বাহিরে প্রচণ্ড গরম। বাসায় ফিরেই ঢকঢক করে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে নিলেন। তারপর ভাবলেন গোসল করে নিলেই আরও ফ্রেশ লাগবে। শাওয়ার ছেড়ে দেয়ার পর হিম শীতল পানি গায়ে লাগতেই চমকে উঠলেন। যদিও আপনি নিজেও এমন পানিই আশা করছিলেন।
ভৌতিক কোনো মুভি হয়ত বন্ধুদের সাথে চ্যালেঞ্জ করে দেখতে বসে গিয়েছেন। যখনই হঠাৎ ভুতুড়ে মুখটা সামনে আসলো আপনি লাফিয়ে উঠলেন। হৃদপিণ্ডের গতি প্রচণ্ড বেড়ে গিয়ে হাত পা শিরশির করতে শুরু করলো।
উভয় ক্ষেত্রেই হাতে, পায়ে, বাহুতে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন পশমের গোড়ায় ফুলে উঠেছে। প্রশ্ন জাগতে পারে এমনটা হবার কারণ কী? এর সাথে শরীরের ভেতরেও ভিন্নরকম অনুভূতি কাজ করে। মনে হয় কী যেন ঠিক নেই। একেই বলে শরীরে শিহরণ খেলে যাওয়া বা গুজবাম্পস (GOOSEBUMPS)। খুব ঠাণ্ডায়, ভয়ে, উত্তেজনায় শিহরিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
কীভাবে এলো এই গুজবাম্পস
গুজবাম্পস আমাদের পূর্বপ্রজাতি থেকে পাওয়া একটি শারীরবৃত্তীয় ঘটনা। কিন্তু এতে তারা যতটা উপকৃত হত আমরা ততটা হই না। প্রাণীদের শরীরে লোমের স্তর অনেক মোটা হওয়ায় তারা গুজবাম্প হলে গরমের সময় ঠাণ্ডা থাকতে পারত এবং ঠাণ্ডায় তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারত। আমাদের শরীরে পশমের স্তর খুবই পাতলা হওয়ায় আমরা সেভাবে উপকৃত হই না।
যেভাবে এই নামকরণ হলো
সাধারণত হাঁস বা মুরগির পালক ছাড়িয়ে নিলে চামড়ায় ছোটো ছোটো কিছু ফুলে উঠা অংশ পরিলক্ষিত হয়। আমাদের শরীরে শিহরণ হলেও চামড়ায় ওই একই রকম অবস্থা হয়। তাই এই অবস্থাকে নাম দেয়া হয়েছে গুজবাম্পস বা গুজস্কিনস। ভালো বাংলায় বলতে গেলে হংসীত্বক! আমাদের শরীরের প্রতিটি লোমের সাথে চামড়ার নীচে সংযুক্ত থাকা পেশি সংকুচিত হবার জন্য গুজবাম্পস হয়ে থাকে। ত্বকের নীচে চামড়ার আশেপাশে পেশি সংকুচিত হয়ে নিম্নতার সৃষ্টি হলে কিছু অংশ ফুলে উঠে। এর জন্য শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় এবং আমরা শীতল অনুভব করি।
মানুষের ক্ষেত্রে গুজবাম্পস
প্রচণ্ড আবেগঘন মুহূর্ত, যেমন বিয়ে, জাতীয় সঙ্গীত শুনতে পাওয়া, খেলায় জেতা, ভৌতিক মুভি দেখা অথবা কষ্টের মুভি দেখা, অনেকদিন পর পছন্দের গান শুনতে পাওয়া, প্রিয়জনের সাথে দেখা হবার আগ মুহূর্ত ইত্যাদি ক্ষেত্রে হঠাৎ করে শিরদাঁড়া বেয়ে যেন শীতল কিছু নেমে যায় এবং ওই সময়েই গুজবাম্পস হয়ে থাকে যাকে ‘গায়ে কাটা দিয়ে ওঠা’ও বলা হয়।
অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে
কোনো বিড়ালকে যদি কোনো কুকুর তাড়া করে তাহলে দেখা যায় তাদের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। এতে করে বিড়ালটিকে আগের চেয়ে বড় দেখায় এবং কুকুর ভয়ে পিছিয়ে আসে। এই কারণে বিড়াল তার চেয়ে বড় আকারের কোনো প্রাণীকে আক্রমণাত্মক মনে করলে নিজে নিজেই শরীরে গুজবাম্পস তৈরি করে।
এছাড়াও মুরগি, হাঁস, প্যাঁচা প্রভৃতি পাখিকে ডিম দেবার পর অনেক বেশি ফুলে থাকতে দেখা যায়। ডিম ফুটে বাচ্চা হলেও তারা এভাবেই পাখা ফুলিয়ে আশেপাশে চলাফেরা করে যেন নিজেদের বিশাল শরীর দিয়ে তারা আদরের ছানাটিকে আগলে রাখতে পারে। মোরগ লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও মোরগের মধ্যে এই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
গুজবাম্পস হওয়ার কারণ
অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণের কারণে গুজবাম্পস হয়ে থাকে। অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি যা মানুষের কিডনির ঠিক উপরে ছোটো শিমের দানার মত অংশে প্রস্তুত হয়। মানুষের জন্য অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থি বিভিন্ন তীব্র অনুভূতিতে নিঃসরিত হয়ে থাকে তবে প্রাণীদের ক্ষেত্রে শুধু প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, মানসিক চাপ বা মারামারির করার সময় নিঃসরিত হয়। অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসরিত হলে আমরা ঠাণ্ডা বা ভয় বা উভয়েই একসাথে অনুভব করতে পারি। অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণে আমাদের চোখে পানি আসা, হাতের তালু ঘেমে উঠা, হাত পা শিরশির করা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া অথবা পেটের ভেতর সুড়সুড় অনুভূত হতে পারে।
গুজবাম্পস কি ভয় পাবার মত কিছু?
আসলে গুজবাম্পস একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এটা যদি দীর্ঘক্ষণ ধরে হয়ে থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া ভালো।
- কেরাটোসিস পিলারিস= এটা চামড়ার এক ধরনের রোগ যা দেখতে গুজবাম্পসে লোম দাঁড়ানোর মতই দেখতে। কিন্তু এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়।
- অটোনোমিক ডিজ্রেফ্লেক্সিয়া= স্পাইনাল কর্ডে কোনোরকম আঘাত লেগে থাকলে বা কোনো সমস্যা হলে শিরদাঁড়ায় শিরশির অনুভূত হয় এবং লোম দাঁড়িয়ে যায় সাথে স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজের বিকৃতি ঘটে।
- ইনফ্লুয়েঞ্জা= যে কোনোরকম ফ্লু-তে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে জ্বর দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। এসব ক্ষেত্রে গুজবাম্প হতে পারে।
যেভাবে গুজবাম্পসের প্রভাব কমিয়ে আনবেন
- জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন। খুঁজে বের করুন আপনার মানসিক চাপের জায়গাগুলো। সঙ্গীর বা পরিবারের কারো সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।
- প্রতি রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন। কম ঘুম থেকে আপনার মানসিক চাপের প্রভাব অনেক বেশি বেড়ে যায়। যে কাজটি হয়ত আপনি খুব সহজেই করতে পারেন সেটিও কঠিন হয়ে যায়। এমন সময় বিছানায় যাবার অভ্যাস করুন যেন আপনার অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম হয়।
- সাদা আটা, চিনি এবং তেলজাতীয় খাবার পরিহার করুন। এসব খাবার শরীরের মেটাবলিজম ক্ষমতা কমিয়ে নিয়ে আসে এবং অ্যাড্রেনালিন গ্রন্থিকে সহজ রাস্তা করে দেয়।
- শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন। ফুঁ দিয়ে সমস্ত বাতাস বের করে দিন। এরপর বড় করে নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে ৪ থেকে ৫ সেকেন্ড নিঃশ্বাস ধরে রাখুন। এরপর আবার এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনে নিঃশ্বাস ছেড়ে দিন। এভাবে তিন চার বার করতে পারেন। এটি মানসিক চাপ কমাতে অনেকটা সাহায্য করে কারণ ধীরে শ্বাস প্রশ্বাস নিলে হৃদপিণ্ডের কাজ শিথিল হয়ে যায় ফলে সমস্ত পেশিগুলোও ধীরে ধীরে কাজ করে। এতে শরীরে স্থিরতা আসে। আর শরীরে স্থিরতা আসলেই আপনার মনে প্রশান্তি থাকবে।
এর কোনোটাই যদি আপনার জন্য কাজ না করে তাহলে অতি দ্রুত একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন। এটা হয়ত কোনো মনোরোগ নয় কিন্তু মানসিক চাপ কমিয়ে আনতে পারলে গুজবাম্পের প্রভাব অনেকটা কমে আসবে। গুজবাম্পস বিষয়টা শারীরিক হলেও এর পুরোটাই নির্ভর করে আপনার মানসিক অবস্থার উপর।
বিভিন্ন গল্পে কবিতায় ‘শিহরন’কে খুব রোমাঞ্চকরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই এই অনুভূতিতে অভ্যস্ত নন এবং তাদের নানান সমস্যায় ভুগতে হয়। আবেগ, অনুভুতি, সংবেদনশীলতা কোনোটারই ঊর্ধ্বে আমরা নই। তাই গুজবাম্পকে এড়িয়ে চলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আশা করি আজকের এই আয়োজন থেকে আপনাদের এই অনুভূতির প্রতি যে কোনোরকম আশংকা কেটে যাবে এবং সাময়িক এই অনুভূতি আপনিও উপভোগ করবেন রোমাঞ্চকর ভাবেই!
ফিচার ইমেজ সোর্স = Cleveland clinic health essential