Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

শাজার-উদ-দার: ইতিহাসের আড়ালে থাকা সুলতানা

ক্লিওপেট্রা আর জেনোবিয়ার দেশ মিশরে নারীর সিংহাসনে আরোহণ নতুন কোনো ঘটনা না হলেও মধ্যযুগে মুসলিম নারী হিসেবে সিংহাসনে বসার কথা ভাবাটা বেশ দুঃসাহসিক একটা ব্যাপার ছিল বলা যায়। কেননা সেই সময়ে মুসলিম নারীদের রাজনীতির চর্চা  হেরেম পর্যন্তই সীমিত থাকতো। কিন্তু সিংহাসনে বসে রাজ্য পরিচালনা করা নারীদের জন্য কল্পনাতীত ছিল। তবে এই দুঃসাহসিক কাজটি শাজার-উদ-দার করে দেখিয়েছিলেন, তিনি বিখ্যাত আইয়্যুবী বংশের পতন ঘটিয়ে মিশরে মামলুক বংশের শাসন শুরু করেন এবং মুসলিমদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সিংহাসনে আরোহণকারী দ্বিতীয় নারী হিসেবে আবির্ভূত হন। দিল্লীর সুলতানি আমলে সর্বপ্রথম মুসলিম নারী হিসেবে সুলতানা রাজিয়া দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তারপর দ্বিতীয় মুসলিম নারী হিসেবে শাজার-উদ-দার মিশরের সিংহাসনে বসেন। মধ্যযুগের মুসলিমদের ইতিহাসে ক্রুসেড একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর এই সময়েই শাজার-উদ-দারের আবির্ভাব ঘটে। সপ্তম ক্রুসেডে তিনি প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে রেখেছিলেন অনবদ্য ভূমিকা। তবে একজন নারী শাসক হওয়ার কারনে তাকে অশেষ দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মিশরের দুর্দিনে তিনি বেশ শক্তি আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। অথচ, ইতিহাসে তার নাম তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। ইতিহাসের আড়ালেই চলে গেছে তার অসীম সাহসিকতার বর্ণনা

শাজার-উদ-দারের ছবি; image source: muslimheritage.com

ক্রুসেডের বীর যোদ্ধা গাজী সালাহ-উদ-দ্বীনের নেতৃত্বে ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে আইয়্যুবী বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গাজী সালাহ-উদ-দ্বীনের উত্তরাধিকারীরা তার মতো যোগ্য ছিলেন না। আইয়্যুবী বংশের ইতিহাস ছিল গৃহযুদ্ধ ও হানাহানির ইতিহাস। সুলতান গাজী সালাহ-উদ-দ্বীন ও সুলতান আল-আদিল বাদে প্রায় প্রত্যেক সুলতানই ছিলেন মদ ও জুয়ায় আসক্ত। তাদের নৈতিক চরিত্রের স্খলন ঘটেছিল। তবে আইয়্যুবীদের শাসন আমলে সামরিক বিভাগের একটা বড় অংশ জুড়ে মামলুকদের আধিপত্য ছিল। মামলুক শব্দের অর্থ ‘অধীনস্থ দাস’। গাজী সালাহ-উদ-দ্বীন সর্বপ্রথম বিভিন্ন প্রদেশ হতে এই দাসদেরকে মিশরে ক্রয় করে নিয়ে এসেছিলেন । মামলুকদের দাপটেই শত্রুপক্ষ সর্বদা তটস্থ থাকতো। মামলুকদের নিয়ে গঠিত সামরিক বাহিনীই আইয়্যুবী বংশের গৌরব বজায় রেখেছিল, নতুবা অনেক আগেই এ বংশের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটত। পরবর্তীতে এই মামলুকরা বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে আর তারাই শাজার-উদ-দার কে সিংহাসনে বসিয়ে মিশরে মামলুক শাসনের সূচনা করেন।

শাজার-উদ-দার: যে বৃক্ষে মুক্তা জন্মায়

শাজার-উদ-দারের পুরো নাম ‘ইসমাত-উদ-দীন উম্মে খলিল শাজার-উদ-দার’। ইসমাত-উদ-দীন  অর্থ ‘ধর্মের রক্ষক’ আর ‘শাজার-উদ-দার’ নামের অর্থ মুক্তাবৃক্ষ বা যে বৃক্ষে মুক্তা জন্মায়। তিনি ১২১৫ মতান্তরে ১২২০ সালে জন্মলাভ করেন। ধারণা করা হয়, তিনি আর্মেনিয়ার কিপচাক তুর্কি গোত্রের একটি মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বেশ দুরন্ত আর নির্ভীক ছিলেন। তিনি ধনুর্বিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। পরিবারের আর্থিক সংকটে পড়ে তাকে দাস হিসেবে বিক্রি হতে হয়। আর্মেনিয়া থেকে বাগদাদের খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহর দরবারে দাস হিসেবে তাকে প্রথম আনা হয়। বাগদাদে থাকাকালীন তিনি খলিফার খাস দাসী ছিলেন। পরবর্তীতে আইয়্যুবী সুলতান আস-সালিহ যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তিনি খলিফার নিকট স্বীকৃতি চাইলে খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ তাকে সুলতানের স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং উপহার হিসেবে শাজার-উদ-দারকে আস-সালিহের দরবারে প্রেরণ করা হয়। আইয়্যুবী সুলতান আস-সালিহের খাস দাসী হিসেবে তাকে নিয়োজিত করা হয়। রূপে-গুণে আর বুদ্ধিমত্তায় তিনি অনায়াসেই সুলতানের মন জয় করে নেন। ১২৪৯ সালে সুলতান আস-সালিহ তাকে বিয়ে করেন এবং সুলতানার স্বীকৃতি দেন।

সপ্তম ক্রুসেডে শাজার-উদ-দারের বলিষ্ঠ ভূমিকা

আইয়্যুবীদের শাসনামলে, বিশেষত আস-সালিহের সময় মামলুকদের নিয়ে একটি শক্তিশালী বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর সাহায্যে ১২৪৫ সালে আস-সালিহ সিরিয়ার দামাস্কাস দখল করেন। তারপর তিনি জেরুজালেম দখলের চেষ্টা চালান। ইতোমধ্যে ক্রুসেড বাহিনী বেশ তৎপর হয়ে ওঠে। এবার তারা শুধু জেরুজালেম নয় বরং মিশরের দিকেও ধাবিত হয়। ফলে সপ্তম ক্রুসেডের শুরু হয়। ১২৪৯ সালের নভেম্বরে মাসে ক্রুসেডাররা কায়রোর দিকে ধাবিত হয় ও তারা আদ-দামিয়াত বন্দর দখল করে নেন। আস-সালিহ তখন সিরিয়ায় অবস্থান করছিলেন। ফলে মিশরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। এসময় শাজার-উদ-দার সামরিক বিভাগের হাল ধরেন। তিনি মামলুক বাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব নেন

যুদ্ধের পোশাক পরিহিত শাজার-উদ-দার (অঙ্কিত ছবি); image source: historiafactory

কিছুদিন পর আস-সালিহ ফিরে এসে ক্রুসেডারদের দমনে উদ্যোগ নেন। আস-সালিহের বাহিনী ও ক্রুসেডার বাহিনীর আল-মানসুরাহ নামক স্থানে মিলিত হয়। উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আস-সালিহ আহত হন। কয়েকদিন পর তিনি  মৃত্যুবরণ করেন। সেসময়টা পুরো মিশরের জন্য একটা কঠিন সময় ছিল। কিন্তু শাজার-উদ-দার স্বামীর মৃত্যুতে একদম ভেঙে পড়েননি। আস-সালিহের অসুস্থতার কথা সবাই জানতো। কিন্তু তার মৃত্যুর খবর যদি ছড়িয়ে পড়ে, তবে আস-সালিহের সৈন্যদলের মনোবল ভেঙে যাবে, এতে করে শত্রুপক্ষের জন্য মুসলিম বাহিনীকে ঘায়েল করা সহজ হবে। কিন্তু শাজার-উদ-দার মামলুক বাহিনীর প্রধান বাইবার্সের সাথে বুদ্ধি করে আস-সালিহের মৃত্যুর খবর গোপন রাখলেন। তিনি নিজে যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিতে লাগলেন। বাইবার্সের সহায়তায় তিনি মুসলিমবাহিনীর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পেরেছিলেন। এমনকি তিনি সুলতানের সিলমোহর ব্যবহার করে সুলতানের নামে সকল প্রকার ফরমান জারি করতে লাগলেন। পরবর্তীতে তিনি আস-সালিহের সন্তান আল মুয়াজ্জাম তুরান শাহকে মিশরে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করার জন্য পত্র প্রেরণ করলেন। শাজার-উদ-দারের কোনো সন্তান না থাকায় তিনি তার সৎ পুত্র তুরান শাহকে সিংহাসনে বসার জন্য পরিকল্পনা করেন। তুরান শাহ অন্য প্রদেশে দায়িত্বরত ছিলেন, বিধায় কিছুদিন সুলতানের নামে তিনি সকল আদেশ জারি করতেন। এদিকে ফরাসি সম্রাট নবম লুইস ক্রুসেড বাহিনী নিয়ে ক্রমশই এগিয়ে আসছিল। কিন্তু মামলুক বাহিনীর প্রধান বাইবার্সের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী ক্রুসেড বাহিনীকে পরাজিত করেন। শাজার-উদ-দার সম্রাট নবম লুইসকে বন্দি করার আদেশ দেন। তাকে বন্দি করে মিশরে আনা হয়।

 পটে আঁকা মানসুরাহ যুদ্ধে মামলুক বাহিনী কর্তৃক বন্দী নবম লুইস; image source: weaponsandwarfare.com

শাজার-উদ-দারের ক্ষমতায় আরোহণের পটভূমি ও সালতানাতে অরাজকতার সূচনা

এদিকে তুরান শাহ মিশরে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের পর পর তিনি বেশ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেন। তিনি ছিলেন অহংকারী ও অপরিণামদর্শী ব্যক্তি। যুদ্ধ শেষেই তিনি তার সৎ মা শাজার-উদ-দারের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করলেন। যারা বীরত্বের সাথে মানসুরাহতে লড়েছিল, তাদের ভাগ্যে জুটলো অপমান, লাঞ্ছনা ও পদচ্যুতি। নতুন সুলতান তার বন্ধুবান্ধবকে কাজে লাগানোর জন্য পুরাতন ও বিশ্বস্তদের পদ্যচ্যুত করতে লাগলেন। যে শাজার-উদ-দার তারই জন্য শূন্য সিংহাসন আগলে রেখেছিলেন, তিনিই সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত হলেন। সিংহাসনে বসেই তুরান শাহ তার পিতার মৃত্যুশয্যা থেকে শুরু করে তার সিংহাসন আরোহণ পর্যন্ত প্রত্যেকটি কাজের লিখিত হিসাব শাজার-উদ-দারের নিকট দাবি করলেন। সাথে সাথে হিসাব দাখিল করতে না পারায় শাজার-উদ-দার প্রকাশ্যে অপমানিত হলেন। মামলুক নেতৃবৃন্দ তার পক্ষ নিতে যাওয়ায় তারাও তিরস্কৃত ও পদচ্যুত হলেন।

এমনকি সুলতান তুরান শাহ বাইবার্স ও শাজার-উদ-দারের অনুরোধ উপেক্ষা করে সম্রাট নবম লুইসকে ১০ লাখ স্বর্ণমুদ্রা ও আদ্-দামিয়াত ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে মুক্তি দিয়ে দেন। অথচ শাজার-উদ-দার চাইছিলেন সম্রাট নবম লুইসকে জিম্মি রেখে  ত্রিপলীর দায়িত্ব মিশরের মুসলিমদের উপর ছেড়ে দেয়া হোক (তুরান শাহ এই দাবি জানালে ক্রুসেডাররা মানতে বাধ্য হতো, কারণ খোদ সম্রাটই তখন তুরান শাহের হাতে বন্দি)। কিন্তু সুলতানের কাছে মুসলিম ভূখণ্ডের চাইতে অর্থের গুরুত্ব বেশি ছিল। তবে এর ফল খুব একটা ভালো হলো না। সুলতানের স্বেচ্ছাচারিতা মেনে না নিয়ে মামলুক ও অন্য ব্যক্তিবর্গ তুরান শাহের বিরুদ্ধে চলে গেল, বিশেষ করে তুরান শাহ যখন সামান্য শর্তের বিনিময়ে ফ্রান্সের সম্রাটকে মুক্ত করে দিলেন, তখন বাইবার্স ক্রুদ্ধ হয়ে ১২৫০ সালের ২রা মে তুরান শাহকে হত্যা করেন।

শাজার-উদ-দারের ক্ষমতায় আরোহণ

সুলতান তুরান শাহের মৃত্যুর পর মামলুক আমীররা তুরান শাহের সৎমা শাজার-উদ-দারকে সিংহাসনে বসালেন। অতঃপর শাজার-উদ-দার সিংহাসনে আরোহণ করে আইয়্যুবি বংশের গৌরবময় ৭৯ বছরের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটান। আর মিশরে মামলুক শাসনের পত্তন করেন। শাজার-উদ-দারের প্রশাসন ব্যবস্থায় প্রশাসক হিসেবে আমীর ইজ-আল-দীন-আইবেককে নিয়োগ দেয়া হয়।

শাজার-উদ-দারের শাসনকার্য

সিংহাসনে আরোহণের পর মুসলিম শাসকগণ নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রকাশের জন্য দুটি কাজ করতেন। প্রথমত, খুতবায় নিজের নাম পাঠ করার নির্দেশ দিতেন। দ্বিতীয়ত, নিজ নামে মুদ্রা প্রচলনের ব্যবস্থা করতেন। মিশরের সুলতানা শাজার-উদ-দারও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না, তিনি খুবই উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি শুধু শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেই ক্ষান্ত থাকলেন না। বরং তিনি জুম্মার নামাযে খুতবায় নিজের নাম পাঠ করার নির্দেশ দেন। এমনকি তিনি নিজের নামেও মুদ্রা জারি করেন।

শাজার-উদ-দারের নিজ নামে জারিকৃত মুদ্রা; image source: wikimedia commons

তিনি মিশর ও অধিভুক্ত সিরিয়ার শাসন কার্য পরিচালনার লক্ষ্যে দক্ষ লোক নিয়োগ দেন। তিনি প্রজাদের কল্যানে সরকারি জমি বরাদ্দ রাখেন। মক্কায় তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা করেন। তিনি সৈন্যদের অস্ত্রবিদ্যার কৌশল চর্চার জন্য আলাদা দুর্গ নির্মাণ করেন। তাছাড়া তার সময়ে মিশরের সাংস্কৃতিক উন্নয়নও সাধিত হয়।  দিনে দিনে তিনি প্রজাদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। কিন্তু তার এই জনপ্রিয়তা বেশিদিন টিকতে পারেনি। দরবারের আমীর-ওমরাগণ মুসলিম নারীর শাসন ও জনপ্রিয়তা মেনে নিতে পারলেন না। তবে মামলুক বাহিনীর উপর শাজার-উদ-দারের আধ্যিপত্য ছিল বিধায় আমীর-ওমরাগণ কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছিলেন না।

সিংহাসন হতে অপসারণ

শাজার-উদ-দার তার সালতানাতে সুষ্ঠুভাবে শাসন কায়েম করতে লাগলেন। মুসলিম সালতানাতের নিয়ম অনুযায়ী, সিংহাসনে আসীন হবার পর সুলতানকে মুসলিম খিলাফতের প্রধান অর্থাৎ খলিফার নিকট আনুগত্য প্রকাশ করে সুলতান হিসেবে স্বীকৃতি গ্রহণ করতে হয়। আর পূর্ববর্তী মুসলিম সুলতানের মতো শাজার-উদ-দারও বাগদাদের তৎকালীন খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহর নিকট সুলতানের স্বীকৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে দূত প্রেরণ করেন। কিন্তু তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। খলিফা আল-মুসতাসিম বিল্লাহ তার পত্র পেয়ে ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি কিছুতেই একজন নারীকে মুসলিম সালতানাতের শাসক হিসেবে মেনে নিতে চাইলেন না। তাছাড়া শাজার-উদ-দার একসময় তারই দরবারের দাসী ছিলেন। এমনকি তিনিই আস-সালিহের নিকট উপহার হিসেবে শাজার-উদ-দারকে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং শাজার-উদ-দারকে মুসলিম শাসক রূপে তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি আমীর-ওমরাহদের নিকট একটি পত্র প্রেরণ করেন।

“তোমাদের যদি শাসন করার মতো কোন পুরুষ না থাকে তাহলে আমাকে বলতে, আমি না হয় একজন পুরুষ পাঠিয়ে দিতাম।”  

খলিফার এমন ব্যঙ্গাত্মক পত্রে আমীরগণ অপমানিত বোধ করেন এবং ক্ষুব্ধ হন। তারা শাজার-উদ-দারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ হন। বিশেষত শাজার-উদ-দারের আমীর আইবেক এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি শাজার-উদ-দারকে হঠিয়ে নিজে সিংহাসনে বসতে চাইছিলেন। আর তাই তিনি অন্যান্য আমীরদের সাথে পরিকল্পনা করে শাজার-উদ-দারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন।

শর্তভঙ্গ ও সুলতানার মৃত্যু

উপায়ান্তর না দেখে শাজার-উদ-দার আমীর ইজ-আল-দীন-আইবেকের সাথে সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সন্ধির শর্ত হিসেবে আমীর আইবেককে বিয়ে করতে হবে এমন প্রস্তাবে শাজার-উদ-দার রাজি হলেন। আর চুক্তিতে শাজার-উদ-দার আইবেকের পাটরানী বা প্রধান সুলতানা হবেন, এমন শর্ত রেখেছিলেন। এমনকি তিনি আইবেকের প্রথম স্ত্রী উম্মে আলীকে তালাক দেয়ার পরামর্শ দেন। অতঃপর শাজার-উদ-দারকে বিয়ে করে সুলতানার পক্ষে তার স্বামী সিংহাসনে বসলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আইবেক চুক্তি ভঙ্গ করলেন। তিনি তৃতীয় বিয়ে করলেন। এবং শাজার-উদ-দারকে প্রধান সুলতানার পদ হতে অপসারণ করলেন। এতে করে শাজার-উদ-দার ক্ষুব্ধ হন। এবং আইবেককে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। 

তবে শাজার-উদ-দার আর রক্ষা পেলেন না। তিনি বন্দী হলেন। ধারণা করা হয়, আইবেকের প্রথম স্ত্রী উম্মে আলী তাকে ১২৫৭ সালে তাকে হত্যা করেন। তার মৃত্যু সম্পর্কিত এমন কথাও প্রচলিত আছে যে, আইবেকের প্রথম  স্ত্রী তার লোকবলের সহায়তায় শাজার-উদ-দারকে কাঠের বস্তু দ্বারা আঘাত করতে করতে তাকে মেরে ফেলে। পরে তার রক্তাক্ত দেহ দুর্গের উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার মৃত দেহ নাকি তিনদিন পর্যন্ত গর্তে পড়ে ছিল। পরে তার দেহ উদ্ধার করে কবরস্থ করা হয়। কায়রো শহরেই তার সমাধি রয়েছে।

কায়রোতে শাজার-উদ-দারের সমাধি; image source:  gettyimages

আর এভাবেই মুসলিম শাসনব্যবস্থায় আরেক নারী শাসককে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুকে বরণ করতে হল। তিনি মিশরের দুর্দিনে শক্তভাবে হাল ধরেছেন। তারই বুদ্ধিমত্তায় ও বাইবার্সের নেতৃত্ব সপ্তম ক্রুসেডেও মুসলমানরা জয়ী হয়।তবে ইতিহাসে তার বীরত্বগাথা তেমনভাবে প্রকাশ না পেলেও মধ্যযুগের ঔপন্যাসিক জুরজি জায়দানের ‘শাজার-উদ-দার’ নামক উপন্যাসে তার বীরত্বের কাহিনী লেখা রয়েছে। এই উপন্যাসের মাঝেই তিনি অমর হয়ে আছেন।

জুরজি জায়দানের  ‘শাজার-উদ-দার’ নামক উপন্যাসের প্রচ্ছদ; image source: muslimheritage.com

ফিচার ইমেজ: muslimheritage.com

Related Articles