আমি- মা জানো আজ না পৃথিবীর মানুষ চাঁদে গিয়েছে।
মা- ওমা তাই! তাহলে চাঁদে যে বুড়িটা চরকা কাটে তার সাথে নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে।
আমি- মা চাঁদে কোনো বুড়ি থাকে না।
মা- ছোটবেলা থেকে সবার কাছে শুনে আসছি চাঁদে এক বুড়ি বসে বসে চরকায় সুতা কাটছে, আর তুই বলছিস থাকে না!
আমি- মা তুমি কার কাছে শুনেছো? আমাদের মহাকাশচারীরা গবেষণা করে দেখেছে চাঁদে কোনো মানুষ বাঁচতে পারবে না। সেখানে খাবার, পানি, অক্সিজেন কিছুই নেই। এমনকি এখন তারা চাঁদে গিয়েও দেখেছে সেখানে কোনো বুড়ি নেই।
মা- কে বলেছে থাকে না! এতদিন ধরে চাঁদের বুকে বুড়ির ছায়া দেখে আসছি, আমার বিশ্বাস চাঁদে ঐ চরকা কাটা বুড়িটা আছে। আসলে মহাকাশচারীরা খুঁজেই পায়নি বুড়িকে।
মায়ের ছোটবেলার বিশ্বাসের কাছে আমার যুক্তি নির্বিকার।
কথোপকথনটি প্রতীকী। তবে অবস্থাটা বাস্তব। কারণ একজন দৃঢ় বিশ্বাসী মানুষকে যুক্তি দিয়ে পরিবর্তন করা কঠিন। এমনকি সেই বিশ্বাস যেকোনো অযৌক্তিক বিষয়েই হোক না কেন। আসলে মানুষের মন কোনো যুক্তি অনুসরণ করে না বা এর দ্বারা প্রভাবিতও হয় না। মানুষ যথেচ্ছভাবে বিশ্বাসপ্রবণ নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনগড়া বিশ্বাসের জালে আটকে থাকে।
যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তববাদী ব্যাখ্যা বিদ্যমান থাকাকালেও মানুষ তাদের মন পরিবর্তন করতে অস্বীকার করে কেন?
‘৭০ এর দশকে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটি গবেষণামূলক পরীক্ষার আয়োজন করে। গবেষণার বিষয় ছিল ‘মানুষের মন তাদের চিরাচরিত বিশ্বাস নিয়ে যুক্তি দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়’।
পরীক্ষার প্রথম ধাপে ছাত্রদের ২৫ জোড়া আত্মহত্যার স্বীকারোক্তিমূলক চিরকুট দেয়া হয়, প্রতি জোড়ায় ছিল একটি বাস্তবিক আত্মহত্যার চিরকুট এবং ছাত্রদের সেটি সনাক্ত করতে বলা হয়। একদল ছাত্র বেশীরভাগ সঠিক উত্তর দেয় এবং আরেকদল বেশীরভাগ ভুল উত্তর দেয়। গবেষকরা ছাত্রদের পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে দেন।
পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে ছাত্রদের বলা হয় প্রথম ধাপের পরীক্ষার ফলাফল ছিল ভুল। তাদের নিজেদেরকেই নিজের পরীক্ষার ফল অনুমান করতে বলা হয়। পরিণামে পাওয়া গেলো, সঠিক উত্তরদাতা ছাত্রদল তাদের প্রাপ্ত নম্বর আরও ভালো হয়েছে আন্দাজ করে এবং ভুল উত্তরদাতা ছাত্রদল তাদের তাদের প্রাপ্ত নম্বর আরও খারাপ হয়েছে বলে আন্দাজ করে। যদিও তারা জানতো যে ফলাফল ভুল, তবুও ভালো নম্বর প্রাপ্তরা খারাপ এবং খারাপ নম্বর প্রাপ্তরা ভালো ফল আশা করলো না।
কয়েক বছর পরে আরেকটি গবেষণামূলক পরীক্ষা করা হয় নতুন দুই দল ছাত্রদের নিয়ে। প্রথম ধাপে ছাত্রদের দুজন দমকল কর্মী ফ্রাঙ্ক এবং জর্জের পারিবারিক এবং পেশাদারিক তথ্যাবলী দেয়া হয়। তবে ছাত্রদের দুই দলে ভিন্ন ধরনের তথ্য জানানো হয়। ফ্রাঙ্ক নামক দমকল কর্মীর প্রথম ফাইল অনুযায়ী সে খুব সফল এবং অগ্নিক্ষেত্রে সবসময় নিরাপদ উপায় ব্যবহার করতে পারে। ফ্রাঙ্কের দ্বিতীয় ফাইল অনুযায়ী সে অগ্নিক্ষেত্রে সবসময় নিরাপদ উপায় ব্যবহার করতে পারে, তবে দমকল কর্মী হিসেবে সে খুব সফল নয়। এমনকি ফ্রাঙ্ক নিজে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে প্রস্তুত সেই প্রতিবেদনও ফাইলে যুক্ত ছিল।
প্রথম গবেষণার মতো এবারও পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে ছাত্রদের জানানো হলো যে প্রথম ধাপের তথ্যাবলী ভুল ছিল এবং ‘ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় একজন সফল দমকল কর্মী হিসেবে ফ্রাঙ্কের বৈশিষ্ট্য কেমন হওয়া উচিৎ?’ সে সম্পর্কে ছাত্রদের নিজস্ব ধারণা নিরূপণ করতে বলা হলো। যে সকল ছাত্ররা প্রথম ফাইল পেয়েছিল তারা ধারণা করলো একজন সফল দমকল কর্মী হিসেবে ফ্রাঙ্ক সকল ঝুঁকি পরিহার করতে পারবে। আর দ্বিতীয় ফাইল প্রাপ্ত ছাত্ররা ধারণা করলো একজন বিফল দমকল কর্মী হিসেবে ফ্রাঙ্ক সকল ঝুঁকি এড়াতে পারবে না। এক্ষেত্রেও পূর্ববর্তী তথ্য ছাত্রদের নিরপেক্ষ ধারণা নিতে নিবৃত্ত করলো।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মানুষের মনগড়া বিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত করা সহজ নয়, বরং মনগড়া বিশ্বাসের উপযুক্ত সংশোধন করতে সে ব্যর্থ। এমনকি অনেক বুদ্ধিমান মানুষও যথেষ্ট প্রমাণাদির সামনেও নিজের বিশ্বাসে অটল থাকেন।
আপনি হয়তো নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘কোনো ঘটনার সপক্ষে বা বিপক্ষে কীভাবে আপনি আপনার মন পরিবর্তন করবেন?’
উত্তর হলো- প্রথমে ঐ ঘটনার উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করবেন, তার প্রমাণাদি সংগ্রহ করবেন, নিরপেক্ষতা যাচাই করবেন, অখণ্ডনীয় উপাত্তের ভিত্তিতে পরিসংখ্যান করবেন এবং আপনি স্বপক্ষে বা বিপক্ষে একটি সঠিক ও নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কিন্তু ঐ ঘটনা সম্পর্কিত পূর্বানুমান এবং আপনার মনের সন্দেহ আপনার নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তের পথে অন্তরায় হবে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ভিন্ন গবেষণার ফলাফল আসলে এটিই হয়েছিলো।
প্রমাণ সহ প্রকৃত ঘটনা খণ্ডন করা আসলে কঠিন, তবে মানুষের মনকে সেই প্রমাণ বিশ্বাস করানো আরো কঠিন। মানুষের মন আসলে এমন কোনো প্রমাণ মানতে চায় না যেটা সে বিশ্বাস করে না বা বিশ্বাস করতে চায় না। আমদের মন আসলে পূর্বে বিদ্যমান বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নতুন প্রমাণাদি সমর্থন করে। তাই প্রতিপক্ষ হতে কোনো বিতর্কের মুখোমুখি হলে আমাদের মন প্রথমেই নিজ পক্ষ সমর্থন করে এমন যুক্তিগুলোকে দৃঢ় করে ফেলে। ফলস্বরূপ, আমাদের মতামত প্রগাঢ় হয়ে ওঠে এবং মুক্ত চিন্তাধারার কার্যপ্রণালীকে ব্যাহত করে।
আমরা এটাই জানি যে, আমাদের জ্ঞান এবং জ্ঞানের উৎসই আমাদেরকে মানুষ রূপে গড়ে তুলেছে এবং এই কারণটি এত উপযোগী যে এটি অন্য কোনো প্রজাতির মধ্যে বিকশিত হয়নি। তবে এত জ্ঞানসম্পন্নতা নিয়ে কী করে এত যুক্তিযুক্ত অর্থহীনতা উৎপন্ন করি আমরা?
‘THE ENIGMA OF REASON‘ বইটিতে ড্যান স্পেরবার এবং হুগো মারসিয়ার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
আসলে এই অর্থহীনতা উৎপন্ন হয় আমাদের অস্তিত্ব জোরদার করার প্রবণতা থেকে। মনোবিজ্ঞানীরা একে ‘পক্ষপাত সমর্থন’ বা ‘Confirmation Bias’ বলে থাকেন। উপলব্ধির সাথে যুক্তির খুব সামান্যই সংযোগ রয়েছে। যেমন নিজেকে যদি আপনি একটি ইঁদুরের সাথে তুলনা করেন এবং আপনাকে বলা হয় যে আপনার আশেপাশে একটি বিড়াল আছে অতঃপর আপনি তার রাতের খাবার হতে যাচ্ছেন। আপনার উপলব্ধি হবে আপনার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে আশেপাশের সকল যুক্তি-প্রমাণ নাকচ করে দেয়া। আপনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন এই বিশ্বাসটিই আপনাকে ঐ সকল যুক্তিকে মেনে নিতে বাধা দিবে। এই বিশ্বাসকে মনের আকাঙ্ক্ষাও বলা হয়।
আপনার বিশ্বাস আপনার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করে আর বিশ্বাসকে পরিবর্তন করা মানে আপনার নিজের ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন করা। তাই আমাদের বাক্তিত্ব অক্ষত থাকে এমন ধারণাগুলোকেই আমরা আমাদের মনে অন্তর্ভুক্ত করে থাকি। আসল বিষয়টা হলো আমাদের নিজেদের মন থেকে আসা বিষয়গুলো ছাড়া অন্য সকল বিষয় স্বীকার করাতে আমরা সর্বদা সন্দিহান।
আমরা কখনই কোনো বিতর্কে হেরে যেতে চাই না। আত্মপক্ষ সমর্থন করা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি। আপনি কাউকে কোনো ব্যাপারে শোধরানোর জন্যে বলেছেন এবং সে কোনো প্রকার পাল্টা যুক্তি ছাড়াই আপনার কথা মেনে নিলো। খুব আশ্চর্য হচ্ছেন! প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, কারণ আপনার কথা মেনে নেবার আগে সে অবশ্যই তার অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করবে।
ফিচার ইমেজ: sabusinessindex