
অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মানির বিখ্যাত দার্শনিক অ্যাডাম ভাইশপট হয়তো অবাক হয়ে যেতেন, যদি তিনি জানতেন দু’শ বছর পর তার চিন্তা-ভাবনাগুলোকে ঘিরে তৈরি হবে বিশাল বিশাল সব কন্সপিরেসি থিওরি, আর এই থিওরিকে কেন্দ্র করে লেখা থ্রিলারগুলো হবে বেস্টসেলার, মুভিগুলো হবে বক্স অফিস ব্লকবাস্টার। ঠিক তেমনিভাবে তার সহকর্মীরাও অবাক হয়ে গিয়েছিলো, যখন তারা জানতে পারলো এই শান্ত নিরীহ চেহারার ভদ্রলোক হচ্ছে দেশের অন্যতম প্রধান শত্রু, যার গোপন সংগঠন, ‘দ্য ইলুমিনাটি’ সমাজের রীতিনীতিগুলোকে উপড়ে ফেলতে চাচ্ছে।
১৭৪৮ সালে জার্মানির বাভারিয়া প্রদেশের ইনগোলস্টাডট শহরে জন্মগ্রহণ করা অ্যাডাম ভাইশপটের পূর্বপুরুষরা মূলত ছিল ইহুদি, পরবর্তীতে তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। খুব কম বয়সেই ভাইশপটের মা-বাবা মারা যায়। ফলে তার ভরণপোষণ চালাতে থাকেন এক চাচা, ভাইশপটকে ভর্তি করিয়ে দেন খ্রিস্টান যাজকদের জন্য বিশেষ এক স্কুলে। পড়াশোনার পাট চুকানোর পর ইনগোলস্টাডট বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মশাস্ত্র আর প্রাকৃতিক আইনের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ভাইশপট। ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত তার ক্যারিয়ার এগিয়ে চলেছে তরতর করে, যতক্ষণ না বাভারিয়ান কর্তৃপক্ষ তার গুপ্ত সংগঠন সম্পর্কে জানতে পারলো।
ভাইশপটের উত্থানের পেছন দিকটা আরেকটু বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাক। ভাইশপট ছোটবেলা থেকেই সবকিছু নিয়েই চিন্তা-ভাবনা করতেন, আশেপাশের জিনিস পর্যবেক্ষণ করতেন ভালোমতো। ছোটবেলা থেকে বই পড়তেন ক্ষুধার্তের মতো, চাচার লাইব্রেরিতে থাকা নব্যধারার ফরাসি দর্শনশাস্ত্রের বইগুলো গেঁথে নিয়েছিলেন মাথার মধ্যে। বাভারিয়া ঐ সময়ে কিছুটা রক্ষণশীল আর প্রচণ্ড মাত্রায় গোঁড়া ক্যাথলিক ছিল। ভাইশপটই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন না যারা মনে করতো যে এখানে চিন্তা-ভাবনার স্বাধীনতা নেই, রাজা আর চার্চের কথাই ছিল শেষ আইন।
ভাইশপট তখন ভাবতে লাগলেন, শুধুমাত্র ধর্ম দিয়ে এই আধুনিক সমাজ চালানো সম্ভব নয়। তাই তার মাথায় এক নতুন ধরনের তত্ত্ব জন্ম নিলো। এই তত্ত্ব আর রীতিনীতিগুলোকে তিনি নাম দিলেন ‘ইলুমিনেশন’, যা প্রয়োগ করলে ইউরোপের শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হবে।
এদিকে ফ্রিম্যাসনরাও তখন ইউরোপে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। সমাজের রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা কিংবা সন্দেহে ভোগা অনেক স্বাধীন চিন্তাবিদও শামিল হয়েছেন ফ্রিম্যাসনদের দলে। ভাইশপটও ভেবেছিলেন ফ্রিম্যাসনদের কোনো লজে যোগ দেবেন। কিন্তু ফ্রিম্যাসনদের কিছু নিয়ম দেখে তার মনে কিছু খটকা লাগলো। যা-ই হোক, প্রাচীন ইহুদি গোপন দর্শন ‘কাব্বালাহ’সহ আরও অন্যান্য গোপন জ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকলেন তিনি, আর সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই আরেকটা গুপ্তসংঘ গঠন করবেন।

গোপন সমাজ
১৭৭৬ সালের পহেলা জানুয়ারি, ইনগোলস্টাডটের কাছেই এক বনে একত্রিত হলো ৫ জন। রাতের অন্ধকারে হাতে মশাল জ্বালিয়ে হাজির হয়েছে ইলুমিনাটির প্রাথমিক সদস্যরা, আর সেখানেই গঠন করা হলো ইলুমিনাটিতে যোগ দেওয়ার প্রাথমিক রীতিনীতিসহ সংগঠন চালানোর যাবতীয় নিয়মকানুন। ইলুমিনাটিতে নতুন সদস্য ভর্তি করার ক্ষেত্রে কয়েকটি জিনিস অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আর তা হলো সমাজে ভালো প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকতে হবে, ভালো এবং সমাজের কর্তৃস্থানীয় পরিবারের সদস্য হতে হবে এবং অবশ্যই ধনী হতে হবে।
একদম শুরু থেকেই ইলুমিনাটির সদস্যদের তিনটি ধাপ ছিল। প্রথমটি হলো নভিস অর্থাৎ নবশিক্ষার্থী, দ্বিতীয়টি হলো মিনার্ভালস, আর শেষটি হলো ‘ইলুমিনেটেড মিনার্ভালস’। রোমান জ্ঞানের দেবী মিনার্ভার নাম থেকে ধার করার কারণ হলো ইলুমিনাটির সদস্যরা বিশ্বাস করে তাদের কাজ হচ্ছে সমাজে সত্য জ্ঞান অর্থাৎ ‘ইলুমিনেশন’ ছড়িয়ে দেওয়া; এই সমাজ, এই রাষ্ট্র সত্য জ্ঞানের আলোকে পরিবর্তন করে ফেলা।
কয়েক বছরের মধ্যেই ইলুমিনাটি সদস্যের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়া শুরু করে। ৬ বছরের মধ্যেই প্রায় ৬০০ জন নতুন সদস্য যোগ হয় ইলুমিনাটিদের দলে। এদের মধ্যে রয়েছে বাভারিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব লোক, যেমন: ব্যারন অ্যাডলফ ফন নিগ কিংবা ব্যাংকার মেয়ার অ্যামশেল রথসচাইল্ড, যিনি টাকা-পয়সার জোগান দিতেন। প্রাথমিক পর্যায়ে অ্যামশেল রথসচাইল্ডের মতো ভাইশপটের ছাত্ররাই ইলুমিনাটিতে যোগ দিয়েছিলো। তবে ধীরে ধীরে এই দলে ভিড়তে থাকে সমাজের গণ্যমান্য লোকজন। রাজনীতিবিদ, অভিজাত, ডাক্তার, উকিল, বিচারক তো ছিলই, সাথে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকরাও যোগ দিয়েছিলো, বিশেষ করে তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত জার্মান লেখক ভোলফগ্যাং ফন গথও ভিড়েছিলেন ইলুমিনাটিদের দলে। ১৭৮৪ সালের মধ্যে ইলুমিনাটির সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় দুই হাজারেরও বেশি।

ব্যারন ফন নিগ ইলুমিনাটির সাংগঠনিক আর সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাবেক ফ্রিম্যাসন হিসেবে ফ্রিম্যাসনদের অনেক কিছুই ইলুমিনাটির অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন তিনি। ইলুমিনাটির প্রত্যেক সদস্যের একটি করে গোপন নাম ছিল, যেগুলো নেওয়া হতো ক্ল্যাসিক্যাল যুগের চরিত্রগুলো থেকে। ভাইশপটের নাম ছিল ‘স্পার্টাকাস’, অন্যদিকে নিগ ছিল ‘ফিলো’। সদস্যদের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ৩টি ধাপ থাকলেও পরবর্তীকে একে আরো কয়েকটি উপধাপে ভাগ করা হয়। ১৩টি পদকে ৩টি উপশ্রেণীতে ভাগ করা হয়। প্রথম শ্রেণীর সর্বোচ্চ ধাপ ‘ইলুমিনেটাস মাইনর’, দ্বিতীয়টির ‘ইলুমিনেটস ডিরিজেনস’ এবং শেষটির ‘কিং’ বা রাজা।

অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র
ইলুমিনাটির প্রাক্তন এক সদস্য জোসেফ উটজস্নাইডার ইলুমিনাটির কার্যক্রম ফাঁস করে দেন। তিনি বাভারিয়ার গ্র্যান্ড ডাচেসের কাছে চিঠি লেখেন ইলুমিনাটির গোপন তথাকথিত ‘ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে। সত্য-মিথ্যা দু’ধরনের তথ্যে ভরপুর এই চিঠিতে উটজস্নাইডার লিখেছেন, ইলুমিনাটির সদস্যরা বিশ্বাস করে আত্মহত্যা করা পাপের কিছু নয়, কিংবা শত্রুদেরকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা যাবে, এমনকি ধর্ম হচ্ছে ফালতু একটি বিষয়। তিনি এমন কথাও লিখেছেন যে, ইলুমিনাটরা বাভারিয়ার ডিউকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, অস্ট্রিয়ানদের সহায়তার তারা ক্ষমতা দখল করে নেবে।
স্ত্রীর সতর্কবার্তায় বাভারিয়ার ডিউক ১৭৮৪ সালের জুন মাসে যেকোনো ধরনের গোপন সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ইলুমিনাটির সদস্যরা ভেবেছিলো, এতে তাদের সংগঠনের উপর খুব একটা প্রভাব পড়বে না, কিন্তু পরের বছরেই এক নতুন আদেশে ‘ইলুমিনাটি’ দলটিকেই নিষিদ্ধ করা হয়।
পরবর্তীতে পুলিশ গ্রেপ্তার করার সময় ইলুমিনাটির সদস্যদের বাসা থেকে ইলুমিনাটির নিয়ম আর পরিকল্পনা সম্বলিত কিছু কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে, যার মধ্যে ছিল নাস্তিকতা আর আত্মহত্যার স্বপক্ষে যুক্তি, ইলুমিনাটির নারী শাখা খোলার পরিকল্পনা, অদৃশ্য কালি তৈরির উপকরণের তালিকা, গর্ভপাত করার জন্য চিকিৎসার যন্ত্রের মতো জিনিস। এই প্রমাণগুলো পরবর্তীতে রাষ্ট্র আর ধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৭৮৭ সালে ডিউক ইলুমিনাটির তৎকালীন সদস্যদের উপর মৃত্যুদণ্ডাদেশ আরোপ করে, অর্থাৎ ইলুমিনাটির নতুন কোনো কার্যক্রমের সাথে জড়িয়ে পড়লেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

ভাইশপটকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ভাইশপট তার বাকি জীবন কাটিয়েছিলেন স্যাক্সনিতে, গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে। ব্যারন নিগকেও বাভারিয়া ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়। বাভারিয়ার মাটি থেকে সমূলে উচ্ছেদ করা হয় ইলুমিনাটিকে।
যদিও ইলুমিনাটির কিংবদন্তী থেমে যায়নি। ভাইশপটকে পরবর্তীতে দায়ী করা হয় ফরাসি বিপ্লবের ইন্ধনদাতা হিসেবে। ইলুমিনাটি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়েও বিভিন্ন কন্সপিরেসি থিওরি রয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির গুপ্তহত্যাসহ অনেক ঘটনার পেছনেই ইলুমিনাটিকে দায়ী করা হয়। ড্যান ব্রাউনের অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমনস কিংবা উমবার্তো একোর ফুকল্টস পেন্ডুলাম বইয়েও তুলে ধরা হয়েছে ইলুমিনাটি নিয়ে বিভিন্ন কন্সপিরেসি থিওরি। ভাইশপটের চিন্তা-ভাবনা শেষমেশ রূপ নিয়েছে এমন এক তত্ত্বে, যেখানে গুপ্তসংঘ সবসময়ই চায় আড়ালে থেকে ক্ষমতার সুতো নাড়াতে।