১৯১৮ সালের কথা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কেবল সমাপ্ত হয়েছে। পটভূমি ইউরোপ মহাদেশ। প্রায় দুই কোটি মানুষ মারা গিয়েছে এই মহাযুদ্ধে, দিকে দিকে মৃত্যুর ছায়া তখনও জ্বলজ্বল করছে সর্বভূক রাক্ষসের মতো। ভঙ্গুর অর্থনীতি। সবাই মাথা তুলে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করছে। এমন সময় গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে আবির্ভূত হল অচেনা এক রোগ।
প্রচণ্ড মাথাব্যথার সাথে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে প্রথম দিকে। তারপর শুরু হয় কাশি! সেই সাথে নাক দিয়ে অনবরত জল গড়াতে থাকে। আস্তে আস্তে মাংসপেশিতে ছড়িয়ে পড়ে প্রচণ্ড ব্যথা! কম বয়সীরা ডায়রিয়া আর বমি করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যায়। প্রায় ছয় মাসে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লো সারা ইউরোপ জুড়ে। মারা গেলো ৫ কোটিরও বেশি মানুষ! ইতিহাসের পাতায় এই মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু নামে কুখ্যাত।
এই স্প্যানিশ ফ্লু আর কিছুই নয়। আমাদের বহুল পরিচিত একটি রোগ ইনফ্লুয়েঞ্জা। এটি একটি ভাইরাসঘটিত রোগ। শীতকালে বা ঋতু পরিবর্তনের সময় এই রোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। আমাদের শরীরে জীবাণু প্রবেশের ১-৪ দিনের মধ্যে সাধারণত লক্ষণ প্রকাশ পায়। খুব সাধারণ লক্ষণ নিয়েই এটি প্রকাশিত হয়- সর্দি, কাশি, জ্বর, গায়ে ও হাত-পায়ে ব্যথা।
ঋতু পরিবর্তনের সময় মনে করে অনেকেই অনেক সময় পাত্তা দেয় না একে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা আস্তে আস্তে নিউমোনিয়ার দিকে রোগীকে ঠেলে দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা এমন একটি ভাইরাস যা চতুরতার সাথে নিজেকে বারবার ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে! ফলে এর বিরুদ্ধে কার্যকর সুস্থির কোনো ভ্যাকসিনও তৈরি করা সম্ভব হয় নি!
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সাথে মানুষের দহরম মহরম কম দিনের নয়। বলা যায়, এটি মানব সমাজের সবচেয়ে পুরনো রোগসমূহের একটি। ইনফ্লুয়েঞ্জার কথা সর্বপ্রথম লিপিবদ্ধ করেন গ্রিক বিজ্ঞানী হিপোক্রেটাস। সে আজ থেকে ২,৪০০ বছর আগের ঘটনা। সেই থেকে আজপর্যন্ত ইনফ্লুয়েঞ্জা মানুষকে কম জ্বালায়নি।
সবচেয়ে ভয়ংকর প্রকোপ হয় ১৯১৮-১৯ সালের দিকে, যা শুরুতেই তুলে ধরা হয়েছে। এর পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ভয়ংকর এই ভাইরাস গণমৃত্যুর ছাপ রেখে গিয়েছে মানব সমাজে। ১৯৫৭-৫৮ সালে ঘটে এশিয়ান ফ্লু। এতে মারা যায় প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ। এর থেকেই বোঝা যায় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ধ্বংস ক্ষমতা। নতুন শতাব্দীতেও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। এ শতকের প্রথম দিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস নতুন আতংক নিয়ে হাজির হয়। এটি বার্ড ফ্লু নামে পরিচিতি পায়। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা নামক বিশেষ একটি প্রকরণের জন্য সৃষ্টি হয়েছিলো এই বার্ড ফ্লু। এই সময় অবশ্য মানুষের তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু পাখি জাতীয় প্রাণীরা মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। আমাদের দেশে বহু হাস-মুরগী খামারি পথে বসে এই সময়ে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস অর্থোমিক্সো ভাইরাস পরিবারের অন্তর্গত। সত্যি বলতে গেলে এই পরিবারের সে-ই একমাত্র সদস্য! এ পর্যন্ত এর তিনটি সাবটাইপ আবিষ্কৃত হয়েছে। এদের নাম দেওয়া হয়েছে টাইপ এ, টাইপ বি ও টাইপ সি।
তিন প্রকারের ইনফ্লুয়েঞ্জার ভেতরে সবচেয়ে ভয়ংকর হল ‘টাইপ এ’। স্প্যানিশ ফ্লু এবং এশিয়ান ফ্লু দুটির পেছনেই ‘টাইপ এ’ ইনফ্লুয়েঞ্জা দায়ী ছিল। টাইপ বি কিছুক্ষেত্রে মহামারী ঘটালেও টাইপ সি এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নির্বিরোধী ভাইরাস। এটা দিয়ে সহসা সংক্রমণের খবর শোনা যায় না।
একটি সংক্রামক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দেখতে মোটামুটি গোলাকার। এর একটি লিপিড নির্মিত বহিঃআবরণী আছে। মজার ব্যাপার হল, এই লিপিড আবরণীটি এরা পোষক কোষ থেকেই কব্জা করে নেয়। ভাইরাসের দেহে জেনেটিক উপাদান হিসেবে ডিএনএ অথবা আরএনএ এর যেকোনো একটি থাকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত। অর্থাৎ এটি একটি আরএনএ ভাইরাস! এতে মোট আট টুকরো আরএনএ জিনোম থাকে, যারা এর সমস্ত বংশগতির তথ্য সংরক্ষণ করে। এদের বহিঃআবরণীতে দুটি গ্লাইকোপ্রোটিন থাকে- একটির নাম হিমাগ্লুটিনিন এবং অপরটির নাম নিউরামিনিডেজ!
হিমাগ্লুটিনিনের কাজ ভাইরাসের আরএনএ-কে পোষক কোষের ভেতরে ঢোকার পথ করে দেওয়া। আর কোষে ঢুকে তার বারোটা বাজানোর পরে তাকে ধীরে সুস্থে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করাই নিউরামিনিডেজের কাজ। যার ফলে সে অন্যান্য ভালো কোষগুলোকে আক্রমণ করতে পারে। এছাড়া শ্বাসনালীর গায়ে যে মিউকাস আবরণী থাকে, তার দফারফা করাও এর কাজ। এতে ভাইরাসের শরীরে ঢুকতে সুবিধা হয় আর কী!
ভাইরাসের যে তিনটি প্রকরণ আছে, তা এদের ভেতরের রাইবোনিউক্লিওপ্রোটিনের উপর ভিত্তি করে করা হয়। ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা এ’ ভাইরাস মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ীকে সংক্রমণ করার পাশাপাশি পাখিকেও সংক্রমণ করতে পারে। এই জন্যই যত ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী হয়েছে, সবগুলো হয়েছে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা এ’ দিয়ে। কারণ সেক্ষেত্রে বিশাল এলাকা জুড়ে পাখির মাধ্যমে ইনফ্লুয়েঞ্জা সহজেই ছড়িয়ে পড়েছে। আর বোনাস হিসবে হিউম্যান-টু-হিউম্যান সংক্রমণ তো রয়েছেই।
এবার ইনফ্লুয়েঞ্জা বি ভাইরাসের কথায় আসা যাক। এটি শুধুমাত্র মানুষকে আক্রমণ করে। তাই এর প্রকোপ অল্প জায়গায় বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা সি তার অন্য দুই সহোদরের তুলনায় অনেকটাই শান্তশিষ্ট গোছের। সে মৃদু শ্বসনতন্ত্রীয় সমস্যা তৈরি ছাড়া মারাত্মক কিছু করে না।
হিমাগ্লুটিনিন এবং নিউরামিনিডেজের উপর ভিত্তি করে ‘ইনফ্লুয়েঞ্জা এ’ কে আরো কয়েকটি উপশ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। এ পর্যন্ত হিমাগ্লুটিনিনের ১৬টি আলাদা ধরণ পাওয়া গেছে। এদের H1, H2, H3, H4, H5… এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অন্যদিকে নিউরামিনিডেজের ৯টি ধরণ পাওয়া গেছে। এদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে N1, N2, N3, N4, N5… এভাবে। একটি ভাইরাসে হিমাগ্লুটিনিন বা নিউরামিনিডেজের কোনটার কী আছে তার উপর নির্ভর করে যে, এটি কোন প্রকরণের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন বার্ড ফ্লু যে ইনফ্লুয়েঞ্জা দিয়ে হয়েছিলো তাতে হিমাগ্লুটিনিনের পাঁচ নাম্বার ধরণ ছিল আর নিউরামিনিডেজের ছিল ১ নাম্বার ধরণ। তাই এর নাম Influenza H5N1. ঠিক এভাবেই স্প্যানিশ ফ্লুর কারণ ছিল Influenza H1N1 আর এশিয়ান ফ্লুর কারণ ছিল Influenza H2N2।
এখানে একটি প্রশ্ন উঠবে! আমরা জানি আমাদের দেহে কোনো প্যাথোজেন প্রবেশ করতে আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করে। ফলে পরবর্তীতে সেই এন্টিবডি আমাদেরকে উক্ত প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে রক্ষা করে। বিভিন্ন রোগের জন্য যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয় তা-ও এই নিয়মেই কাজ করে। তাহলে ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে কোনো ভ্যাকসিন নেই কেন?
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস খুব চতুরতার সাথে এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়। কিছু সময় পরপর এটি তার আবরণীর ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে সে আর আগের মতো থাকে না। এভাবে তার এন্টিজেনিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে এরা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে পারে। ছোটখাট পরিবর্তনকে বলে এন্টিজেনিক ড্রিফট (Antigenic Shift)। এটি ১-২ বছর পরপর ঘটে থাকে। আর বড়সড় পরিবর্তনকে বলে অ্যান্টিজেনিক ড্রিফট (Antigenic Drift)। এন্টিজেনিক ড্রিফটের জন্য একটু লম্বা সময় লাগে। প্রায় ১০-১২ বছর। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো ভ্যাকসিন তৈরি করা যায় না।
আক্রান্ত মানুষের দেহে ভাইরাস প্রবেশ করলে প্রথমত লক্ষণ বিচারের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। এছাড়া ভাইরাস প্রবেশের পরে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি নির্ণয় করা যায়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় এলাইসা (ELISA/ Enzyme Linked Immunosorbant Serologic Assay) পদ্ধতি। এছাড়া পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন বা পিসিআর (Polymerase Chain Reaction) এর মাধ্যমে সরাসরি ভাইরাস চিহ্নিত করা যায়।
অন্য অনেক রোগ, যেমন যক্ষ্মার মতো ইনফ্লুয়েঞ্জা হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে এটি ছড়ায়। এমনকি ব্যবহৃত বস্তু, যেমন রুমাল, গামছা, তোয়ালে, খেলনা, দরজার নব বা চাবির রিংয়ের মাধ্যমেও ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগীকে সাধারণ ওসেলটামিভির (Oseltamivir) বা যানামিভির (Zanamivir) গ্রুপের ওষুধ দেওয়া হয়।
এগুলো দেহকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করা হয়। হাঁচি কিংবা কাশি থাকলে এন্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ এবং জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়।
সাধারণত কয়েক সপ্তাহের ভেতর রোগী সুস্থ হয়ে যায়। লেখার এ পর্যায়ে এসে একটা প্রশ্ন মনে জাগতে পারে, এত সহজে আরোগ্যলাভ হলে মহামারীর সময় এত বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কারণ কী?
এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। প্রথমত, যে বিশেষ প্রকরণ মহামারীগুলোর জন্য দায়ী, সেগুলো খুব বেশি ভয়াবহ ছিলো। এছাড়া অন্যান্য উপসর্গ, যেমন ডায়রিয়া বা নিউমোনিয়া তো রয়েছেই! আজ থেকে একশ বছর চিকিৎসা পদ্ধতি ছিলো আরো অনুন্নত! যার ফলে মৃতের সংখ্যা এমন ভয়ংকর রকম বেশি ছিল।
তবে সময়ের সাথে চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নত হয়েছে! আর সেগুলো রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষকে করেছে আরো শক্তিশালী। ফলে বেড়েছে জীবনমান, কমেছে অনাকাংখিত মৃত্যুর ঝুঁকি।
ফিচার ইমেজ: Phys.org