যেকোনো সন্তানপ্রত্যাশী নারীর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ক্রান্তিলগ্ন হচ্ছে তার গর্ভধারণের সময়। পরিবারে নতুন অতিথির আগমন, নিজের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকা নতুন প্রাণের অস্তিত্ব, মা হিসেবে নতুন একটি পরিচয় তৈরি হওয়া- সব মিলিয়ে নারীটির মন একদিকে যেমন আনন্দ-উৎকণ্ঠায় উদ্বেলিত হয়ে থাকে; অপরদিকে সন্তান জন্মদান, তার সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতকরণ এবং মাতৃত্বের গুরুদায়িত্বের কথা ভেবে অস্থিরতা, উদ্বেগ কিংবা শঙ্কাও কম বোধ হয় না।
হবু মায়েদের শারীরিক পরিবর্তনগুলো সহজে চোখে ধরা দিলেও তাদের মানসিক অবস্থার এই পরিবর্তনগুলো অনেকাংশেই আড়ালে, অবহেলায় থেকে যায়। অথচ এসব নেতিবাচক আবেগগুলো সঠিক সময়ে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে গর্ভাবস্থায় ও পরবর্তী সময়ে মা ও শিশুর ওপরে এর গভীর প্রভাব পড়ার আশংকা থাকে। তাই আজকের এই আয়োজনে গর্ভকালীন সাধারণ কিছু মানসিক সমস্যা এবং তা কাটিয়ে ওঠার উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো।
মন-মেজাজের আকস্মিক পরিবর্তন
গর্ভধারণের সময়ের একদম শুরু ও শেষের দিকে নারীদের মন-মেজাজ অহেতুক এবং আকস্মিক পরিবর্তন হতে দেখা যায়। এ সময়ের বাড়তি শারীরিক ও মানসিক চাপ, হরমোনের তারতম্য, বিপাক ক্রিয়ার পরিবর্তন, ভয় ও দুশ্চিন্তার মতো নেতিবাচক আবেগ প্রভৃতি কারণে মেজাজ খিটখিটে হতে পারে।
এ সময় মন ফুরফুরে রাখতে যা করতে পারেন-
- দিনের বেলা বিশ্রাম এবং রাতে ঘুম, দুটোই পর্যাপ্ত পরিমাণে হতে হবে।
- মায়ের নিজের এবং গর্ভস্থ শিশুর পুষ্টি চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে যথেষ্ট পরিমাণ সুষম খাদ্যগ্রহণ করতে হবে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু শরীরচর্চা এবং যোগব্যায়াম করা যেতে পারে।
- অবসরে নিজের শখের কাজ করলে মন প্রফুল্ল থাকবে।
- পারস্পরিক সম্পর্ককে আরো দৃঢ় করে তোলার জন্যে সঙ্গীর সাথে নিয়মিত সময় কাটানো জরুরি।
- মানসিক অবস্থার এই ওঠানামা থেকে যদি অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা, রাগ বা বিষণ্নতা তৈরি হতে থাকে, সেক্ষেত্রে অবশ্যই মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নেওয়া উচিত। কেননা গর্ভাবস্থায় তৈরি হওয়া মানসিক জটিলতা শিশুর জন্মের পরেও মায়ের মনে বিদ্যমান থেকে যেতে পারে, এবং পরবর্তীতে তা থেকে প্রসবোত্তর বিষণ্নতা সহ জটিল সব মানসিক সমস্যার উদ্ভব হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
ভয় এবং উদ্বেগ
গর্ভাবস্থায় মনে বিভিন্ন কারণে ভয় এবং উদ্বেগ দেখা দিতে পারে।
শিশুর সুস্থতাজনিত দুশ্চিন্তা
আগে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত বা মৃত সন্তান প্রসবের ইতিহাস থাকলে মনে এ ধরনের ভয়টা বেশি কাজ করে। এরকম কোনো ঘটনার সাক্ষী হলেও এ ধরনের ভয় আসতে পারে। তাছাড়া সন্তানের কোনো জন্মগত ত্রুটি থাকবে কিনা, এ নিয়েও মনে দুশ্চিন্তা থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে নিজের আশঙ্কা এবং উদ্বেগের ব্যাপারে চিকিৎসকের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে আলোচনা করতে হবে। আজকাল বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ শিশু স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হচ্ছে কিনা বা শিশুর জন্মগত কোনো ত্রুটি আছে কিনা, তা আগেভাগেই জানা যায়। প্রয়োজনে সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে।
প্রসব-বেদনা বিষয়ক আতঙ্ক
পরিচিত নারীদের কাছ থেকে সন্তান প্রসবকালীন তীব্র বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা শুনে অনেকের মনেই এই সংক্রান্ত ভয় ও উদ্বেগ তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি হবু মাকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে পারেন এবং ব্যথা উপশমের বিভিন্ন পদ্ধতি সম্বন্ধে পরামর্শ দিতে পারেন।
একজন আদর্শ মা হয়ে উঠতে পারা নিয়ে সংশয়
গর্ভবতী নারীর নিজের মায়ের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক না থাকলে সাধারণত মনে এ ধরনের সংশয় দেখা দেয়। সন্তান লালনপালন বা প্যারেন্টিং বিষয়ক বইপত্র ও ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণ করে নিজেই এ ধরনের উদ্বেগ কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে।
শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে দুশ্চিন্তা
গর্ভাবস্থার চতুর্থ মাস থেকে শেষ পর্যন্ত গর্ভবতী মায়ের পেটের স্ফীতি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং শরীরের ওজন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সাধারণত এসব লক্ষণ সন্তান ধারণ প্রক্রিয়ারই স্বাভাবিক একটি অংশ হলেও, কোনো কোনো গর্ভবতী নারী তার বাড়ন্ত ওজন এবং সন্তান প্রসবের পর শরীরের আকৃতি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এ দুশ্চিন্তা একেবারে অমূলক নয়, কারণ অতিরিক্ত ওজন শরীরে নানাবিধ রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তবে এক্ষেত্রে একটি ব্যাপার মাথায় রাখা দরকার যে, দীর্ঘ নয় মাস সময় ধরে শরীরের যে ওজনবৃদ্ধি ঘটেছে, সন্তান জন্মের পর রাতারাতি সেই বাড়তি ওজন কমে যাবে, এমন আশা করা অবান্তর। ওজন হ্রাস পাওয়ার হার মায়ের বয়স, খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চা, অতিরিক্ত ওজনের পরিমাণ, বিপাক ক্রিয়ার হার, স্তন্যদান করার অভ্যাস সহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সন্তান প্রসবের পর দ্রুত ওজন কমানোর জন্যে হঠাৎ করে খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিলে বা ভারি ব্যায়াম করা শুরু করলে বরং হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
তাই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রথমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক ওজন ফিরিয়ে আনার একটি বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। এরপর মা ও শিশুর প্রতিদিনকার চাহিদা অনুযায়ী একটি সুষম খাদ্যতালিকা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি মায়ের শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ধৈর্য ধরে সঠিক নিয়মে শরীরচর্চা চালিয়ে গেলে একেবারে সন্তান ধারণের আগের সময়কার ওজন ফিরে না পাওয়া গেলেও ওজন অনেকটাই স্বাভাবিক সীমার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব।
অতিরিক্ত গোছগাছ প্রবণতা
অনেক সময় গর্ভবতী নারীদের মধ্যে আসন্ন সন্তানের জন্যে মাত্রাতিরিক্তভাবে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা এবং বারবার সবকিছু গোছগাছ করার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কারো কারো ক্ষেত্রে এ প্রবণতা স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এটি অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এ ধরনের প্রবণতা দেখা দিলে সহসাই গর্ভবতী মা ঘরের প্রতিটি অংশ নিখুঁতভাবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলার জন্যে অস্থির হয়ে ওঠেন। এমনকি রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে ঘর গোছাতে শুরু করাও অস্বাভাবিক নয়।
এভাবে অতিমাত্রায় যত্নশীল হয়ে ওঠা অবশ্য খারাপ কিছু নয়, তবে গর্ভাবস্থায় ঘর গোছাতে গিয়ে ভারী আসবাবপত্র স্থানান্তর করা বা মই বেয়ে উঠে ওপরের দিকের তাক পরিস্কার করা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই এই অভ্যাস যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায় বা মা ও শিশুর জন্যে কোনো ক্ষতির কারণ না হয়, সেদিকে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া খেয়াল রাখা দরকার, আসন্ন সন্তানের প্রতি বেশি যত্নবান হতে গিয়ে মা নিজের শরীর ও মনের পরিচর্যার প্রতি যেন বেখেয়াল হয়ে না পড়েন।
ভুলে যাওয়ার প্রবণতা
এটি গর্ভকালীন অবস্থার আরেকটি মানসিক সমস্যা। এ সময় খুব সাধারণ ব্যাপারও ভুলে যাওয়ার প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক। এর পেছনে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক কারণ দায়ী থাকতে পারে। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে যে, এ সমস্যাটি সাময়িক। সন্তান জন্মের পরে স্মৃতিশক্তি পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
ভুলে যাওয়া এড়াতে যা যা করা যেতে পারে-
- জরুরি বিষয়গুলো একটি নোটবইতে টুকে রাখুন। বাজার থেকে কী কী আনতে হবে, কাকে জরুরি ফোন কল করতে হবে, কখন কী ওষুধ খেতে হবে- এ জাতীয় দরকারি বিষয়গুলো কাগজে লিখে রাখলে তা ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
- স্টেশনারি দোকানগুলোতে কাগজের একপাশে আঠা লাগানো স্টিকি নোটস কিনতে পাওয়া যায়। এসব কাগজে ছোট নোট আকারে দরকারি কাজগুলো লিখে সহজে চোখে পড়ে, এমন কোনো জায়গায় সেঁটে রাখা যায়।
- ইদানিং মোবাইলসহ বিভিন্ন গ্যাজেটে রিমাইন্ডার সেট করার সুবিধা থাকে। জরুরি কাজ ভুলে যাওয়া ঠেকাতে এ সুবিধা কাজে লাগানো যেতে পারে।
- সবকিছু দেখভালের দায়িত্বভার নিজের ঘাড়ে না নিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া যেতে পারে। এতে কোনোকিছু ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
- ভুলে যাওয়ার প্রবণতার বিষয়ে খুব বেশি চিন্তিত না হয়ে বরং তা স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে নেওয়ার মত মানসিকতা রাখতে হবে।
- কোলিন এবং ওমেগা ৩ সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। এটি গর্ভবতী মা ও তার গর্ভের সন্তান- উভয়ের মস্তিষ্কের জন্যই ভালো।
গর্ভাবস্থার মতো নাজুক একটি সময়ে গর্ভবতীর প্রতি পরিবারের সবার যত্নশীলতা এবং পূর্ণ সমর্থন থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়কার মানসিক সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা না হলে তা একই সঙ্গে মা ও শিশু উভয়ের জীবনেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই মা ও শিশুর সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে নবজাতকের পাশাপাশি তার মায়ের স্বাস্থ্যের দিকেও পরিবারের সবার সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
ফিচার ইমেজ: Netmums