমোন মেলাটোনিন উৎপাদন কমে যাবে। আমরা কী খাচ্ছি, কী করছি- এই সবকিছুই আমাদের মানসিক চাপ তৈরিতে প্রভাব রাখে। গবেষণায় দেখা যায় যে, আমাদের অন্ত্রের কিছু ব্যাকটেরিয়া উদ্বিগ্নতা কমাতে সাহায্য করে। আমাদের বর্তমান খাদ্যাভ্যাস সেই উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনছে।
প্রতিনিয়ত এই ব্যাপারটি ঘটছে। আপনার জ্বর হলে, পেটব্যথা হলে সেটার কারণ হয়তো খুঁজে বের করা সম্ভব। কোনো একটি পদ্ধতির মাধ্যমে এর পেছনের কারণ খুঁজে দূর করা সম্ভব। কিন্তু মানসিক চাপ এমন একটি সমস্যা, যেটি না দেখতে পাওয়া যায়, না এর পরিমাপ করা যায়। হয়তো আপনি প্রচণ্ড মানসিক চাপে আছেন। এর ফলাফল হিসেবে হয়তো অনেক শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। কিন্তু এই শারীরিক সমস্যার পেছনে যে মানসিক চাপ কারণ হিসেবে কাজ করছে, তা বের করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা বোঝাই সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, অনেক শারীরিক সমস্যার কারণই অজানা থেকে যাচ্ছে। তাই, মানসিক চাপ এবং এর নিরসন সম্পর্কে সচেতন হওয়াটা প্রতিনিয়ত আমাদের জন্য অত্যন্ত দরকারি হয়ে পড়ছে। আপনি হয়তো সুস্থ থাকার জন্য ওষুধ খান, নিয়ম মেনে চলেন। তেমনই অসুস্থতার প্রতিষেধক হিসেবে এখন থেকে মানসিক চাপ কমিয়ে আনার দিকেও মনযোগ দিন।
স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
মানসিক চাপ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) মানসিক চাপ ও রাগ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন: হাউ টু কন্ট্রোল এংগ্যার স্ট্রেস
২) মানসিক চাপ মুক্তির উপায়