
নেদারল্যান্ডসের রাজপরিবার হাউজ অফ অরেঞ্জ। এই অরেঞ্জ দক্ষিণ ফ্রান্সের একটি মধ্যযুগীয় প্রিন্সিপ্যালিটি। এককালে তারা ছিল আর্লেস সাম্রাজ্যের অধীনে। আর্লেসের পতনের পর দ্বাদশ শতক থেকে তারা হলি রোমান এম্পায়ারের অংশ হয়ে যায়। এখানকার শাসকেরা নিজেদের প্রিন্স উপাধি দিয়ে শাসন করতে থাকেন। ১১৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে হাউজ অফ শ্যালন পরিবার অরেঞ্জের ক্ষমতায় ছিল।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে অরেঞ্জের শাসক শ্যালন পরিবারের ফিলিবার্ট মারা যান। নিঃসন্তান ফিলিবার্টের উত্তরাধিকার বর্তায় বোনের ছেলের দিকে। ফিলিবার্টের বোন ক্লডিয়া বিয়ে করেন জার্মানির নাসাউ’য়ের শাসক তৃতীয় হেন্ড্রিককে। তাদের ছেলে রেনে হলেন নতুন প্রিন্স অফ অরেঞ্জ। ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাবার মৃত্যুর পর নাসাউসহ নেদারল্যান্ডসের কিছু এলাকাও রেনের আওতায় চলে আসে।
১৫৪৪ সালে রেনে কোনো সন্তান না রেখে মারা যান। তিনি উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করে যান কাজিন উইলিয়াম অফ নাসাউকে। শর্ত ছিল- তার বংশের নামে অরেঞ্জ থাকতে হবে। ফলে উইলিয়াম পত্তন করেন হাউজ অফ অরেঞ্জ-নাসাউ। এই উইলিয়ামই হলেন উইলিয়াম দ্য সাইলেন্ট।

ডাচ প্রজাতন্ত্র
উইলিয়াম আর এগমন্টের চাপে ফিলিপ গ্রেনভিলকে প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু তাতে অবস্থার খুব উন্নতি হলো না। তরুণ অভিজাতেরা তখন ইনকুইজিশনের নিন্দা জানিয়ে একটি ঘোষণাপত্র প্রদান করে (Compromise of Breda)। একই সময় নেদারল্যান্ডসের কয়েক জায়গায় সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল। উইলিয়াম আর এগমন্ট আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনেন। কিন্তু সংঘটিত বিশৃঙ্খলার জন্য ফিলিপ তাদের দায়ী করতে পারেন ভেবে উইলিয়াম আপাতত নাসাউ চলে যান, এগমন্ট নেদারল্যান্ডসেই রয়ে গেলেন।

ফিলিপ কিন্তু নেদারল্যান্ডসের বিক্ষোভে যথেষ্ট ক্রুদ্ধ হন। প্রিন্স অফ অরেঞ্জকে অপরাধী ঘোষণা করা হলো। ফিলিপ তার বিশ্বস্ত ডিউক অফ আলভাকে একদল সেনা দিয়ে নেদারল্যান্ডস পাঠালেন। পরিষ্কার নির্দেশ ছিল- যেকোনো উপায়ে এই ধর্মদ্রোহীদের পিষে ফেলতে হবে। এই কাজে আলভার কুখ্যাতি আগে থেকেই ছিল। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে ছিলেন আলভা, এই সময়ে হাজারে হাজারে লোক তার নির্যাতনে প্রাণ হারায়। তাদের মধ্যে ছিলেন এগমন্টও।
এদিকে উইলিয়াম একদল সেনা জোগাড় করে ফিলিপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন। শুরু হলো আশি বছরের স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৫৬৮-১৬৪৮)। উইলিয়াম কোনো সেনাপতি ছিলেন না, ফলে আলভার সুদক্ষ স্প্যানিশ সৈনিকদের হাতে তার ক্রমাগত পরাজয় হতে থাকল। কিন্তু বাহিনী চালাতে আলভার দরকার ছিল অর্থ, সেই অর্থ যোগাতে তিনি অতিরিক্ত কর আরোপ করলে ক্ষুব্ধ লো কান্ট্রির বহু এলাকাই উইলিয়ামের সাথে একাট্টা হয়। বিদ্রোহীরা স্থলে স্প্যানিশ সেনাদের কাছে পাত্তা না পেলেও সাগরে সুদক্ষ ডাচ নাবিকেরা স্প্যানিশ জাহাজের উপর বারংবার আক্রমণ করে তাদের রসদপত্র সরবরাহ চূড়ান্তভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে ডাচ বিদ্রোহীরা ছোট্ট শহর ব্রিল কব্জা করে। এতে নেদারল্যান্ডসে বিপুল উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। প্রোটেস্ট্যান্ট উইলিয়াম, যিনি ফিলিপের পিতা চার্লসের চাপে ক্যাথলিক চার্চে যোগ দিয়েছিলেন তিনি আবার প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চে ফিরে আসেন। তাকে এবং তার বংশধরদের নেদারল্যান্ডসের গভর্নর, বা স্টাডহোল্ডার (Stadholder) পদবি দেয়া হয়। প্রতিটি শহরের আলাদা আলাদা স্টাডহোল্ডার থাকার কথা থাকলেও এরপর থেকে সাধারণত প্রিন্স অফ অরেঞ্জই একক স্টাডহোল্ডার হিসেবে মনোনীত হতেন।
উইলিয়ামের বাহিনী এরপর বেশ কয়েকবারই স্প্যানিশদের হাতে পরাস্ত হয়। কিন্তু তারা অনেক ডাচ শহর শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। দরকারমতো বাঁধ বা ডাইক খুলে চারদিক পানিতে ভাসিয়ে দেবার কৌশল প্রয়োগ করে তারা স্প্যানিশদের যথেষ্ট নাজেহাল করতে সক্ষম হয়। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে বেতন না পেয়ে স্প্যানিশ সেনারা অ্যান্টওয়ার্প শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালালে নেদারল্যান্ডসের ধৈর্যের শেষ বাঁধটুকুও ভেঙে গেল। দক্ষিণের ক্যাথলিক অঞ্চল আর উত্তরের ক্যালভিনিস্টরা জড়ো হলো উইলিয়ামের পেছনে, চুক্তি করল স্প্যানিশদের মেরে তাড়ানোর (Pacification of Ghent 1576)।
কিন্তু ক্যাথলিক আর ক্যালভিনিস্টদের মধ্যে ধর্মগত বিভেদ ছিল প্রবল, তাই কখনোই তারা একে অপরের সাথে একমত হতে পারেনি। সাময়িকভাবে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের পর স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে এক হলেও তাদের দ্বন্দ্ব কিন্তু মেটেনি। এদিকে স্পেন থেকে ততদিনে ডিউক অফ পারমা অতিরিক্ত স্প্যানিশ সেনা নিয়ে এসে পৌঁছেছেন। পারমা একজন দক্ষ জেনারেল এবং কূটনীতিবিদ। ক্যাথলিক স্পেনের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নেদারল্যান্ডসের অনেক ক্যাথলিককেই নিজের পক্ষে টেনে আনতে শুরু করেন।
১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাসেলসের কাছে পারমা বিদ্রোহীদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এরপর বেলজিয়ামসহ নেদারল্যান্ডসের দক্ষিণের ক্যাথলিক অঞ্চল ধীরে ধীরে পুরোটাই আবার স্পেনের হস্তগত হয়। এখানে প্রতিষ্ঠিত হলো স্প্যানিশ নেদারল্যান্ডস। কিন্তু উত্তরে ডাচরা লড়াই জারি রাখে।
১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি উত্তরের প্রোটেস্ট্যান্ট সাত প্রদেশ উট্রেখট শহরে চুক্তি (Union of Utrecht) স্বাক্ষর করে। গঠিত হলো ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অভ নেদারল্যান্ডস বা রিপাবলিক অফ সেভেন ইউনাইটেড প্রভিন্সেস। সাতটি প্রদেশ ছিল হল্যান্ড, জিল্যান্ড, গেল্ডারল্যান্ড, গ্রনিজেন, ফ্রাইজল্যান্ড, উট্রেখট আর ওভারাইসসেল। প্রতিটি প্রদেশ এই সম্মিলনে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করত। প্রত্যেক প্রদেশের আর নগরের প্রতিনিধিত্বকারী ছিলেন নির্বাচিত এস্টেট জেনারেল, তাদের সম্মেলন ছিল অনেকটা সংসদের মতো। দেশ চালাতে তারা কাজ করতেন স্টাডহোল্ডারের সাথে। প্রতিটি প্রদেশ আলাদা স্টাডহোল্ডার নিয়োগের নিয়ম থাকলেও সর্বসম্মতিক্রমে প্রিন্স অফ অরেঞ্জের হাতেই বংশানুক্রমে এই ক্ষমতা তুলে দিতে সবাই সম্মত হয়। তৎকালীন রাজতন্ত্রভিত্তিক শাসনের সামনে ডাচ প্রজাতন্ত্র ভিন্ন একটি ব্যবস্থার উদাহরণ ছিল। নবগঠিত প্রজাতন্ত্রে নাগরিক অধিকার এবং সাধারণ মানুষের শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল অনন্য।

১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে নতুন এই ডাচ রিপাবলিক স্পেনের থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করল। অখন্ড নেদারল্যান্ডসের আশা ত্যাগ করে নবগঠিত সেভেন প্রভিন্সের নেতা হিসেবে প্রিন্স অফ অরেঞ্জ উইলিয়াম স্বাধীনতা বজায় রাখতে ফিলিপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। স্টাডহোল্ডার হিসেবে তিনি একইসাথে ছিলেন স্থলবাহিনী এবং নৌবাহিনীর কমান্ডার। তবে কোনো প্রিন্স অফ অরেঞ্জই নৌবাহিনীর দায়িত্ব নিয়ে সাগরে লড়াই করেননি, তারা সবসময়ে স্থলযুদ্ধেই নেতৃত্ব দিতেন।
উইলিয়ামের মৃত্যু এবং পরবর্তী পরিস্থিতি
১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুলাই নেদারল্যান্ডসের ডেলফট শহরে আততায়ীর হাতে নিহত হন উইলিয়াম দ্য সাইলেন্ট। স্প্যানিশরা তার মাথার উপর বিপুল পুরষ্কার ধার্য করেছিল। সেই অর্থ বাগিয়ে নিতেই এক উগ্রপন্থী ক্যাথলিক বালথাজার জেরার্ড ডেলফটে হাজির হয়।
উইলিয়ামের বাড়ি ছিল ডেলফটে। আসল উদ্দেশ্য গোপন রেখে বালথাজার জুলাইয়ের ১০ তারিখ তার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি পান। তিনি যখন উইলিয়ামের বাসায় পৌঁছেন তখন উইলিয়াম কয়েকজন অতিথির সাথে খাওয়াদাওয়া করছিলেন। খাবার শেষ করে উইলিয়াম যখন নিচে নামেন তখন লুকনো পিস্তল বের করে বালথাজার গুলি করে উইলিয়ামকে হত্যা করেন। পালিয়ে যাবার চেষ্টার সময় তাকে আটক করা হয়। বিচারে বালথাজারের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর শাস্তি ঘোষিত হলো।

উইলিয়ামের মৃত্যুর পর জন ভন অল্ডেনবার্নওয়েল্ডট শিশু রিপাবলিকের অভিভাবকের দায়িত্ব নেন। সংবিধান অনুযায়ী, সাত প্রদেশের প্রতিটিই স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা ভোগ করত, ফলে যুদ্ধের জন্য যে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দরকার হয় তাতে প্রচুর ঘাটতি ছিল। এর মাঝেও প্রায় ত্রিশ বছর ধরে অল্ডেনবার্নওয়েল্ডট রিপাবলিককে স্প্যানিশ আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে যান। এতে সাগরে ডাচ জাহাজের শ্রেষ্ঠত্ব এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডের সহায়তার ভূমিকা ছিল। ওদিকে উইলিয়ামের তরুণ ছেলে মরিস বাবার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি নিজেকে একজন দক্ষ সেনাপতি হিসেব প্রমাণ করেন।
ইংল্যান্ডের জনগণ এবং রানী প্রথম এলিজাবেথ বরাবরই ডাচদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু একইসাথে তৎকালীন পরাশক্তি স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের সাথে সরাসরি বিরোধে যাওয়াও তিনি সমীচীন মনে করেননি। ফলে ইংল্যান্ডের সহায়তা ছিল খুব সামান্য। তবে ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে এলিজাবেথ লিসেস্টারের আর্লের অধীনে একদল সৈনিক সেখানে প্রেরণ করেন, যারা স্প্যানিশ চাপে জর্জরিত ডাচ সেনাবাহিনীকে কিছুটা দম ফেলার সুযোগ করে দেয়। ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনারা নেদারল্যান্ডস ত্যাগ করে।
এর কিছুকাল পরেই ফিলিপ ইংল্যান্ড আক্রমণের জন্য স্প্যানিশ আর্মাডা পাঠান। ডিউক অফ পারমারও এর সঙ্গী হবার কথা ছিল, কিন্তু উপকূলে ডাচ জাহাজ পারমার বহর আটকে দেয়। ১৫৮৮ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপের স্প্যানিশ আর্মাডা চুরমার হয়ে গেলে স্প্যানিশ শক্তি হ্রাস পায়। এই সূত্র ধরে মরিস ময়দানে স্প্যানিশ বাহিনীকে উপর্যুপরি পরাজিত করে সাত প্রদেশের আনাচকানাচ থেকে ঝেটিয়ে বিদেয় করলেন।

১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপ মারা গেলেও তার উত্তরাধিকারীরা নেদারল্যান্ডসের সমস্তটাই অধিকার করার আশা তখনো ছেড়ে দেয়নি। কিন্তু ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে জিব্রাল্টারে স্প্যানিশ নৌবহর ডাচদের হাতে বিধ্বস্ত হলে স্প্যানিশরা বুঝতে পারল সাত প্রদেশকে বশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু সরাসরি তাদের স্বাধীনতা মেনে নিতে স্প্যানিশ দম্ভেও সায় দিচ্ছিল না। ফলে তারা ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে বার বছরের অস্ত্রবিরতি স্বাক্ষর করে।
যুদ্ধ থেমে গেলে ডাচরা মনোযোগ দেয় তাদের মূল শক্তি, নৌবাহিনীকে আরো কর্মক্ষম করার কাজে। ফলে অস্ত্রবিরতি শেষে ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় স্পেন যখন যুদ্ধের ময়দানে নামে তখন দেখতে পেল সাগরে ডাচ জাহাজের দাপটে তারা পাত্তাই পাচ্ছে না। কাজেই স্থলবাহিনী দুর্বল হলেও সাগরের আধিপত্য ধরে রেখে ডাচরা স্প্যানিশদের ঠেকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়। ১৬৩৯ সালে বেশ কয়েকবারই স্প্যানিশ নৌবাহিনী মার খায় ডাচ অ্যাডমিরাল ভন ট্রম্পের বহরের হাতে, ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে স্প্যানিশ নৌশক্তি।

এদিকে এই পুরো সময়ই ইউরোপে চলছিল ত্রিশ বছরের যুদ্ধ (Thirty Years War), যার অংশ ছিল স্প্যানিশ-ডাচ সংঘাতও। আলাদা করে ডাচদের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম আশি বছরের যুদ্ধ (The Eighty Years’ War; ১৫৬৮-১৬৪৮) নামে পরিচিত। ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই যুদ্ধের সমাপ্তিতে ওয়েস্টফ্যালেয়ার শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে ট্রিটি অফ মান্সটারে’র মাধ্যমে ডাচ রিপাবলিক স্পেনের তরফ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে সক্ষম হলো। সমাপ্ত হয় ডাচ স্বাধীনতার লড়াই, যা আশি বছরের যুদ্ধ নামেও পরিচিত। এর পর থেকে স্প্যানিশ নৌবাহিনী ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ডাচ নৌবহর, যাদের এককালে বলা হত বেগারস অফ দ্য সি বা সাগরের ভিক্ষুক, তারা আত্মপ্রকাশ করল নতুন এক নৌশক্তি রূপে।
ইংল্যান্ডের সাথে বিবাদ
১৬২১ খ্রিস্টাব্দে ডাচরা প্রতিষ্ঠা করেছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মতো তারাও দিকে দিকে উপনিবেশ স্থাপন করে। তবে তাদের উপনিবেশ তুলনামূলকভাবে অনেক কম ছিল। ডাচদের মূল ব্যবসা ছিল মশলার। জাহাজভর্তি মশলা নিয়ে তাদের বণিকেরা সাগর পাড়ি দিয়ে প্রচুর বাণিজ্য করত।
তৎকালীন ডাচ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও চলছিল নানামুখী খেলা। প্রতিটি প্রদেশ নিজেদের অধিকার নিয়ে ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বিশেষ করে, সবচেয়ে বড় এবং সমৃদ্ধ প্রদেশ হল্যান্ডের সাথে অন্যান্য প্রদেশগুলোর মন কষাকষি ছিল, কারণ বড় হবার কারণে এস্টেট জেনারেলদের সভায় হল্যান্ডের প্রতিনিধি সংখ্যা এবং ভোটের ক্ষমতাও বেশি। একক রাষ্ট্র হিসেবে নেদারল্যান্ডসের শক্তিশালী হবার প্রধান অন্তরায় ছিল তাদের মধ্যকার এই রেষারেষি।
এস্টেট জেনারেলরা নিজেদের ক্ষমতার কান্ডারি মনে করতেন, রাজার মত স্টাডহোল্ডারের সর্বময় ক্ষমতা তাদের অনেককেই ঈর্ষান্বিত করে তোলে। ফলে ডাচ রাজনীতিতে দুটি পক্ষের প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, প্রিন্স অফ অরেঞ্জের সমর্থক, বা অরেঞ্জিস্ট। তারা চাইতেন স্টাডহোল্ডার হিসেবে অরেঞ্জের যুবরাজ সম্মিলিত সাত প্রদেশের একক শাসক হবেন। অন্যদিকে রিপাবলিকানরা প্রজাতান্ত্রিক শাসন এবং এস্টেট জেনারেলদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল।
উইলিয়াম দ্য সাইলেন্টের ছেলে মরিস ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে মারা গেলে স্টাডহোল্ডার হন তার ভাই ফ্রেডেরিক হেনরি। তিনি স্পেনের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রেখেছিলেন। ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা গেলে তার স্থলাভিষিক্ত হন ছেলে দ্বিতীয় উইলিয়াম। দ্বিতীয় উইলিয়ামের স্ত্রী ছিলেন ব্রিটিশ রাজকন্যা মেরি। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম গুটিবসন্তে মারা যাবার সপ্তাহখানেক পর তার একমাত্র সন্তান তৃতীয় উইলিয়ামের জন্ম হয়।কিন্তু নবজাতক প্রিন্স অফ অরেঞ্জ তো স্টাডহোল্ডারের দায়িত্ব পালন করতে এখনো সক্ষম নন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিপাবলিকান গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এস্টেট জেনারেলরা গ্র্যান্ড পেনশনার (Grand Pensionary) নামে এক পদ বহুদিন পর সক্রিয় করলেন, যিনি হবেন এস্টেট জেনারেলদের প্রধান। নির্বাচিত গ্র্যান্ড পেনশনার প্রধানমন্ত্রীর মতো দেশ শাসন করবেন, তাকে সহায়তা করবে সম্মিলিত এস্টেট জেনারেলদের পরিষদ। রিপাবলিকানদের নেতা জোহান ডি উইট গ্র্যান্ড পেনশনার হিসেবে নিযুক্ত হলেন, স্টাডহোল্ডারের পদ আপাতত স্থগিত করা হল। পরবর্তী বিশ বছর ডি উইটের সুযোগ্য নেতৃত্বে ডাচ প্রজাতন্ত্র নিজেদের গুছিয়ে নিতে থাকে, একইসাথে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকেও নিজেদের রক্ষা করে যায়। হতাশ অরেঞ্জিস্টরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকল।

ডি উইটের সময়েই ইংল্যান্ডের সাথে ডাচদের যুদ্ধ বেঁধে যায়। ১৬৫০ সালে অলিভার ক্রমওয়েলের ইংল্যান্ড আর ডি উইটের ডাচ প্রজাতন্ত্র একটি জোটের ব্যাপারে আলোচনা করলেও সাগরে আধিপত্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নিজ নিজ উপনিবেশ স্থাপনকারী কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্র ধরে আলোচনা ভেঙে যায়। ডাচদের প্রতি ইংল্যান্ডের মূল অভিযোগ ছিল ব্যবসায়িক। ডাচ জাহাজ ইংল্যান্ডের জলসীমা থেকে প্রচুর মাছ ধরে তীর এনে বিক্রি করত। আবার ইংল্যান্ড থেকে সস্তা দরে কাপড় কিনে পোশাক বানিয়ে বেশি দামে বেচে দিত ব্রিটিশদের কাছেই। ফলে ব্রিটিশরা ডাচ মুনাফার হিস্যা দাবি করে। স্বাভাবিকভাবেই ডাচরা রাজি ছিল না।
নেদারল্যান্ডসকে শায়েস্তা করতে ইংল্যান্ড আইন জারি করল তাদের দেশে কোনো পণ্য প্রবেশ করতে পারবে কেবল ব্রিটিশ জাহাজ বা উৎপাদনকারী দেশের জাহাজে করে, এবং ইংল্যান্ড যেকোনো যুদ্ধে লিপ্ত থাকাকালে নিজ জলসীমায় প্রবেশ করা সমস্ত জাহাজ তল্লাশি করবার অধিকার রাখবে (নেভিগেশন আইন/Navigation Act of 1651)। এই আইন প্রয়োগের ফলে সেখানে ডাচ ব্যবসা প্রচণ্ডভাবে মার খায়, বিশেষ করে তাদের মাছের ব্যবসা।
ডাচরা নেভিগেশন আইনের বিরোধিতা করলে ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দে শুরু হলো দুই নৌবাহিনীর লড়াই। ইংল্যান্ডের নেতৃত্বে অ্যাডমিরাল ব্লেক, তার প্রতিপক্ষ ভন ট্রম্প। দুই অ্যাডমিরালের লড়াই ছিল অমীমাংসিত। তবে ১৬৫২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জুলাই ব্যাটল অফ শেভেনিঙ্গেনে (Battle of Scheveningen) ব্রিটিশ জাহাজের বন্দুকধারীদের গুলিতে ট্রম্প নিহত হলে ডাচ নৌবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এদিকে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি ডাচ বানিজ্য জাহাজগুলোর বিপুল ক্ষতি করছিল। ফলে ১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে স্বাক্ষরিত হয় ট্রিটি অফ ওয়েস্টমিনস্টার। ডাচরা নেভিগেশন আইন মেনে নিতে বাধ্য হলো।

ক্রমওয়েলের দাবি ছিল তৃতীয় উইলিয়াম অথবা তার বংশধরেরা কখনোই স্টাডহোল্ডার হতে পারবেন না। এই দাবিও ডি উইট মেনে নেবার নিশ্চয়তা দেন। ক্রমওয়েলের ভয়ের কারণ ছিল মা মেরির সূত্রে উইলিয়ামের দেহে বইছে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজপরিবারের রক্ত। স্টুয়ার্ট রাজা প্রথম চার্লসকে সরিয়েই তো ক্রমেওয়েল ক্ষমতা নিয়েছেন। তার জানা ছিল তৃতীয় উইলিয়াম কোনোভাবে ডাচদের নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হলে নিজের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ইংল্যান্ডের সিংহাসন বাগানোর চেষ্টা করতে পারেন। সেই সম্ভাবনা তাই তিনি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চাইছিলেন। তৃতীয় উইলিয়ামের স্টাডহোল্ডার হবার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনে ট্রিটি অফ ওয়েস্টমিনস্টার ডাচ প্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অরেঞ্জিস্টদের সাময়িকভাবে পঙ্গু করে দিল।
মিখিয়েল ডি রুইটার ডাচ বহরের অধিনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হবার পূর্বে এই ছিল ডাচ প্রজাতন্ত্রের অবস্থা। ক্রমওয়েলের ইংল্যান্ডের সাথে লড়াইতে তার ভূমিকা উঠে আসবে পরবর্তী পর্বগুলোতে। তবে আন্তর্জাতিকভাবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে ডাচ ফ্লিটের সর্বাধিনায়ক হিসেবেই। সে এমন একসময় যখন দেশ শাসন করছে ডি উইটের নেতৃত্বে এস্টেট জেনারেল পরিষদ। তরুণ তৃতীয় উইলিয়াম স্টাডহোল্ডার পদ থেকে বঞ্চিত, কিন্তু অরেঞ্জিস্টরা সংগঠিত হচ্ছে নতুন করে।
ওদিকে ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর ইংল্যান্ড ফিরে গেছে রাজতন্ত্রে, সিংহাসনে বসেছেন উইলিয়ামের আত্মীয় স্টুয়ার্ট বংশীয় রাজা দ্বিতীয় চার্লস, নেদারল্যান্ডস নিয়ে তার নিজস্ব পরিকল্পনা আছে। স্পেনের দিকে থেকে বিপদ কেটে গেলেও ঘনিয়ে উঠছে নতুন আপদ, ফ্রান্স। ফরাসি সম্রাট লুই ছক কষছেন কীভাবে সমৃদ্ধ ডাচ প্রজাতন্ত্র হাতিয়ে নেয়া যায়, এতে সীমানা বৃদ্ধির সাথে সাথে কোষাগারও ভারি হবে।
তৎকালীন পরাশক্তি ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর কাছে ডাচদের অপেশাদার ছোট্ট সেনাদল তেমন পাত্তাই পাওয়ার কথা নয়। ডাচদের একমাত্র অস্ত্র তাই তাদের শক্তিশালী নৌবহর বা ডাচ ফ্লিট। তৎকালীন পৃথিবীতে ডাচ ফ্লিটেরই শক্তি ছিল খোলা সাগরে রয়্যাল নেভি আর ফরাসি নৌবাহিনীর মুখোমুখি হবার। তবে ভন ট্রম্পের মৃত্যুর পর তাদের দরকার হয় একজন যোগ্য কমান্ডার।